মদিনা থেকে বসরাভিমুখে’ যাত্রাকালে কুফার জনগণকে লেখেছিলেন
আল্লাহর বান্দা ও মোমিনগণের কমান্ডার আলীর কাছ থেকে কুফার জনগণের প্রতি যারা সহায়তা দানে অগ্রণী ও আরবদের প্রধান ।
উসমানের ওপর যা আপতিত হয়েছিল এখন আমি তা এমন সঠিকভাবে তোমাদের কাছে বর্ণনা করছি। যাতে তোমরা স্বচক্ষে দেখার মতো বুঝতে পার। জনগণ তার সমালোচনা করেছিল। মুহাজিরদের মধ্যে আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে মুসলিমদের সন্তুষ্ট রাখার এবং ক্ষেপিয়ে না তোলার জন্য তাকে উপদেশ দিয়েছিল। তালহা ও জুবায়ের তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ কঠোর পদক্ষেপ গ্ৰহণ করেছিল এবং তারা তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। আয়শাও তার ওপর খুব ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল। ফলে একটা দল তাকে আক্রমণ করে হত্যা করেছিল। তারপর জনগণ আমার কাছে বায়াত গ্রহণ করে। এ বায়াতে কোন প্রকার জোর-জবরদস্তি ছিল না বা কাউকে বায়াত গ্রহণে বাধ্য করা হয় নি। স্বেচ্ছায় ও স্বাধীনভাবে তারা বায়াত গ্ৰহণ করেছে।
তোমরা জেনে নাও, মদিনা আজ জনশূন্য হয়ে পড়েছে। বিদ্রোহ দমনের জন্য মদিনা আজ বিশাল পাত্রের ফুটন্ত পানির ন্যায় উত্তপ্ত হয়ে আছে। অপরদিকে বিদ্রোহীরাও পূর্ণ শক্তি নিয়ে তাদের অক্ষরেখায় আবর্তিত হচ্ছে। সুতরাং তোমরা তোমাদের আমিরের (কমান্ডার) দিকে দ্রুত এগিয়ে আস— এগিয়ে আসি তোমাদের শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করতে। যদি তোমরা তা কর তবে সর্বশক্তির আধার আল্লাহ তোমাদের ওপর সন্তুষ্ট হবেন।
১। বাহারানী*** (৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৩৩৩) লেখেছেন যে, তালহা ও জুবায়র কর্তৃক ফেতনা সংঘটনের সংবাদ শুনেই আমিরুল মোমেনিন বসরা অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন। পথিমধ্যে মা’আল আযাব নামক স্থান থেকে তিনি স্বীয় পুত্র ইমাম হাসান ও আম্মার ইবনে ইয়াসিরের মারফত কুফাবাসীদের নিকট এ পত্র প্রেরণ করেন।
হাদীদ’*’ (১৪শ খন্ড, পৃঃ ৮-১৬), আহীর, (৩য় খন্ড, পৃঃ ২২৩) ও তাবারী’ (১ম খন্ড, পৃঃ ৩১৩৯) লেখেছেন যে, বসরার বিদ্রোহ দমনের জন্য যাত্রা করে আমিরুল মোমেনিন পথিমধ্যে আর-রাবাযাহ নামক স্থানে ক্যাম্প করেছিলেন। সে ক্যাম্প থেকে তাঁর ভ্রাতুষ্পপুত্র মুহাম্মদ ইবনে জাফর ও মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরের মারফত এ পত্র প্রেরণ করেছিলেন। এ পত্রে আমিরুল মোমেনিন প্রকাশ্যে বলেছেন যে, উসমানের হত্যা মূলত আয়শা, তালহা ও জুবায়রের প্রচেষ্টার ফল এবং তারাই এ হত্যাকান্ডে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। বস্তুতঃপক্ষে আয়শা এতই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি প্রকাশ্য জনসভায় উসমানের দোষত্রুটি প্রকাশ করে তাকে হত্যা করা জায়েজ বলে ঘোষণা করেছিলেন । আবদুহ’ (২য় খন্ড, পৃঃ ৩), ফিন্দা” (১ খন্ড, পৃঃ ১৭২) ও বালাজুরী” (৫ম খন্ড, পৃঃ ৮৮) লেখেছেনঃ একদিন উসমান মিম্বারের ওপর ছিলেন । এমন সময় উন্মুল মোমেনিন আয়শা তার বোরখার ভেতর থেকে রাসুলের (সঃ) জুতা ও কামিজ বের করে বললেন, “এ জুতা ও কামিজ আল্লাহর রাসুলের যা এখনো বিনষ্ট হয় নি । এরই মধ্যে তোমরা তাঁর দ্বিনি ও সুন্নাহ পরিবর্তন করে। ফেলেছো | ” আয়শার কথায় উসমান ক্ষেপে গিয়ে তার সাথে উচ্চবাচ্য শুরু করেছিল কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে