রাসুলের (সঃ) প্রতি আমিরুল মোমেনিনের অনুরাগ সম্পর্কে
মুহাম্মদের (সঃ) সাহাবাগণের মধ্যে যারা আল্লাহর বাণীর সংরক্ষক তারা সকলেই জানে যে, আমি কখনো আল্লাহ ও তার রাসুলের অবাধ্য হই নি। আল্লাহ আমাকে যে সাহস দিয়ে সম্মানিত করেছেন তদ্বারা জীবন বাজি রেখেও আমি তাকে সহায়তা করেছি এবং তাঁর দুর্যোগের মুহুর্তে আমি তাঁর পাশে ছিলাম যখন বিরুদ্ধবাদীদের বড় বড় সাহসী বীরেরাও পিছিয়ে গেছে— একপা এগুতে সাহস পায় নি।
রাসুলের (সঃ) ইনতিকালের সময় তাঁর পবিত্র মাথা আমার বুকে ছিল এবং তাঁর পবিত্র নিশ্বাস আমার হাতের তালুতে লেগেছিল এবং আমি তা আমার মুখমন্ডলে লাগিয়েছিলাম। আমি তাকে শেষ গোসল করিয়েছিলাম এবং একাজে ফেরেশতাগণ আমাকে সাহায্য করেছিল। তার ঘর ও আঙ্গিনা ফেরেশতায় পরিপূর্ণ ছিল। তাদের একদল উপরের দিকে অন্যদল নিচের দিকে আসা-যাওয়া করছিলো। তাদের কলগুঞ্জন আমি নিজ কানে শুনেছি। রাসুলকে (সঃ) কবরে শায়িত করা পর্যন্ত তারা শুধু দরূদ ও সালাম পেশ করেছিল । এভাবে তার জীবৎকাল ও ইনতিকালের পর তার সাথে আমার চেয়ে অধিক সম্পর্ক ও অধিকার আর কার আছে? সুতরাং তোমাদের বিবেক বুদ্ধি খাটাও এবং তোমাদের শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করতে তোমাদের নিয়্যত পরিশুদ্ধ করা। কারণ আমি সেই আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, যিনি ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই, আমি সত্যের পথে আছি এবং তারা (শত্রুগণ) ভ্ৰান্তি পথে ও তারা বিপথগামী। আমি যা বলি তা তোমরা শোন; আমি নিজের জন্য ও তোমাদের জন্য আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করি ।
১। “আমি কখনো রাসূলের (সঃ) কোন আদেশ অমান্য করি নি”—আমিরুল মোমেনিনের এ উক্তিটি ছিল তাদের প্রতি বিদ্রুপবাণ যারা রাসুলের আদেশ অমান্য করতে লজ্জাবোধ করে নি। কখনো কখনো এমনও হয়েছে যে, রাসুলকে পরীক্ষা করতেও তারা লজ্জা অনুভব করে নি। উদাহরণ স্বরূপ, হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় যখন রাসুল (সঃ) কুরাইশ মোশরেকদের সাথে আলাপ-আলোচনা করার জন্য রাজি হয়েছিলেন তখন একজন সাহাবি এত ক্ষেপে গিয়েছিল যে, সে রাসুলের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক শুরু করে দিয়েছিল এবং “আপনি কি আল্লাহর নবি নন।” জিজ্ঞেস করে নবুয়তের ওপর সংশয় প্রকাশ করতে দ্বিধা করে নি। তার এহেন কথায় আবু বকর বলেছিলেনঃ “তোমার ওপর ল্যানত! তার সাথে তর্ক করো না। তার কথা শোন। নিশ্চয়ই তিনি আল্লাহর রাসুল এবং
আল্লাহ তাকে ধ্বংস করবেন না” (হাদীদ ***, ১০ম খন্ড, পৃঃ ১৮০-১৮৩)। মোমিন হতে হলে ইমানের শর্ত হলো— ইমান হবে সংশয়হীন ও সম্পূর্ণ সন্দেহমুক্ত। সংশয় বা সন্দেহযুক্ত হলে ইমান ত্রুটিযুক্ত হয়ে পড়ে। ইমানের শর্ত সম্পর্কে আল্লাহ বলেনঃ তারাই মোমিন যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ইমান আনার পর কোন সন্দেহ পোষণ করে না (কুরআন-৪৯ ? ১৫) | রাসুল (সঃ) যখন উবাই ইবনে সলুলের জানাজা পড়তে মনস্থ করেছিলেন তখন এই একই সাহাবি বলেছিল, “কিভাবে আপনি মোনাফিক সর্দারের ক্ষমার জন্য প্রার্থনা করতে মনস্থ করেন।” এমনকি রাসুলের শার্ট ধরে সে তাকে টেনে ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা করেছিল। এ অবস্থায় রাসুলকে বলতে হয়েছিল, “আল্লাহর আদেশ ছাড়া আমি কোন কাজ করি না।” একইভাবে উসামা ইবনের জায়েদের নেতৃত্বে প্রেরিত বাহিনীতে যোগদান করার জন্য রাসুলের আদেশ উপেক্ষা করা হয়েছিল। এ সমস্ত ঘটনার মধ্যে সবচাইতে বড় ধৃষ্টতা দেখানো হয়েছিল যখন রাসুল (সঃ) মৃত্যু-শয্যায় থাকাকালে তাঁর উপদেশ লেখিয়ে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তখন রাসুলকে (সঃ) এমনভাবে দোষারোপ করা হয়েছিল, শরিয়তের দৃষ্টিতে তাতে ইমানের অনুপস্থিতিই প্রমাণিত হয়। তখন এই একই সাহাবি যেসব কথা বলেছিল তাতে বুঝা যায় তার সন্দেহ ছিল যে, রাসুলের এসব আদেশ আল্লাহর