৬১ হিজরির ১২ই মহররম ইয়াজিদ সেনারা নবী পরিবার তথা ইমাম পরিবারের এবং ইমাম শিবিরের সকল নারী ও কন্যা শিশুকে বন্দী করে কুফায় নিয়ে যায়। এ সময় ইয়াজিদ সেনারা শহীদদের বিচ্ছিন্ন মাথা বর্শায় বিদ্ধ করে নিয়ে আসে তাদের সঙ্গে।
কুফায় বন্দীদেরকে ইয়াজিদের গভর্নর ইবনে জিয়াদের দরবারে আনা হলে জিয়াদ তাদেরকে উপহাসের চেষ্টা করে এবং ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.)-কে হত্যা করতে চায়। কিন্তু ইমামের বোন হযরত জয়নাব (সা.)’র সাহসী বক্তব্য ও বিশেষ করে নবী পরিবারের সদস্যদেরকে ত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার ও শাহাদতের মর্যাদা দেয়ার জন্য মহান আল্লাহর প্রতি তাঁর প্রশংসাসূচক কথাগুলো জিয়াদকে হতভম্ব বা লা-জওয়াব করে দেয়।
কারবালার অসম যুদ্ধে অশেষ বীরত্ব ও বিক্রম দেখিয়ে এবং ইয়াজিদের বহু সেনাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে শহীদ হয়েছিলেন হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)সহ ইসলামের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকা ৭২ জন মহামানব। তাদের কেউ ছিলেন ইমামের যুবক পুত্র, শিশু পুত্র, সত ভাই, ভাতিজা, ভাগিনা, চাচাতো ভাই এবং অন্যরা ছিলেন প্রাণ-উতসর্গ করতে আসা নিবেদিত-প্রাণ সঙ্গী।
ইমাম হুসাইন (আ.)’র শাহাদতের পর তাঁর বোন হযরত জয়নাব (সা.) ইমামের একমাত্র জীবিত ও অসুস্থ পুত্র হযরত জয়নুল আবেদীনের (আ.) জীবন রক্ষা করেন। অবশ্য এ জন্য তিনি শত্রুদের কাছে দয়া ভিক্ষা করেননি। ভাতিজাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তিনি জল্লাদকে বলেছিলেন, আমার ভাতিজাকে হত্যা করতে হলে আমাকেও হত্যা করতে হবে। এভাবে তিনি একজন নিষ্পাপ ইমামের জীবন রক্ষা করেন নতজানু না হয়েই। দামেস্কেও এই মহান ইমামকে হত্যার চেষ্টা অলৌকিকভাবে ব্যর্থ হয় বলে বর্ণনা রয়েছে। কোনো কোনো বর্ণনা মতে কারবালায় জয়নুল আবেদীনের শিশু সন্তান ইমাম বাকির (আ.)ও উপস্থিত ছিলেন এবং হত্যাযজ্ঞের পর তিনিও বেঁচে ছিলেন। নবী বংশের কয়েকজন নারী সদস্যও বেঁচে ছিলেন কারবালার হত্যাযজ্ঞের পর।
মহাপাপিষ্ঠ ও নরাধম ইয়াজিদের দরবারে উপনীত হলে তার বেয়াদবিপূর্ণ নানা কথা ও বিদ্রূপের জবাবে হযরত জয়নাব (সা.) এক দীর্ঘ ও ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। তেজোদৃপ্ত সেই ভাষণের একাংশে তিনি বলেছিলেন: “আমাদের শাসন-কর্তৃত্ব (তোমার হাতে পড়ায়) তুমি মহিমান্বিত আল্লাহর সেই বাণী ভুলে গিয়েছ: ‘কাফেররা যেন মনে না করে যে আমরা তাদের যে অবকাশ দান করি, তা নিজেদের জন্য কল্যাণকর। বরং আমরা তো তাদেরকে এ জন্যই অবকাশ দেই যাতে করে তাদের পাপগুলো বাড়তে থাকে এবং তাদের জন্য অপমানজনক শাস্তি অবধারিত।”
তিনি ইয়াজিদকে ‘সে ব্যক্তির পুত্র যাকে বন্দী করার পর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল’ বলেও সম্বোধন করেন!(কারণ, আমির মুয়াবিয়া মক্কা বিজয়ের সময় বন্দী হয়েছিল মুসলিম বাহিনীর হাতে, ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয়ায় তাকে মুক্তি দেয়া হয়)
