আল্লাহ সর্বজ্ঞাতা সম্পর্কে
গভীর অরণ্যে পশুর চিৎকার, নির্জনবাসীর পাপ, গভীর সমুদ্রে মাছের চলাফেরা, বিক্ষুব্ধ বাতাসে পানির উচ্ছাস— এসব কিছু আল্লাহ জানেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মদ আল্লাহর মনোনীত, তার প্রত্যাদেশের বাহক এবং তার করুণার বাণীবাহক। আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি। সেই আল্লাহকে ভয় করার জন্য যিনি তোমাদেরকে প্রথম সৃষ্টি করেছেন, যার কাছে তোমাদের প্রত্যাবর্তন, যার হাতে তোমাদের লক্ষ্যসমূহের সফলতা, যাকে পাবার জন্য তোমাদের সকল আকাঙ্খা নিঃশেষিত, যার দিকে তোমাদের সিরাতুল মোস্তাকিন এবং যিনি (প্রতিরক্ষা প্রার্থনার জন্য) তোমাদের ভয়ের লক্ষ্য। নিশ্চয়ই, শারীরিক রোগের চিকিৎসা, তোমাদের বক্ষে লুক্কায়িত পাপের বিশোধক, তোমাদের হৃদয়কে দূষণমুক্ত করার পরিশোধক, তোমাদের চোখের আচ্ছন্নতার জন্য আলো, তোমাদের হৃদয়ে ভয়ের জন্য সাস্তুনা এবং তোমাদের অজ্ঞতার অন্ধকারের জন্য উজ্জ্বলতা। সুতরাং আল্লাহর আনুগত্যকে জীবনের পথ হিসাবে গ্রহণ করো ।
এ আনুগত্য শুধু বাহ্যিকভাবে নয়—তোমাদের বা তেনকেও এই আনুগত্যের দিকে পরিচালিত করো। এই আনুগত্যকে রুটিন কাজের পরিবর্তে বাতেনি অভ্যাসে পরিণত করো। এটাকে অন্তরের অন্তঃস্থলে বদ্ধমূল করো, সকল কর্মকান্ডে দেশনা হিসাবে গ্রহণ করো, বিচার দিনে জলাধার হিসাবে মনে করো। তোমাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য এটা মধ্যস্থতাকারী। এটা তোমাদের ভয়ের দিনের (হাশর) আশ্রয়স্থল, কবরের অন্ধকারে বাতি, দীর্ঘ একাকীত্বের সময়ের সাথি এবং চির আবাসস্থলের বিপদে রক্ষী। নিশ্চয়ই, আল্লাহর আনুগত্য চতুর্দিক থেকে আগত দুর্যোগের বিরুদ্ধে ও জলন্ত আগুনের শিখার বিরুদ্ধে একটা প্রতিরক্ষা ।
সুতরাং যে কেউ আল্লাহর ভয়কে আয়ত্ত্বাধীন করে; বিপদাপদ তার কাছে এসেও দূরে সরে যায়, তার কর্মকান্ড তিক্ততার পর মধুর হয়ে পড়ে, বিপদের ঢল তার ওপর পড়তে এসে থেমে যায়, অসুবিধা সংঘটিত হবার পর তার কাছে সহজ হয়ে যায়, দুর্ভিক্ষ কবলিত হবার পর তার ওপর দ্রুত নেয়ামত বর্ষিত হয়, আশা হারিয়ে ফেলার পর তার ওপর দয়া ও আনুকূল্যের ঝরনাধারা প্রবাহিত হয়, হতাশ হবার পর তার ওপর বৃষ্টির মতো আশীৰ্বাদ নেমে আসে। সুতরাং আল্লাহকে ভয় কর যিনি তাঁর সন্দোপদেশ দ্বারা তোমাদের উপকার করেন, যিনি তাঁর রাসুলের মাধ্যমে তোমাদের শিক্ষা দেন এবং তাঁর আনুকূল্য দ্বারা তোমাদেরকে কৃতাৰ্থ করেন। তাঁর ইবাদতে নিজেকে মশগুল কর এবং তাঁকে মান্য না করার অপরাধ থেকে নিজেদেরকে মুক্ত কর। ইসলাম সম্বন্ধে এ ইসলাম এমন এক দ্বিন যা আল্লাহ নিজের জন্য মনোনীত করেছেন, তার চোখের সম্মুখে এটাকে উন্নত করেছেন, তাঁর সৃষ্টির মধ্যে এটাকে সর্বোৎকৃষ্ট করেছেন এবং তাঁর প্রেমের ওপর এর স্তম্ভ প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ইসলামকে