প্রত্যাদেশের ওপর ভিত্তি করে নাকি তার মানসিক গোলযোগের (নাউজুবিল্লাহ) কারণে করা হয়েছিলো (সহীহ বুখারী-বাংলা অনুবাদ, হাদিস নং ১১২) । ২। একথা অস্বীকার করার কোন জো নেই যে, শের-ই খোদা আলী ইবনে আবি তালিব প্রতিটি বিপদ সধ্বংস্কুল সময়ে রাসুলকে (সঃ) বর্মের মতো ঘিরে রেখেছিলেন এবং আল্লাহ প্রদত্ত শক্তি ও সাহস দ্বারা তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। প্রথমেই তিনি নিজের জীবনকে বাজি রেখেছিলেন যখন কুরাইশ কাফেরগণ রাসুলকে হত্যা করার জন্য তার ঘর ঘেরাও করে রেখেছিল এবং আলী তার বিছানায় শুয়ে ছিলেন যাতে তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। এরপর সেসব যুদ্ধে যেখানে শত্রুরা রাসুলকে (সঃ) আঘাত হানার চেষ্টা করেছিল সেখানে আলী আরবের নামকরা বীরদের পা স্থির রাখতে দেন নি। প্রতিটি যুদ্ধেই আমিরুল মোমেনিন ইসলামের ঝান্ডা হাতে নিয়ে দৃঢ়ভাবে থাকতেন। বর্ণিত আছে যে— ইবনে আব্বাস বলেছেন, আলীর চারটি গুণ ছিল যা অন্য আর কারো ছিল না / প্রথমত আরব ও অনারীবের মধ্যে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যে আল্লাহর রাসুলের সাথে সালাত করেছে । দ্বিতীয়ত প্রত্যেক যুদ্ধেই তার হাতে ইসলামের বাভা থাকতো । তৃতীয়ত যখন লোকেরা রাসুলের কাছে থেকে দৌড়ে পালিয়ে যেতো তখনো আলী তাঁর পাশেই থাকতেন । চুতীৰ্থত আলীই রাসুলকে শেষ গোসল করিয়েছিলেন এবং তিনিই রাসুলকে কবরে শায়িত করেছিলেন (বায়’, ৩য় খন্ড, পৃঃ ১০৯০: নায়সাবুরী’,৩য় খন্ড, পৃঃ ১১১) / রাসুলের (সঃ) জীবৎকালে ইসলামের সকল জিহাদ পর্যালোচনা করলে এতে কোন সন্দেহ থাকে না যে, তাবুকের যুদ্ধ ব্যতীত অন্য সকল যুদ্ধে আলী যুদ্ধ করেছিলেন এবং তাঁর শক্তিমত্তা ও বুদ্ধির কারণে প্রতিটি যুদ্ধে কৃতকার্যতা এসেছিল। বদরের যুদ্ধে নিহত সত্তরজন কাফেরের মধ্যে অর্ধেক আলীর তরবারিতে নিহত হয়েছিল। অহুদের যুদ্ধে যখন মুসলিমগণ গণিমত সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো তখন তাদের জয় পরাজয়ে পরিণত হয়েছিল। শত্রুর আচমকা আক্রমণে তারা পালিয়ে গেল। তখনো আলী জিহাদকে দ্বিনের দায়িত্ব হিসাবে গ্রহণ করে নিৰ্ভিকভাবে যুদ্ধ করে রাসুলের (সঃ) প্ররক্ষা বিধান করেছিলেন। তাঁর এ কাজের প্রশধ্বংসা রাসুল (সঃ) ও ফেরেশতাগণ করেছিলেন। খন্দকের যুদ্ধে রাসুলের পক্ষের তিন হাজার যোদ্ধার কেউ আমর ইবনে আবদাওয়াদের মুখোমুখি হতে সাহস করে নি। অবশেষে আমিরুল মোমেনিন তাকে সম্মুখ সমরে নিহত করে গ্রানিকর অবস্থা থেকে মুসলিমদের রক্ষা করেছিলেন। হুনায়েনের যুদ্ধে মুসলিমগণ তাদের সসংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য গর্বিত ছিল; এ যুদ্ধে তারা ছিল সসংখ্যায় দশ হাজার আর শত্রু ছিল চার হাজার। কিন্তু এ যুদ্ধেও তারা গণিমত সংগ্রহে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। ফলে সুযোগ বুঝে শক্ৰ তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। শত্রুর হঠাৎ আক্রমণে মুসলিমগণ হতবুদ্ধি ও দিশেহারা হয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহ তোমাদেরকে তো বহুক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন এবং হুনায়েনের দিনেও যখন তোমরা তোমাদের সসংখ্যাধিক্যের জন্য উৎফুল্ল ছিলে; কিন্তু এই সসংখ্যাধিক্য তোমাদের কোন কাজে আসে নি এবং বিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবী তোমাদের জন্য সঙ্কুচিত হয়েছিল ও পরে তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পালিয়ে গিয়েছিলে (কুরআন-৯ ? ২৫) | এ যুদ্ধেও আমিরুল মোমেনিন পর্বতের মতো দৃঢ় থেকে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করে বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেনঃ এরপর আল্লাহ তাঁর রাসুল ও মোমিনগণের ওপর প্রশাক্তি বর্ষণ করেন এবং এমন এক সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন যা তোমরা দেখা নি…… (কুরআন-৯ ? ২৬) ||