হযরত জয়নাব (সা.) তাঁর ঐতিহাসিক সেই ভাষণে পবিত্র নবী বংশের, বিশেষ করে ইমাম হুসাইন (আ.)’র মর্যাদা তুলে ধরার পাশাপাশি ইয়াজিদ বাহিনীর জুলুম ও নৃশংসতাও তুলে ধরেছিলেন ।
তিনি ইমাম হুসাইন (আ.)’র সঙ্গে ইয়াজিদের নানা বেয়াদবি এবং নবী বংশের ওপর তার বাহিনীর নৃশংস জুলুম নির্যাতন চালানোসহ হত্যাযজ্ঞের জন্য তাকে খোদায়ী কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে বলে উল্লেখ করেন। হযরত জয়নাব (সা.) এক পর্যায়ে ইয়াজিদের দরবারেই তাকে বলেন, “যদিও ঘটনাচক্রে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য হয়েছি, কিন্তু আমি তোমাকে খুবই তুচ্ছ ও নীচ মনে করি এবং তোমাকে কঠোরভাবে তিরস্কার করছি ও অনেক বেশি নিন্দা করছি, কিন্তু (আমার ভাইয়ের হত্যার কারণে মুসলমানদের ) দৃষ্টিগুলো অশ্রুসজল আর হৃদয়গুলো কাবাবের মত দগ্ধীভূত।”
বিশ্বনবী (সা.)’র আহলে বাইতের প্রতি উম্মতের ভালবাসা ও তাঁদের স্মরণ যে ইয়াজিদ গোষ্ঠী কখনও বিলুপ্ত করতে পারবে না এবং আহলে বাইতের মর্যাদার ধারে কাছেও যে পৌঁছুতে পারবে না ইয়াজিদ গোষ্ঠী তিনি তাও ভবিষ্যদ্বাণী করেন। জালিমদের ওপর যে আল্লাহর লানত বর্ষিত হবে এবং ইহকালে তাদের পতন ও চরম লাঞ্ছনা এবং পরকালেও আরো কঠোর শাস্তি অপেক্ষা করছে হযরত জয়নাব (সা.) তাও উল্লেখ করেন ওই ভাষণে।
তাঁর সেইসব অবিস্মরণীয় ভাষণ ও বক্তব্যগুলো মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচারিত হয়ে দামেস্ক ও কুফাসহ মুসলিম বিশ্বের জনগণের মধ্যে বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিল। গোটা আরব উপদ্বীপের চার লাখ মানুষ হুসাইন (আ.) হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য অভ্যুত্থান করে। ফলে কুফায় মুখতারের নেতৃত্বে নবী বংশের অবমাননাকারী ও ঘাতকরা লাঞ্ছনাপূর্ণ মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে নির্মূল হয়। আর এ জন্যই নবী(সা.) -নাতনী হযরত জয়নাব (সা.)-কে কারবালা বিপ্লবের অন্যতম সফল সংগঠক ও প্রধান পরিচালক বলা যায়। তাঁর বিপ্লবী ততপরতা ও উপস্থিতি না থাকলে কারবালাতেই এ বিপ্লবের চির-সমাধি ঘটত এবং বাইরের কেউই এ বিপ্লব ও মহাট্র্যাজেডির খবরও হয়তো জানতো না।
গণ-বিদ্রোহের আশঙ্কায় ইবনে জিয়াদের আতঙ্ক
জিয়াদ নবী (সা.)’র পরিবারের অবমাননার জন্য কুফা শহরের রাস্তায় রাস্তায় বন্দীদেরকে ঘুরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে উদ্যত হলে আবারও স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ করেন নবী-নাতনী। তাঁর বাগ্মীতাপূর্ণ ও বিবেক-জাগানো এবং হৃদয়-বিদারক বক্তব্য শুনে কুফার জনগণ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। ফলে ইবনে জিয়াদ গণ-বিদ্রোহের আশঙ্কায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় সে বন্দীদের কাফেলাকে দ্রুত দামেস্কে পাঠানোর নির্দেশ দেয় এবং এমন সব পথ দিয়ে তাদেরকে নিয়ে যেতে বলে যাতে জনগণ নবী-পরিবারের দুর্দশার কথা জানতে পেরে ইয়াজিদ সরকারের প্রতি গণ-বিদ্রোহ বা গণ-বিক্ষোভ শুরু করার সুযোগ না পায়।
সূত্র: সাইয়েদ ইবনে তাউস রচিত লোহুফ গ্রন্থ

http://www.tvshia.com/bn/content/14219