কারবালার ঘটনা সম্পর্কে অনেক আলোচনা হয় এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবুও কিছু বিষয় রয়েছে যার আলোচনা বিশেষ করে বাংলা ভাষাতে খুব কম হয়েছে। আবার অনেক বিষয় রয়েছে যা আলোচনার সাথে পর্যালোচনা না করলে নয়। তার মধ্যে একটি
বিষয় হল ইমাম হোসাইনের (আ.) কাটা শির বা মস্তক কারবালার ঘটনার পর যালিমেরা কুফা ও শামে নিয়ে যায়; কিন্তু পরবর্তীতে তা কোথায় দাফন করা হয়? এ সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে যা নিয়ে আমরা সংক্ষেপে আলোচনা করবো।
দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ:
১। কারবালা (জানাযার সাথেই)।
২। নাজাফ (হযরত আলীর (আ.) পবিত্র মাযারের পাশে)।
৩। কুফা (আমর বিন হুরাইসের বাসায়)।
৪। মদিনা (হযরত ফাতেমার (সা.) পবিত্র কবরের পাশে বাক্বি কবরস্থানে)।
৫। শাম (মতপার্থক্যে বিভিন্ন স্থানে)।
৬। রিক্কা (ফুরাত তীরে একটি শহরে)।
৭। কাহেরা মিশর।
১। কারবালা (জানাযার সাথেই): এ দৃষ্টিভঙ্গিটিই হচ্ছে শিয়া ওলামাদের নিকট সবচেয়ে বেশি গৃহীত এবং মশহুর। আর আল্লামা মাজলিসিও এ দৃষ্টির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।(১)
শেখ সাদুকও (রা:) হযরত ইমাম আলীর (আ.) কন্যা ও ইমাম হোসাইনের (আ.) বোন ফাতেমা হতে বর্ণনাকৃত একটি হাদীস উল্লেখ করেন, যেখানে কারবালাতেই শরীরের সাথে কাটা শির মিলিত হয়েছে বলে বলা হয়েছে।(২) অবশ্য শরীর বা জানাযার সাথে কাটা শির মিলিত হওয়ার কৈফিয়ত ও পদ্ধতি সম্পর্কে বিভিন্ন রকম দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।
অবশ্য সাইয়েদ বিন তাউস বলেন এ বিষয়টি একটি এলাহি বিষয়। তিনি বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিজের শক্তি ও কুদরতের সাহায্যে এবং মুজেযার মাধ্যমে এ কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। আর এ বিষয়ে কোনো রকম প্রশ্ন করতেও বারণ করেছেন।(৩)
কিছু লোক বলেছেন: ইমাম সাজ্জাদ (আ.) চল্লিশা’র দিনে যখন ফিরে এসেছেন(৪) অথবা অন্য কোনো দিনে কাটা শিরকে তিনি কারবালাতে শরীরের সাথে দাফন করেছেন।(৫)
কিন্তু আসলেই কি কাটা শির শরীরের সাথে দাফন হয়েছে না কি যারিহ (মাযার) এর পাশে কিন্বা জানাযার আশ পাশে দাফন করা হয়েছে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু পাওয়া যায়না। আর এখানেও সাইয়েদ বিন তাউস কোনো রকম প্রশ্ন করতে বারণ করেছেন।(৬)
আরো একদল উল্লেখ করেছেন: এজিদ ক্ষমতায় থাকাবস্থায় কাটা শিরগুলোকে তিনদিন দামেস্কের দরোজাতে ঝুলিয়ে রাখার পর যখন নামানো হয় তখন এগুলোকে অন্যান্য সরঞ্জামের সাথে রাষ্ট্রীয় ভান্ডারে বন্ধ করে রাখা হয় এবং সোলায়মান ইবনে আব্দুল মালেকের যুগ পর্যন্ত সেখানেই রাখা ছিল। অতঃপর, সে ওইগুলোকে বের করে কাফন পরিয়ে দামেস্কে মুসলমানদের এক কবরস্থানে দা
