সকল কিছু আল্লাহর অনুগত এবং সকল কিছুই তাঁর দ্বারা অস্তিত্ববান। তিনি দরিদ্রের সন্তুষ্টি, নিচএর মর্যাদা, দুর্বলের শক্তি এবং মজলুমের আশ্রয়স্থল। যে কেউ কথা বলে তিনি শোনেন এবং যে নিশ্চচাপ থাকে তিনি তার গুপ্ত বিষয় জানেন। জীবিত সব কিছুর জীবিকা তার হাতে এবং মৃত্যুর পর সকলেই তার কাছে প্রত্যাবর্তন করে।
হে আল্লাহ! চোখ তোমাকে দেখে নি যাতে তোমার সম্বন্ধে অবহিত হওয়া যায়, কিন্তু তোমার সৃষ্টির বর্ণনাকারীদের পূর্বেও তুমি বিদ্যমান ছিলো। তুমি তোমার নিঃসঙ্গতার কারণে মাখলুক সৃষ্টি কর নি এবং কোন লাভের আশায় তাদেরকে কর্ম সম্পাদনের ক্ষমতা দাও নি। যাকে তুমি ধর সে একটুও এগুতে পারে না, আর যাকে তুমি আটকে ফেলো সে কিছুতেই পালাতে পারে না। কেউ তোমাকে অমান্য করলে তোমার কর্তৃত্ব একটুও খর্ব হয় না এবং কেউ তোমার অনুগত হলে তোমার শক্তি একটুও বৃদ্ধি পায় না। কেউ তোমার বিচারে সংক্ষুব্ধ হলে তা ফিরিয়ে দিতে পারে না এবং কেউ তোমার আদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও তোমাকে ছাড়া চলতে পারে না। প্রতিটি গুপ্ত বিষয় তোমার কাছে উন্মুক্ত এবং তোমার জন্য প্রত্যেক অনুপস্থিতই উপস্থিত। তুমি চিরন্তন, তোমার কোন অন্ত নেই। তুমিই সর্বোচ্চ লক্ষ্য এবং তোমার আয়ত্ত থেকে কোন নিস্কৃতি নেই। তুমিই প্রতিশ্রুত প্রত্যাবর্তন স্থল এবং তোমার দিকে যাওয়া ব্যতীত কোন নিস্তার নেই। বান্দার চূর্ণকুন্তল তোমার হাতের মুঠোয় এবং প্রতিটি জীবিত সত্তার প্রত্যাবর্তন তোমারই কাছে। সকল গৌরব তোমার। তোমার সৃষ্টির যা কিছু আমরা দেখি তা কত বিশাল, কিন্তু এ বিশালত্ব তোমার কুদরতের কাছে কতই না ক্ষুদ্র। তোমার রাজ্য, যা আমরা লক্ষ্য করি, কত বিস্ময়কর কিন্তু তোমার কর্তৃত্বের যেটুকু আমাদের কাছে গুপ্ত তার তুলনায় কত নগণ্য। এ পৃথিবীতে তোমার নেয়ামত কত ব্যাপক কিন্তু আখেরাতের নেয়ামতের তুলনায় তা কত তুচ্ছ।
ফেরেশতা সম্পর্কে
হে আল্লাহ, তুমি ফেরেশতাদেরকে তোমার আসমানে বসত করার ব্যবস্থা করেছে এবং তোমার পৃথিবীর অনেক উর্ধে তাদেরকে স্থাপন করেছো। তোমার সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞান তাদেরই আছে এবং তোমার সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে তারাই তোমাকে সর্বাপেক্ষা বেশি ভয় করে এবং তারাই তোমার সর্বাপেক্ষা নিকটবতীর্ণ। তারা কখনো কারো ঔরসে বা কারো গর্ভাশয়ে ছিল না এবং তাদেরকে নাপাক পানি থেকে সৃষ্টি করা হয় নি। সময়ের উত্থান-পতনের কারণে তারা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে নি। তারা তোমার থেকে আলাদা তাদের নির্দিষ্ট স্থানে এবং তাদের নির্দিষ্ট মর্যাদায় তোমার নিকটে অবস্থান করে। তাদের সকল আকাঙখা তোমাকে কেন্দ্র করে। তারা অত্যধিক পরিমাণে তোমার ইবাদত করে । তোমার আদেশের প্রতি তাদের কোন গাফলতি নেই। যদি তারা দেখে যে, তোমার সম্পর্কে কিছু সংগুপ্ত রয়ে গেছে। তবে তারা মনে করে তাদের আমল কম হয়েছে এবং তখন তারা আত্মসমালোচনা করে এবং অনুধাবন করতে পারে যে, যতটুকু ইবাদত তোমার প্রাপ্য ছিল ততটুকু তারা করে নি। অথবা তোমাকে যতটুকু মান্য করা উচিত ছিল ততটুকু তারা করে নি।