আয়শা বললেন, “এ নাছালিকে হত্যা করা জায়োজ” (নাছালি অর্থ হলো—লম্বা দাড়িওয়ালা ইহুদী) || এমনিতেই জনগণ উসমানের ওপর অসন্তুষ্ট ও ক্ষিপ্ত ছিল। এ ঘটনা তাদের সাহস আরো বাড়িয়ে দিল এবং তারা তাকে ঘেরাও করে দুটি দাবি পেশ করেছিল। দাবি গুলো হলো— উসমান তার ভুল-ভ্রান্তি সংশোধন করবে, না হয় খেলাফত হতে সরে যাবে। ঘেরাওকারীগণ এত বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল যে, তাদের দুটো দাবির যে কোন একটা মেনে না নিলে উসমান নিহত হবার সম্ভাবনা প্রকট হয়ে উঠেছিল। আয়শা অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। কিন্তু তিনি কোন কথা বলেন নি। বরং উসমানকে অবরোধে ফেলে তিনি মক্কা চলে যাবার সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করেন। এ সময় মারওয়ান ইবনে হাকাম ও আত্তাব ইবনে আসিদ আয়শার কাছে এসে তাকে বললো, ”আপনি এখন মক্কা যাওয়া স্থগিত করলে উসমানের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হবে এবং জনতা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।” তাদের কথায় আয়শা বললেন যে, তিনি হজ করার নিয়্যত করেছেন। কাজেই তা পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না। এতে মারওয়ান একটা প্ৰবাদ বাক্য বললো, যার অর্থ হলোঃ কায়েস আমার নগরে আগুন লাগিয়ে দিলো, এবং যখন অগ্নিশিখা জ্বলে উঠলো, সে নিজকে রক্ষা করে কেটে পড়লো।
একইভাবে তালহা ও জুবায়র উসমানের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল এবং তারাই উসমানের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ঘনীভূত করা ও বিদ্রোহের আগুন প্রজুলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। এ দৃষ্টিকোণ থেকে তারাই উসমানের হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী এবং তারাই তাতে অংশগ্রহণকারী। অধিকাংশ মানুষ তাদের কর্মকান্ড সম্বন্ধে অবহিত ছিল এবং তাদেরকেই উসমানের খুনি বলে মনে করতো। তাদের সমর্থকগণও তাদের এ অপরাধ খণ্ডন করে কোন
ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কুতায়বাহ’ (১ম খন্ড, পৃঃ ৬০) লেখেছেনঃ বসরার পথে আওতাম নামক স্থানে আয়শার সাথে মুঘিরা ইবনে শুবাহুর সাক্ষাত হলে মুঘিরা জিজ্ঞেস করেছিল, “হে উন্মুল মোমেনিন, আপনি কোথায় যাচ্ছেন ?” উত্তরে আয়শা বললেন, “আমি বসারা যাচ্ছি।” মুঘিরা, বসরা যাবার উদ্দেশ্য জানতে চাইলে আয়শা বললেন, “উসমানের রক্তের বদলা নেয়ার জন্য যাচ্ছি।” মুঘিরা স্তম্ভিত হয়ে বললেন, “সে কী, উসমানের হত্যাকারীগণ তো আপনার সাথেই আছে।” তারপর মুঘিরা মারওয়ানের দিকে ফিরে তার গন্তব্যস্থল জানতে চাইলেন । উত্তরে মারওয়ান বললো, “উসমানের রক্তের বদলা নিতে আমিও বসরা যাচ্ছি।” মুঘিরা বললেন, “উসমানের খুনিরা তো তোমার সাথেই রয়েছে—এ তালহা ও জুবায়ার তাকে হত্যা করেছে।” প্রকৃতপক্ষে যে দলটি উসমানকে হত্যা করেছিল এবং হত্যার সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত ছিল তারা উসমান হত্যার দোষ আমিরুল মোমেনিনের ওপর চাপিয়ে দিয়ে বসরা চলে গিয়েছিল এবং সেখানে ফেতনা সৃষ্টি করেছিল। আমিরুল মোমেনিনও বিদ্রোহ দমনের জন্য বসরা পৌছলেন। পথিমধ্যে উক্ত পত্রে কুফাবাসীদের সমর্থন চাইলেন। পত্র পাওয়া মাত্র কুফার যোদ্ধাগণ আমিরুল মোমেনিনের সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। এ যুদ্ধ ‘জামালের যুদ্ধ’ নামে খ্যাত।