ফন করে। পরবর্তীতে তার জাঁনশিন ওমর ইবনে আব্দুল আযিয (ক্ষমতা ৯৯-১০১ হিজরি) সেইগুলোকে কবর খুড়ে বের করে তার পর সেগুলোকে কি করলো তার কোনো হদিস নেই।! কিন্তু যেহেতু সে ছিলো খুব ধার্মিক প্রকৃতির তাই বলা হয়ে থাকে সম্ভবত সেগুলোকে কারবালার উদ্দেশ্য পাঠিয়ে দিয়েছে।(৭)
তাছাড়া শাবরাউয়ি, শাবলাঞ্জি ও সিবত ইবনে জাওযি প্রমূখ আহলে সুন্নতের কিছু বিজ্ঞ লেখকও এ দৃষ্টিভঙ্গিকে কবুল করেছেন যে, কাটা শির কারবালাতেই দাফন করা হয়েছে।(৮)
২। নাজাফ (হযরত আলীর (আ.) পবিত্র মাযারের পাশে): আল্লামা মাজলিসির বর্ণনা ও গবেষণামূলক বিভিন্ন হাদীসের মাধ্যমে পাওয়া যায় যে, ইমাম হোসাইনের (আ.) শির মোবারককে নাজাফে আশরাফে হযরত আলীর (আ.) পবিত্র মাযারের পাশে দাফন করা হয়েছে।(৯)
বিভিন্ন হাদীস মতে নাজাফে ইমাম আলীর (আ.) মাযারে নামায পড়ার পর ইমাম হোসাইনের (আ.) প্রতি ইমাম সাদেক (আ.) ও তাঁর সন্তান ইসমাইলের সালাম দেয়াটা পরিষ্কার বর্ণনা ও প্রমাণ করে যে, ইমাম সাদেকের (আ.) যুগ পর্যন্ত শির মোবারক নাজাফেই ছিল।(১০)
অন্যান্য আরো অনেক হাদীসেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়; এমনকি বিভিন্ন শিয়া গ্রন্থে হযরত ইমাম আলীর (আ.) কবরের পাশে ইমাম হোসাইনের (আ.) শির মোবারকের জন্য যিয়ারত পড়ার বিষয়েও বর্ণনা করা হয়েছে।(১১)
এ শির মোবারক কিভাবে নাজাফে এসেছে এ বিষয়ে ইমাম সাদেক (আ.) হতে এভাবে বর্ণিত হয়েছে: আশেকানে আহলে বাইতের (আ.) একজন সেই শির মোবারককে শাম নগরী (দামেস্ক) হতে চুরি করে ইমাম আলীর (আ.) কবরের পাশে নিয়ে আসে।(১২) অবশ্য এ দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সমস্যা রয়েছে আর তা হল এই যে, ইমাম সাদেকের (আ.) যুগ পর্যন্ত হযরত আলীর (আ.) কবর সবার কাছে পরিচিত ছিল না।
অপর এক হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে: শির মোবারক কিছুদিন দামেস্কে থাকার পর কুফাতে ইবনে যিয়াদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয় এবং সে জনগণের বিদ্রোহের ভয়ে কুফা হতে বাহিরে নিয়ে হযরত আলীর (আ.) কবরের পাশে দাফন করার হুকুম দেয়।(১৩) পূর্বের দৃষ্টিভঙ্গিতে যে সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এখানেও একই কথা প্রযোজ্য।
৩। কুফা (আমর বিন হুরাইসের বাসায়): সিব্ত ইবনে জাওযি এ দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করে বলে: আমর বিন হুরাইস মাখযুমি শির মোবারককে ইবনে যিয়াদের কাছ থেকে নিয়ে গোসল ও কাফন করে সুগন্ধি মেখে নিজের বাসায় দাফন করে।(১৪)
৪। মদিনা (হযরত ফাতেমার (সা.) পবিত্র কবরের পাশে বাক্বি কবরস্থানে): তাবাকাতুল কুবরা’র লেখক ইবনে সা’দ এ দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করে এরূপ বর্ণনা করেন: এজিদ এ শির মোবারককে মদিনা’র হাকেম আমর ইবনে আসের কাছে পাঠিয়ে দিলে সে কাফন করে বাক্বি কবরস্থানে ইমামের মা হযরত ফাতেমা যাহরা’র (সা.) কবরের পাশে দাফন করে দেয়।(১৫)