আল্লাহর নেয়ামত ও অকৃতজ্ঞ সম্পর্কে
তুমি মহিমান্বিত, তুমি স্রষ্টা, তুমি উপাস্য তোমার বান্দাদের প্রতি সুবিচারের কারণে। তুমি বেহেশত সৃষ্টি করে তাতে তৃপ্তিদায়ক উপভোগ্য বস্তু, পানীয়, খাদ্য, সুদর্শন সঙ্গিনী বা সঙ্গী, চাকর-চাকরানি, মনোরম স্থান, স্রোতস্বিনী, বাগান ও ফল দিয়েছে। তারপর তুমি তোমার বার্তাবাহক প্রেরণ করেছে। বেহেশতের দিকে আমন্ত্রণ জানাতে কিন্তু মানুষ আহবানকারীর আহবানে সাড়া দেয় নি। যেদিকে অনুপ্রাণিত হতে তুমি বলেছিলে তারা সেদিকে অনুপ্রাণিত হয় নি। যেদিকে আগ্রহ দেখাতে তুমি ইচ্ছা! করেছিলে তারা সেদিকে আগ্রহ দেখায় নি। তারা মৃত লাশের (এ দুনিয়া) ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, তা খেয়ে লজ্জিত হলো এবং তার প্রেমে ঐক্যবদ্ধ হলো ।
যখন কেউ কোন কিছুকে ভালোবাসে তখন সেটা তাকে অন্ধ করে দেয় এবং তার হৃদয়কে পীড়িত করে। তখন দেখে কিন্তু অসুস্থ চোখ দিয়ে; শোনে কিন্তু রুদ্ধ কান দিয়ে। আকাঙ্খা তার বুদ্ধিমত্তাকে বিনষ্ট করে দেয় এবং দুনিয়া তার হৃদয়কে মৃত করে দেয়, কারণ তার মন সদাসর্বদা দুনিয়ার আশায় লিপ্ত থাকে। ফলে সে দুনিয়ার গোলাম হয়ে পড়ে এবং তাদেরও গোলাম হয়ে যায় দুনিয়াতে যাদের অঅংশীদারিত্ব আছে। দুনিয়া যেদিকে মুখ ফেরায় সেও সেদিকে মুখ ফেরায় এবং দুনিয়া যেদিকে অগ্রসর হয় সেও সেদিকে অগ্রসর হয়। আল্লাহর কাছ থেকে কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কোন বাধাদানকারী দ্বারা সে বাধাপ্রাপ্ত হয় না এবং কোন ধর্মোপদেশকারীর কাছ থেকে নসিহত গ্রহণ করে না । সে তাদেরকেই দেখে যারা গাফলতিতে ধৃত হয়েছে যেখান থেকে পশ্চাদপসরণ বা প্রত্যাবর্তন নেই।
মৃত্যু সম্পর্কে এ দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াকে তারা উপেক্ষা করেছিল। কিন্তু তা তাদের ঘটেছে। অথচ সময়মতো বিচ্ছিন্ন হলে তারা নিজেদেরকে নিরাপদ রাখতে পারতো। তারা পরকালে প্রতিশ্রুত ফল লাভ করেছে। সেখানে যা ঘটেছে তা বর্ণনাতীত। মৃত্যুর যন্ত্রণা আর দুনিয়া হারাবার শোক তাদেরকে ঘিরে ধরেছে। ফলে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অসাড় ও চেহারা বদল হয়ে গেছে। মৃত্যু তার যন্ত্রণা তাদের ওপর বৃদ্ধি করেছে। কতেক লোকের বেলায় মৃত্যু তার ও তার কথা বলার শক্তির মাঝে এসে দাঁড়ায় যদিও সে তখন তার লোকজনের মাঝেই শুয়ে থাকে, চোখ দিয়ে