গিবত সম্পর্কে যারা পাপ করে না এবং পাপ থেকে যাদেরকে নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে তাদের উচিত পাপী ও অবাধ্যগণের প্রতি করুণা প্রকাশ করা। কৃতজ্ঞতাই তাদের সবচেয়ে বড় পরিতৃপ্তি হওয়া উচিত এবং তা তাদেরকে অন্যের দোষ অন্বেষণ করা থেকে রক্ষা করবে। গিবতকারীর অবস্থা কী, যে তার ভাইকে দোষারোপ করে এবং তার দোষ খুঁজে বেড়ায়? সে কি ভুলে গেছে যে, আল্লাহ তার পাপ গোপন করে রেখেছেন যা তার ভাইয়ের পাপ থেকেও গুরুতর? যেখানে সে নিজেই পাপে লিপ্ত সেখানে সে কী করে অন্যকে পাপের জন্য নিন্দা করবে? যদি সে অন্যের সমান পাপ নাও করে থাকে। তবুও সে যে বড় ধরনের পাপ করে নি তার নিশ্চয়তা কোথায়? আল্লাহর কসম, যদি সে কবিরা গুনাহ না করে সগিরা গুনাহও করে থাকে। তবুও অন্যের গুনাহ চর্চা করে সে কবিরা গুনাহাঁই করেছে। হে আল্লাহর বান্দাগণ, তোমরা অন্যের পাপ-চর্চায় তাড়াহুড়া করো না, কারণ সে হয়তো এর জন্য ক্ষমা পেয়ে যেতে পারে এবং তোমার নিজের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পাপের জন্যও নিজেকে নিরাপদ মনে করো না, কারণ তোমাকে হয়ত তার জন্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে কেউ অন্যের দোষ জানতে পারলে তা প্রকাশ করা উচিত নয়, কারণ তার চিন্তা করা উচিত সে নিজের দোষ কতটুকুই বা জানে। তদুপরি তার উচিত শুকরিয়া আদায় করা এ জন্য যে তাকে এমন পাপ থেকে রক্ষা করা হয়েছে।
১। অন্যের ছিদ্রান্বেষণ ও গিবত এমনভাবে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে যে, মানুষ এর কুফল বেমালুম ভুলে আছে। বর্তমানে অবস্থা এমন হয়েছে যে, বড় ও ছোট, সংক্রান্ত ও নিচ কেউ এ দোষ থেকে মুক্ত নয়। মিম্বারের উচ্চ মর্যাদা বা মসজিদের পবিত্রতা কোন কিছুই এ দোষ নিবৃত্ত করতে পারছে না। কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব একত্রে বসলেই তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায় অতিরঞ্জিত করে অন্যের দোষ বের করে কুৎসা রটানো। ছিদ্রান্বেষী লোকের শত দোষ থাকলেও সে নিজের দোষ প্রকাশ হোক এটা কখনো চায় না, কিন্তু সে অন্যের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়ায় এবং রসিয়ে রসিয়ে তা প্রকাশ করে। নিজের জন্য যেমন অন্যের জন্যও ঠিক তেমন অনুভূতি থাকা উচিত। অন্যের অনুভূতিতে আঘাত করে কারো কিছু করা উচিত নয়। এ প্রবাদ সকলেরই মেনে চলা উচিত যে, “তুমি অন্যের কাছ থেকে যা আশা কর না, অন্যের প্রতিও তুমি তা করো না।” গিবতের সংজ্ঞা হলো, কথায় হোক আর কর্মেই হোক মানহানি করার উদ্দেশ্যে কারো দোষ প্রকাশ করা যা তার দুঃখের কারণ হয়ে দাড়ায়। কেউ কেউ বলেন, গিবত হবে তা যা মিথ্যামিথ্যি ও সত্যের বিপরীতভাবে প্রকাশ করা হয়। তাদের মতে যা দেখেছে বা শুনেছে তা অবিকল প্রকাশ করা গিবত নয়। তারা বলে তারা তো যা দেখেছে বা শুনেছে তাই প্রকাশ করেছে— এতে গিবত হবে কেন? বস্তৃত এহেন বাস্তব ঘটনা বর্ণনা করার নামই হলো গিবত কারণ ঘটনাটি যদি তথ্যগতভাবে মিথ্যা হতো। তবে তা হতো কাউকে মিথ্যা দোষারোপ করা—গিবত নয়। বর্ণিত আছে যে, রাসুল (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা কি জান গিবত কী?” লোকেরা বললো, “আল্লাহ ও তাঁর রাসুলাই ভালো জানেন । ” তারপর তিনি বললেন, “তোমরা তোমাদের ভাইদের