সম্মান প্ৰদান করে অন্য ধর্মকে তিনি মর্যাদাহীন করেছেন। ইসলামের মহত্ত্বের কাছে তিনি সকল সম্প্রদায়কে অবমানিত করেছেন। তিনি তার করুণা দ্বারা ইসলামের শক্রকে হীন করেছেন এবং তার সমর্থন দ্বারা এর বিরুদ্ধবাদীকে একাকী করেছেন। ইসলামের স্তম্ভ দ্বারা তিনি গোমরাহির ভিত্তি বিচূর্ণ করেছেন। ইসলামের জলাধার থেকে তৃষ্ণার্তের তৃষ্ণা নিবারণের ব্যবস্থা করেছেন এবং তাদের দ্বারা সেই জলাধার পূর্ণ করিয়েছেন যারা পানি নিয়েছে।
তিনি ইসলামকে এমনভাবে তৈরি করেছেন যে, এর মৌলিক অংশ ভঙ্গ করা যায় না, এর জোড়াসমূহ পৃথক করা যায় না, এর নির্মাণ কখনো পতিত হয় না, এর স্তম্ভ কখনো বিনষ্ট হয় না, এর গাছের কখনো মূলোৎপাটন করা যায় না, এর সময় কখনো শেষ হয় না, এর বিধি-বিধান কখনো অতীত হয় না, এর একটি ক্ষুদ্র ডালও কাটা যায় না, এর কোন অংশ। কখনো সংকীর্ণ হয় না; এর সহজ-সরলতা কখনো কষ্টকর অবস্থায় রূপান্তরিত হয় না, এর ব্যাখ্যা কখনো অজ্ঞতার অন্ধকার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয় না, এর সোজা পথ কখনো বক্র হয় না, এর কাঠে কোন বক্রতা নেই, এর বিশাল পথে কোন সংকীর্ণতা নেই, এর বাতি কখনো নিভে না এবং এর মধুরতায় কোন তিক্ততা নেই।
এটা এমন এক স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত, মহিমান্বিত আল্লাহ সত্যবাদিতাকে যার ভিত্তি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ এর ভিত্তিকে মজবুত করে দিয়েছেন এবং এমন উৎস থেকে একে প্রবাহিত করেছেন যার স্রোতধারা চিরদিন জলপূর্ণ থাকে। তিনি একে এমন এক প্ৰদীপ করেছেন যার আলো চির দেদীপ্যমান এবং এ আলোক-বর্তিকা থেকে ভ্ৰমণকারীগণ চিরদিন পথের দেশনা (হেদায়েত) পাবে। এর নির্দশনগুলো এমন যার মাধ্যমে এর রাজপথের দিশা পাওয়া যায় এবং জলাধারের দিক নির্দেশনা পাওয়া যায়। মহিমান্বিত আল্লাহ ইসলামে তাঁর সর্বোচ্চ সন্তোষ বিধান করেছেন। এটা তাঁর স্তম্ভের সর্বোচ্চ চূড়া এবং তাঁর আনুগত্যের সর্বোচ্চ ব্যবস্থা। সুতরাং আল্লাহর কাছে ইসলামের স্তম্ভ মজবুত, এর নির্মাণ সুউচ্চ, এর প্রমাণ জলন্ত, এর আগুন শিখাপূর্ণ, এর কৃতিত্ব শক্তিশালী, এর আলোকবর্তিকা উচ্চ এবং এর ধ্বংস দুঃসাধ্য। কাজেই ইসলামের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, ইসলামকে অনুসরণ করা, এর প্রতি দায়িত্ব পরিপূর্ণ করা এবং যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়া তোমাদের একান্ত উচিত।
রাসুল (সঃ) সম্পর্কে
তারপর মহিমান্বিত আল্লাহ মুহাম্মদকে (সঃ) এমন এক সময় সত্যসহ প্রেরণ করলেন যখন পৃথিবীর
ধ্বংস নিকটবতী হয়ে গিয়েছিল এবং পরকাল হাতের কাছে এসে পড়েছিল; যখন পৃথিবীর ঔজ্জ্বল্য গাঢ়
অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিলো, পৃথিবী এর অধিবাসীদের জন্য বিপদ সন্ধুল হয়ে পড়েছিল, এর উপরিভাগ রুক্ষ ও কঠিন হয়ে পড়েছিল এবং এর ধ্বংস নিকটবতী হয়ে পড়েছিল। এটা ছিল পৃথিবীর জীবনকাল শেষে ধ্বংসের চিহ্ন উপস্থিতির সময়, পৃথিবীর অধিবাসীগণের নির্মুল হবার সময়, এর বন্ধন ছিন্ন হবার সময়, এর কর্মকান্ড পরিত্যাগের সময়, এর হেদায়েতের চিহ্নসমূহ নিশ্চিহ্ন হবার সময়, এর গোপন তথ্য ফাঁস করার সময় এবং এর দৈর্ঘ্য কমিয়ে আনার সময়। এ সময় তার বাণী পৌছে দেয়ার জন্য আল্লাহ রাসুলকে (সঃ) দায়িত্ব অর্পণ করলেন এবং এটা তার জনগণের জন্য সম্মানের পথ হয়ে গেল। তাঁর সময়কার মানুষের জন্য এটা প্রস্ফুটন কাল হয়ে গেল; তাঁর সমর্থকদের জন্য মর্যাদার উৎস এবং তার সাহায্যকারীদের জন্য হয়ে গেল মহাসম্মান ।
পবিত্র কুরআন সম্পর্কে
তারপর আল্লাহ আলোকবর্তিকা স্বরূপ তাঁর কাছে কিতাব নাজেল করেন যার শিখা কখনো নির্বাপিত হয় না এবং যার ঔজ্জ্বল্য কখনো কমে না। এটা এমন এক সমুদ্র যার গভীরতা নির্ণয় করা যায় না, এমন এক পথ যা অনুসরণ করলে কখনো গোমরাহ হয় না, এমন এক রশ্মি যা কখনো স্নান হয় না, (ভাল ও মন্দ নির্ণয়ে) এমন এক যুক্তি যা কখনো দুর্বল হয় না, এমন এক ব্যাখ্যাকারক যার ভিত্তি বিনষ্ট হয় না, এমন এক চিকিৎসা যাতে রোগের আর ভয় থাকে না, এমন এক সম্মান যার সমর্থক কখনো পরাজিত হয় না এবং এমন এক সত্য যার সাহায্যকারী কখনো পরিত্যক্ত হয় না। সুতরাং এটা ইমানের খনি ও কেন্দ্ৰবিন্দু, জ্ঞানের উৎস ও সমুদ্র, ন্যায় বিচারের বাগান ও জলাধার, ইসলামের ভিত্তিপ্রস্তর ও ইমারত, সত্যের উপত্যকা ও সমতল ভূমি এবং এ সমুদ্র হতে পানি নিয়ে নিঃশেষ করা যায় না। এ ঝর্ণার পানি নিয়ে এটাকে শুকানো যায় না, এ জলাধার কেউ নিঃশেষ করতে পারে না, এ পথের পথিক কখনো দিকভ্ৰান্ত হয় না, এ পথে পদচারী নিদর্শন দেখতে ব্যর্থ হয় না এবং এ উচুস্থানে অবস্থানকারী কখনো ডুবে যায় না।
আল্লাহ্ কুরআনকে এমন করে দিয়েছেন যা জ্ঞানপিপাসুর তৃষ্ণা নিবারক, ফেকাহ্বিদদের হৃদয়ের জন্য সৌন্দর্য বিকাশ এবং ন্যায়পরায়ণদের জন্য রাজপথ । এটা এমন চিকিৎসা যারপর আর রোগ থাকে না, এমন দু্যতি যাতে আর অন্ধকার থাকে না, এমন রশি যা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে, এমন দুর্গ যার চূড়া ধ্বসে পড়ে না। এটা তার জন্য মহাসম্মান যে এটাকে ভালোবাসে, তার জন্য শান্তি যে এতে প্রবেশ করে, তার জন্য হেদায়েত যে এটাকে অনুসরণ করে, তার জন্য ক্ষমা যে এটাকে গ্রহণ করে, তার জন্য যুক্তি যে যুক্তিবাদী, তার জন্য সাক্ষী যে এর সাথে বিবাদ করে, তার জন্য কৃতকার্যতা যে এর সাহায্যে যুক্তি দেখায়, তার জন্য বাহন যে এটা বহন করে, তার জন্য পরিবহণ যে এটা আমল করে, তার জন্য নিদর্শন যে পথ অনুসন্ধান করে, তার জন্য বর্ম যে নিজকে গোমরাহি থেকে রক্ষা করতে চায়, তার জন্য জ্ঞান যে মনোযোগ দিয়ে শোনে, তার জন্য একটা সুন্দর কাহিনী যে বর্ণনা করে এবং তার জন্য চূড়ান্ত রায় যে বিচার করে ।