তাকায়, কান দিয়ে শুনে এবং তার বোধশক্তি ও বুদ্ধিমত্তা অটুট থাকে। তখন সে চিন্তা করে কিভাবে তার জীবন নষ্ট করেছিলো এবং কী আমল করে তার সময় কেটেছিলো। সে তার সঞ্চিত সম্পদকে স্মরণ করে যা আহরণে সে নিজেকে অন্ধ করে রেখেছিলো এবং তা আহরণে ন্যায়-অন্যায় বিচার বিবেচনা করে নি। এখন সম্পদ আহরণের পরিণাম তাকে পাকড়াও করেছে। সে তা ত্যাগ করার প্রস্তুতি নেয় এবং এগুলো তার পরবতীগণের জন্য থাকবে। তারা এগুলো ভোগ করবে ও উপকৃত হবে। তার পরিত্যক্ত সম্পদ। পরবতীগণের জন্য সহজলভ্য, কিন্তু তা আহরণের সকল দায়-দায়িত্ব তার ঘাড়ে এবং সে এসব দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাবে না। তার মৃত্যুর সময় তার অতীত কর্মকান্ড যখন তার সামনে তুলে ধরা হবে তখন সে লজ্জায় নিজের হাত কামড়াবে। জীবনে ব্যগ্রভাবে যা সে কামনা করেছিল মৃত্যুর সময় সেগুলোকে ঘূণা করবে এবং মনে মনে আক্ষেপ করবে যে, সম্পদের কারণে যারা তাকে ঈর্ষা করেছিল তাদের সম্পদ স্তুপীকৃত হয়ে সে যদি নিঃস্ব হতো। মৃত্যু তার শরীরকে ক্রমান্বয়ে আক্রমণ করতে থাকবে এবং এক পর্যায়ে তার কানও জিহবার মতো হয়ে যাবে (অকেজো হয়ে যাবে)। সুতরাং সে তার লোকজনের মাঝেই বাকশক্তিহীন ও শ্রবণ শক্তিহীন অবস্থায় পড়ে থাকবে। সে তার দৃষ্টিকে তাদের মুখের ওপর ঘুরাবে, তাদের মুখের নড়া-চড়া লক্ষ্য করবে: কিন্তু তাদের কথা শুনতে পাবে না। তারপর মৃত্যু তার প্রভাব আরো বৃদ্ধি করে দেবে এবং তাতে তার দৃষ্টিও কেড়ে নেয়া হবে কান ও জিহবার মতো এবং তার রুহ দেহ থেকে প্রস্থান করবে। তখন সে তার প্রিয়জনদের কাছে একটা লাশে পরিণত হবে। তারা তার অনুপস্থিতি অনুভব করবে এবং তার কাছ থেকে চলে যাবে। সে আর কখনো শব্বানুগামীদের সাথে যোগ দিতে পারবে না অথবা কোন আহবানকারীর ডাকে সাড়া দিতে পারবে না। তারপর তারা তাকে বহন করে নিয়ে যাবে এবং মাটির অভ্যন্তরে একটা ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে ফেলে চলে যাবে, যেখানে সে তার কাজ-কর্মের ফল ভোগ করবে। এরপর আর কোনদিন তার সাথে কেউ দেখা করতে যাবে না ।
বিচার দিন সম্পর্কে যা কিছু স্থিরীকৃত হয়ে লেখিত আছে তা শেষ প্রান্তে না পৌছা পর্যন্ত, কর্মকান্ড পূর্বনির্ধারিত সীমা সম্পূর্ণ না করা পর্যন্ত, পরবতীগণ পূর্ববতীগণের সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত এবং যা কিছু আল্লাহ ইচ্ছা! করেন তাঁর সৃষ্টির পুনরুত্থান আকারে তা সংঘটিত না হওয়া পর্যন্ত সে এভাবে পড়ে থাকবে। তখন তিনি আকাশকে প্রবলভাবে কম্পিত করে বিচূর্ণ করবেন। তিনি পৃথিবীকে কম্পিত ও আলোড়িত করবেন। তিনি পর্বতসমূহকে সমূলে উৎক্ষিপ্ত করে বিচ্ছিন্ন করবেন। ওরা তাঁর মহত্ত্বের আতঙ্কে ও মহিমার ভয়ে একে অপরকে ধ্বংস করবে । তিনি এর ভেতরে