সম্বন্ধে কিছু বললে যদি সে ব্যথিত হয়— উহাই গিবত” কেউ একজন বললো, “যদি আমি তার সম্বন্ধে যা বলি তা প্রকৃত । পক্ষেই সত্য হয় তাহলে কী হবে?” রাসুল (সঃ) জবাব দিলেন, “গিবত হবে তখনই যখন তথ্যগতভাবে উহা সত্য হয় । অন্যথায় উহা মিথ্যা অপবাদ হবে ।” গিবত নানা কারণে হয়ে থাকে; সে জন্য মানুষ কখনো জ্ঞাতসারে আবার কখনো অজ্ঞাতসারে গিবতে জড়িয়ে পড়ে। আবু হামিদ আল-গাজ্জালী তার গ্রন্থ “এহ্হিয়া উলুমদীন”-এ গিবতের বিস্তারিত কারণ উল্লেখ করেছেন; যার প্রধান প্রধানগুলো নিম্নরূপ ঃ ১. কারো সম্বন্ধে কৌতুক করা বা কারো মানহানি করার জন্য; ২. মানুষকে হাসাবার জন্য এবং নিজের হাস্য-রসিকতা ও প্রাণ-চাঞ্চল্য প্রকাশ করার জন্য;
ক্রোধের বশবতী হয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশের জন্য; অন্যের বদনাম করে নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করার জন্য; কোন বিষয়ে নিজের সংশ্লিষ্টতা ঢেকে রাখার জন্য, যেমন-কোন অপরাধ অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়া; কোন দলের সাথে জড়িত থেকেও তা ধামাচাপা দেয়ার জন্য; কোন লোককে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য যার কাছ থেকে নিজের দোষ প্রকাশিত হয়ে পড়ার ভয় থাকে;
প্রতিযোগীকে পরাভূত করার জন্য; }
ক্ষমতাসীন কারো কাছে নিজের স্থান করে নেয়ার জন্য; অমুক ব্যক্তি অমুক পাপে লিপ্ত হয়েছে- এরূপ কথা বলে দুঃখ প্রকাশ করা জন্য; বিস্ময় প্রকাশ করার জন্য, যেমন- অমুক ব্যক্তি এ কাজ করেছে; কোন কাজে ক্ৰোধ প্রকাশ করে কাজটি যে করেছে তার নাম প্রকাশ করার জন্য। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে ছিদ্রান্বেষণ বা সমালোচনা গিবত হয় না, যেমন(১) অত্যাচার থেকে নিস্কৃতি পাবার জন্য মজলুম জালেমের বিরুদ্ধে নালিশ করলে গিবত হয় না,
যেমন- আল্লাহ বলেন, মন্দ কথার প্রচারণা আল্লাহ পছন্দ করেন না; তবে যার ওপর জুলুম। করা হয়েছে তার কথা স্বতন্ত্র (কুরআন-৪৪১৪৮) (২) অন্যকে উপদেশ দেয়ার জন্য কারো দোষ উদাহরণ হিসাবে প্রকাশ করলে গিবত হয় না; (৩) দ্বিনের অনুশাসন বলবৎ করার জন্য কারো বিশেষ দোষ প্রকাশ করলে গিবত হয় না; (৪) কোন মুসলিমকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আত্মসাৎ ও অসাধুতার কথা প্রকাশ করলে গিবত হয় না;
(৫) এমন কারো কাছে দোষ প্রকাশ করা যিনি বাধা দিয়ে দোষ করা থেকে রক্ষা করতে পারবেন; (৬) হাদিসের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য হাদিস বর্ণনাকারীর সমালোচনা ও ত্রুটি-বিচূতি প্রকাশ
করলে গিবত হয় না; (৭) কারো শারীরিক সীমাবদ্ধতা (যেমন-বোবা, অন্ধ, কালা, হাতবিহীন) ব্যক্তিত্ব ব্যাখ্যার জন্য প্রকাশ করা গিবত নয়:
(৮) – চিকিৎসকের নিকট চিকিৎসার জন্য দোষ প্রকাশ করা গিবত নয়; (৯) কেউ মিথ্যা বংশ পরিচয় দিলে তার সঠিক বংশ পরিচয় প্রকাশ করলে গিবত হয় না; (১০) কারো জীবন, সম্পদ ও মর্যাদা রক্ষা করার জন্য তার দোষ প্রকাশ করলে গিবত হয় না; (১১) যদি দুব্যক্তি কারো দোষ আলোচনা করে যা উভয়েরই জানা আছে। তবে তা গিবত হয় না; (১২) যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে কুকর্ম করে তার আচরণ প্রকাশ করলে গিবত হয় না; যেমন হাদিসে আছে; “যে লজ্জার ঘোমটা ছিড়ে ফেলেছে তার বেলায় গিবত নেই।”