আহলে সুন্নতের কিছু মনীষী (যেমন: মাকতালুল হোসাইন এ খোয়ারাযমি, ও সুযুরাতুয যাহাব এ ইবনে এমাদ হাম্বালি) এ দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে মত দিয়েছেন।(১৬)
এ দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রেও সবচেয়ে বড় সমস্যা হল এই যে, হযরত ফাতেমা যাহরা’র (সা.) কবরও নিশ্চিত জানা নেই যে তার পাশে দাফন করা হবে।
৫। শাম (মতপার্থক্যে বিভিন্ন স্থানে): বলা যেতে পারে যে, আহলে সুন্নতের প্রায় বর্ণনা মতে শির মোবারক শামে দাফন করা হয়েছে। অবশ্য এ দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে যারা মত দিয়েছেন তাদের মধ্যেও মতবিরোধ রয়েছে এবং তারা বিভিন্ন মতামত বর্ণনা করেছেন:
ক) ফারাদিস মসজিদের পাশে যেখানে পরবর্তীতে “আর্ রা’স” মসজিদ তৈরী করা হল;
খ) আমাউয়িদের জামে মসজিদের পাশে কোনো এক বাগানে;
গ) দারুল এমারার অভ্যন্তরে;
ঘ) দামেস্কের কোনো এক কবরস্থানে;
ঙ) তৌমা দরজার পাশে।(১৭)
৬। রিক্কা (ফুরাত তীরে একটি শহরে): ফুরাত নদীর তীরে রিক্কা শহরে। এজিদ শির মোবারককে ওসমানের আত্মীয়স্বজনদের একজন আলে আবি মুহিতের জন্য প্রেরণ করে, এজিদের যুগে তারা সেখানেই জীবন যাপন করতো। তারা শির মোবারককে একটি বাড়িতে দাফন করে যা পরবর্তীতে মসজিদে পরিণত হয়ে যায়।(১৮)
৭। কাহেরা মিশর: বর্ণনা করা হয়েছে যে, খোলাফায়ে ফাতেমি -যারা চতুর্থ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকে সপ্তম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের শুরু পর্যন্ত মিশরে রাজত্ব করলো এবং শিয়া ইসমাইলি মাযহাবের অনুসারী ছিল-ইমাম হোসাইনের (আ.) শির মোবারককে শামের ফারাদিস দরজা হতে আসকালানে অতঃপর কাহেরাতে স্থানান্তরিত করে এবং ৫০০ হিজরীর পর সেখানে তাজুল হোসাইন (আ.) নামের মশহুর মাকবারা (কবরস্থান) তৈরী করে।(১৯)
আসকালান হতে কাহেরাতে শির মোবারক স্থানান্তরিত হওয়ার সময় সম্পর্কে মেকরিযি ৫৪৮ হিজরী উল্লেখ করে বলে: আসকালান হতে শির মোবারককে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন দেখা গেছে যে, তার রক্ত তখনো তাজা ছিল ও শুস্ক হয়নি এবং মুশকের মত সুগন্ধি পাওয়া যাচ্ছিল।(২০)
শিয়া আলেম আল্লামা মোহসেন আমোলি আসকালান হতে মিশরে শির মোবারকের স্থানান্তরিতের কথা বর্ণনা করে বলেন: “যেখানে শির মোবারককে দাফন করা হয়েছে সেখানে মাযার (দরবার) নির্মাণ করা হল এবং তার পাশে একটি বড় মসজিদ তৈরী করা হল। আমি ১৩২১ হিজরীতে তা যিয়ারত করি এবং অনেক মহিলা ও পূরুষ লোককে সেখানে যিয়ারত ও অনুনয় করতে দেখেছি। অতঃপর বল
