ইমাম হোসাইন (আ.) ও কারবালার ঘটনা এমন কি ইমামের সঙ্গীদের নিয়ে বিভিন্ন রকম আলোচনা হয়ে থাকে যে, আশুরার পূর্ব রাতে কতজন সঙ্গী ইমামকে ছেড়ে চলে যান বা আসলে কারবালাতে ইমামের পক্ষে কতজন সঙ্গী শত্রুদের মোকাবেলা করে শহীদ হয়েছেন। অবশ্য এ বিষয়ে অনেক দৃষ্টিভঙ্গিও পাওয়া যায়
কিন্তু কোনটা ঠিক আর কোনটা ঠিক নয় তা অনেক সাধারণ লোকের জানা নেই। তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে হলে আমাদেরকে বিশেষ দুটি বিষয়ে নিয়ে আলোচনা করতে হয়; ১। ইমামের সঙ্গী সাথীদের বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যতা এবং ২। ইমামের সঙ্গী সাথীদের সংখ্যা।
১) ইমামের সঙ্গী সাথীদের বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যতা:
ইতিহাসের বিভিন্ন গ্রন্থে লেখকগণ আশুরার পূর্ব রাতের ঘটনাগুলো উল্লেখ করার সময় বলেছেন যে, ইমাম হোসাইন (আ.) যখন নিজের সঙ্গী ও আত্মীয়স্বজনদের আহবান করেছেন যে, শত্রুদের মুখোমুখি ইমামকে রেখে তারা যার যার পথে চলে যেতে পারে। এমনকি বাইআত তুলে নেয়ার কথাও বলেছেন; তখন তারা ঐক্যবদ্ধ ভাবে বীরত্বপূর্ণ ও আবেগময় ভাষায় ইমামের পথে নিজেদেরকে উতসর্গ করে দেয়ার কথা বর্ণনা করেছেন। আর তাদের মধ্য হতে একজনও ইমামকে শত্রুদের মাঝে ছেড়ে চলে যেতে রাজি হননি। ঠিক এখানেই ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর প্রসিদ্ধ কথাটি বলেছেন:
“… فانی لا اعلم اصحاباً أولی ولا خیراً من اصحابی و لا أهل بیت ابرّ و لا أوصل من أهل بینی”
“আমার সঙ্গী সাথীদের চেয়ে উত্তম ও শ্রেষ্ঠতম সঙ্গী সাথী এবং আমার পরিবারবর্গের মত আত্মীয় সম্পর্ক রক্ষা করা, সতকর্মশীল ও নেককার কোনো পরিবারবর্গ আমি দেখিনি”।(১)
তাছাড়া এ সকল ঐতিহাসবীদগণ “যাবালা” নামক স্থানে ইমাম হোসাইনের (আ.) দুধ খাওয়া ভাই “আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াকতার” -এর শহীদ হয়ে যাওয়ার খবর শোনার পর ইমাম হোসাইনকে (আ.) ছেড়ে চলে যাওয়া অনেক সঙ্গী সাথীদের কথাও উল্লেখ করেছেন ! এ সকল হতাশামূলক খবর শোনার পর ইমাম হোসাইন (আ.) পত্রের মাধ্যমে হযরত মুসলিম, হানি ও আব্দুল্লাহ -এর শাহাদাতের খবর উল্লেখ করে বর্ণনা করেন:
“… و قد خذلتنا شیعتنا فمن أحبّ منکم الإنصراف فلینصرف لیس علیه منا ذمام”
“আমাদের অনুসারীরা (শিয়ারা) আমাদেরকে অপমানিত করেছে ! তাই যার ইচ্ছা আমাদেরকে ছেড়ে যেতে চায় যেতে পারে, কেননা আমি তোমাদের থেকে বাইআত তুলে নিচ্ছি”।(২)
এ সময় ইমামের সঙ্গী সাথীরা দলে দলে ইমামকে ছেড়ে চলে যায় এবং সব শেষে খুব কম সংখ্যক ইমামের সাথে ছিল। আর এ সংখ্যাতে ঠিক তারাই ছিলেন যারা মদিনা হতে ইমামের সাথে সফর শুরু করেছিলেন !