যারা আছে তাদের প্রত্যেককে বের করে আনবেন। তিনি তাদেরকে ছিন্ন-ভিন্ন হওয়ার পরও সজীব ও সতেজ করবেন এবং তাদেরকে বিচ্ছিন্ন অবস্থা থেকে একত্রিত করবেন। তারপর তাদের গোপন কর্মকান্ড ও অপ্রকাশিত আমলসমূহের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের একদিকে সরিয়ে রাখবেন। এরপর তিনি তাদেরকে দুটি দলে বিভক্ত করবেন— একদলকে পুরস্কৃত করবেন এবং অন্যদলকে শাস্তি প্রদান করবেন। যারা তাঁর অনুগত ছিল তিনি তাদেরকে তাঁর নৈকট্য দ্বারা পুরস্কৃত করবেন এবং চিরদিনের জন্য তাদেরকে তার ঘরে রাখবেন যেখান থেকে কোন অবস্থানকারী বের হয়ে আসে না। সেখানে তাদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হবে না, ভীতি তাদেরকে স্পর্শ করবে না, রোগ-ব্যাধি তাদেরকে আক্রমণ করবে না, কোন বিপদাপদ তাদেরকে প্রভাবিত করবে না এবং একস্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করতে তাদেরকে বাধ্য করা হবে না।
অপরপক্ষে পাপী লোকদেরকে তিনি নিকৃষ্টতম স্থানে বসবাস করতে দেবেন। তাদের হাত ঘাড়ের সাথে বাধবেন, কপালের কেশগুচ্ছ পায়ের সাথে বাধবেন, আলকাতরার জামা পরাবেন এবং অগ্নিশিখা দ্বারা কেটে বানানো পোষাক পরাবেন। তারা আগুনে শাস্তি ভোগরত থাকবে যার উত্তাপ প্রচন্ড, দরজা বন্ধ এবং ভেতরে বিভৎস চিৎকার, উখিত অগ্নি-শিখা ও ভীত-সন্ত্রস্ত কণ্ঠ। এর ভেতরে যারা আছে তারা বেরিয়ে আসতে পারে না, এর বন্দীকে মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত করা যায় না এবং এর শিকল কাটা যায় না। এ ঘরের জন্য কোন নির্ধারিত সময়-কাল নেই যাতে শাস্তি শেষ হতে পারে এবং এ জীবনের কোন শেষ নেই যাতে মৃত্যুবরণ করতে পারে।
রাসুল (সঃ) সম্পর্কে
তিনি দুনিয়াকে ঘৃণাভরে দেখতেন এবং অত্যন্ত নিকৃষ্ট মনে করতেন। তিনি এটাকে অবজ্ঞেয় মনে করতেন এবং ঘৃণা করতেন। তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে, আল্লাহ ইচ্ছাকৃতভাবে দুনিয়াকে তাঁর কাছ থেকে দূরে রেখেছেন এবং তা তিনি ঘূণ্য আকারে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন। সে জন্য তিনি মনেপ্রাণে দুনিয়া থেকে দূরে ছিলেন, মন থেকে এর স্মৃতি মুছে ফেলেছিলেন এবং প্রার্থনা করতেন দুনিয়ার আকর্ষণ যেন তাঁর দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকে যাতে এর কোন পোষাক তাকে পরতে না হয়। তিনি পাপের বিরুদ্ধে আল্লাহর ওজর জ্ঞাপন করেছিলেন, মানুষকে সতর্ককারী হিসাবে পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং শুভ সংবাদ জ্ঞাপনকারী হিসাবে মানুষকে বেহেশতের দিকে আহবান করেছিলেন।
আহলুল বাইত সম্পর্কে ও প্রজ্ঞার উৎস। আমাদের সমর্থক ও প্রেমিকগণ আল্লাহর ক্ষমাপ্রাপ্ত এবং আমাদের শত্রু ও যারা আমাদেরকে ঘৃণা করে তারা আল্লাহর রোষে নিপতিত।