েন: এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, আসকালান হতে একটি শির মিশরে নিয়ে আসা হয়েছিল কিন্তু সেই শিরটি ইমাম হুসাইনের (আ.) ছিল না কি অন্য কারোর এতে সন্দেহ রয়েছে !(২১)
আল্লামা মাজলিসিও (রঃ) একদল মিশরীয়দের বর্ণনা মতে মিশরে “মাশহাদুল কারিম” নামের একটি বড় মাযারের কথা উল্লেখ করেছেন।(২২)
সূত্রসমূহ:
১। বিহারুল আনওয়ার, ৪৫তম খন্ড, পৃষ্ঠা: ১৪৫।
২। আমালিয়ে শেখ সাদুক, পৃষ্ঠা: ২৩১ -এর বর্ণনা মতে বিহারুল আনওয়ার, ৪৫তম খন্ড, পৃষ্ঠা: ১৪০।
৩। সাইয়েদ বিন তাউস, ইকবালুল আমাল, পৃষ্ঠা: ৫৮৮।
৪। শহীদ কাযি তাবাতাবাঈ, তাহকিক দার বারেয়ে আউয়ালিন আরবায়িনে হাযরাতে সাইয়েদুশ শুহাদা, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা: ৩০৪।
৫। লহুফ, পৃষ্ঠা: ২৩২; অবশ্য সরাসরি ইমাম সাজ্জাদের (আ.) নাম সেখানে আসেনি।
৬। ইকবালুল আমাল, পৃষ্ঠা: ৫৮৮।
৭। মাকতালুল খোয়ারিযমি, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা: ৭৫ এর বর্ণনা মতে মোহাম্মদ আমিন আমিনি, মা’আর রাকবিল হুসাইনি, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা: ৩২৪।
৮। মা’আর রাকবিল হুসাইনি, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা: ৩৩০ ও ৩৩১।
৯। বিহারুল আনওয়ার, ৪৫তম খন্ড, পৃষ্ঠা: ১৪৫।
১০। কামিলুয যিয়ারাত, পৃষ্ঠা: ৩৪ -এর বর্ণনা মতে বিহারুল আনওয়ার, ৪৫তম খন্ড, পৃষ্ঠা: ১৭৮; কাফি, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা: ৫৭১।
১১। বিহারুল আনওয়ার, ৪৫তম খন্ড, পৃষ্ঠা: ১৭৮; দ্যষ্টব্য: মা’আর রাকবিল হুসাইনি, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা: ৩২৫ -৩২৮।
১২। বিহারুল আনওয়ার, ৪৫তম খন্ড, পৃষ্ঠা: ১৪৫।
১৩। বিহারুল আনওয়ার, ৪৫তম খন্ড, পৃষ্ঠা: ১৭৮।
১৪। মা’আর রাকবিল হুসাইনি, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা: ৩২৯ এর বর্ণনা মতে তাযকিরাতুল খাওয়াস, পৃষ্ঠা: ২৫৯।
১৫। ইবনে সা’দ, তাবাকাতুল কুবরা, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ১১২।
১৬। মা’আর রাকবিল হুসাইনি, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা: ৩৩০ ও ৩৩১।
১৭। মা’আর রাকবিল হুসাইনি, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা: ৩৩১ -৩৩৫।
১৮। মা’আর রাকবিল হুসাইনি, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা: ৩৩৪ এর বর্ণনা মতে তাযকিরাতুল খাওয়াস, পৃষ্ঠা: ২৬৫।
১৯। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ২০৫।
২০। মা’আর রাকবিল হুসাইনি, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা: ৩৩৭।
২১। সাইয়েদ মোহসেন আমিন আমোলি, লাওয়াএজুল আশজান ফি মাকতালুল হোসাইন (আ.), পৃষ্ঠা: ২৫০।
২২। বিহারুল আনওয়ার, ৪৫তম খন্ড, পৃষ্ঠা: ১৪৪।
Source: http://www.hussainidalan.com