ইমামকে ছেড়ে চলে যাওয়া দলটি ছিল আরব, যারা এ কথা মনে করে ইমাম
ের সাথে যাচ্ছিল যে, ইমাম এমন এক শান্তিপূর্ণ স্থানে যাচ্ছেন যেখানে গিয়ে নিজেই রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন।(৩) অবশ্য এরূপ ছেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার।
এ স্থানের পর ইমামকে ছেড়ে চলে যাওয়া সম্পর্কে আর কোনো বিশ্বস্ত গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে “নুরুল উয়ুন” এর মত কিছু অপরিচিত ও অজ্ঞাত বইতে যা নির্ভরযোগ্য নয় ইমাম হোসাইনের (আ.) কন্যা সাকিনা হতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, দশটা দশটা ও বিশটা বিশটা করে কয়েকটি দলের বর্ণনা এসেছে যারা ইমামকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল এবং যাদেরকে সাকিনা অভিশাপ ও বদদোয়া দিয়েছিলেন !(৪)
অবশ্য পরবর্তী অনির্ভরযোগ্য বই ও এ লেখকের যইফ রেওয়ায়েত বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য বইয়ের সহীহ সনদ হদীসের সাথে তুলনা করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে এ জাল হাদীস আশুরার রাতে ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর সাথীদের বক্তব্য এবং সাথীদের সম্পর্কে ইমামের কৃত প্রশংসার সম্পূর্ণ বিপরীত।
২। ইমামের সঙ্গী সাথীদের সংখ্যা:
আশুরার দিন ইমাম হোসাইনের (আ.) সঙ্গী সাথীদের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন সূত্রমূলক গ্রন্থে মতপার্থক্য দেখা যায়।(৫) তাবারি’র মত অনেকে এ সংখ্যাকে প্রায় ১০০ জন বলে উল্লেখ করেছেন। যাদের মধ্যে ৫ জন ইমাম আলীর (আ.) সন্তান, বনী হাশেম হতে ১৬ জন এবং বাকিরা ছিল অন্যান্য বিভিন্ন গোত্রের।(৬)
ইবনে শাহ্র আশুব-এর মত কেউ কেউ এ সংখ্যাকে ৮২ জন বলে উল্লেখ করেছেন।(৭)
ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীর একজন শিয়া আলেম “ইবনে নোমা” উল্লেখ করেন যে, ইমাম হোসাইনের (আ.) আসহাব বা সঙ্গীর মধ্যে ১০০ জন পায়ে হাটা সৈনিক (পদাতিক বাহিনী) ও ৪৫ জন অশ্বারোহী ছিল।(৮) অবশ্য সিবত ইবনে জাওযিও এ দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে মত দিয়েছেন।(৯) শিয়াদের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে ইমাম বাকের (আ.) হতে বর্ণিত হাদিসেও এ মতে পক্ষে বলা হয়েছে।(১০)
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে মাসউদি’র; যেখানে সে বর্ণনা করে যে, কারবালাতে ইমাম হোসাইন (আ.) অবস্থান নেয়ার সময় পর্যন্ত তাঁর সঙ্গী সাথীদের সংখ্যা ছিল ৫০০ অশ্বারোহী ও ৪০ জন পদাতিক সৈন্য।(১১)
কিন্তু বিখ্যাত ও মশহুর দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে -যা এখনো সবার মাঝে প্রসিদ্ধি লাভ করে আছে- তা হল এই যে, কারবালাতে ইমাম হোসাইনের (আ.) সঙ্গী সাথীদের সংখ্যা ছিল ৭২ জন। যার মধ্যে ৩২ জন ছিল অশ্বারোহী ও ৪০ জন পদাতিক বাহিনী।(১২)**
(বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ধর্মীয় নেতার সংস্কৃতি কেন্দ্র হতে প্রকাশিত, মাজমুএয়ে পোরসেশহায়ে দানেশজুয়ি, খন্ড: ১৩ হতে গৃহীত)
সূত্রসমূহ:
১। ওয়াকআতুত তফ, পৃষ্ঠা: ১৯৭; তাবাকাতু ইবনে সাদ, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ৯৯; তারিখ তাবারি, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ৪১৮; শেইখ মুফিদ, আল ইরশাদ, পৃষ্ঠা: ৪৪২।
২। ওয়াকআতুত তফ, পৃষ্ঠা: ১৬৬।
৩। ওয়াকআতুত তফ, পৃষ্ঠা: ১৬৬।
৪। ইকসিরুল ইবাদাত ফি আসরারিশ শাহাদাত, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা: ১৮২।
৫। তারিখে ইমাম হোসাইন (আ.), ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা: ২৪২।
৬। তারিখ তাবারি, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ৩৯৩।
৭। আল মানাকেব, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা: ৯৮।
৮। মুশিরুল আহযান, পৃষ্ঠা: ২৭ ও ২৮।
৯। তাযকিরাতুল খাওয়াস, পৃষ্ঠা: ১৪৩।
১০। বিহারুল আনওয়ার, ৪৫তম খন্ড, পৃষ্ঠা: ০৪।
১১। মুরুজুয্ যাহাব, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা: ৭০।
১২। আনসাবুল আশরাফ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা: ১৮৭; দাইনাওয়ারি, আল আখবারুত তিওয়াল, পৃষ্ঠা: ২৫৪; ইবনে আ’সাম, আল ফুতুহ, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ১৮৩; বিহারুল আনওয়ার, ৪৫তম খন্ড, পৃষ্ঠা: ০৪; ফাত্তাল নিশাবুরি, রাউযাতুল ওয়াইযিন, পৃষ্ঠা: ১৫৮ ইত্যাদি।
** শুহাদাদের নাম জানতে হলে দ্রষ্টব্য:
ক) বিহারুল আনওয়ার, ১০১তম খন্ড, পৃষ্ঠা: ২৬৯-২৭৪ যিয়ারাতে নাহিয়্যাহ মুকাদ্দাসা, যেখানে এক একজন করে শুহাদাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাদের উপর দরূদ পাঠানো হয়েছে।
খ) সামাউয়ি শেইখ মোহাম্মদ, আবসারুল হোসাইন ফি আনসারুল হোসাইন (আ.), যেখানে ইমামের ১১৩ জন সঙ্গী সাথীর নাম ও তাদের জীবনী বর্ণনা করা হয়েছে।
গ) ফায্ল বিন যুবাইর, ওয়া তাসমিয়াতুমিন কাতলি মাআল হোসাইন (আ.) মিন আহলিহি ওয়া আওলাদিহি ওয়া শিয়াতিহি, যা “তুরাসুনা” পত্রিকার সংখ্যা: ২, ১৪০৬ হিজরিতে প্রকাশিত হয়েছে।
Source: http://www.hussainidalan.com