হজরত আলী (আ.) এর খেলাফতের সূচনা লগ্নে হাবীব বিন মুন্তাজাব ছিল ইয়ামেনের শাষক। ইমাম আলী (আ.) তাকে ইয়ামেনের জনগণের কাছ থেকে বাইয়াত নেয়ার জন্য চিঠি লিখেন। হাবীব ১০ জন উপযুক্ত ইয়ামেনবাসীকে আব্দুর রহমান বিন মুলজামের নেতৃত্বে কুফাতে প্রেরণ করেন। আব্দুর রহমান ইবনে মুলজাম কুফাতে আসে এবং হজরত আলী (আ.) কে মোবারকবাদ জানায় এবং বলে খোদার লানত হোক সে ব্যাক্তির উপরে যে আপনার
প্রতি সন্দেহ পোষণ করে কেননা আপনি হচ্ছে রাসুল (সা.) এর ওয়ালী এবং ওয়াসী এবং সে হজরত আলী (আ.) এর শানে কবিতা আবৃতি করে। ইমাম আলী (আ.) তাকে জিজ্ঞাসা করে তোমার নাম কি? সে বলে আব্দুর রহমান ইবনে মুলজাম মুরাদী।
ইমাম আলী উক্ত নামটি শুনার সাথে সাথে হাতের উপরে হাত রেখে তিন বার বলেনঃ (انّاللّه و انّاالیه راجعون) তারপরে তার দিকে তাকিয়ে বলেনঃ তুমিই তাহলে মুরাদী। ইয়ামেনের লোকেরা বাইয়াত করে কিন্তু তারপরে ইমাম আলী ইবনে মুলজামের কাছ থেকে আরো দুইবার বাইয়াত নেন এবং এভাবে ইবনে মুলজামের কাছ থেকে তিনি তিনবার বাইয়াত নেন। তখন সে বলেঃ হে আলী! কেন আপনি আমার সাথে এমন আচরণ করছেন? ইমাম তাকে বলেনঃ কেননা একসময় তুমি এই বাইয়াতকে তুচ্ছজ্ঞান মনে করবে এবং তা ভঙ্গ করবে। সে বলে আমার অন্তর আপনার ভালবাসায় পূর্ণ। আমি চাই আপনার সাথে থেকে শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করতে। ইমাম মুচকি হেসে তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন এবং অবশেষে বলেন যে হে ইবনে মুলজাম! তুমিই আমাকে হত্যা করবে।
ইবনে মুলজাম বলেঃ যদি আপনি আমার সম্পর্কে এমন ধারণা পোষণ করেন তাহলে আমাকে নির্বাসন দিন। ইমাম (আ.) তাকে বলেনঃ তুমি ইয়ামেনের লোকদেরকে নিয়ে ইয়ামেনে ফিরে যাও। কিন্তু তিনদিন পরে ইবনে মুলজাম অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তার সঙ্গিরা তাকে ছেড়েই ইয়েমেনে চলে যায় এবং সে কুফাতে থেকে যায়। ইমাম স্বয়ং তার সেবা যত্ন করেন এবং তার মুখে খাবার তুলে দেন এবং তার সুস্থ হওয়া পর্যন্ত তার সেবা করেন। তারপর থেকে ইবনে মুলজাম ইমাম আলী (আ.) এর পক্ষে কাজ করতো। তারপর ইমাম আলী (আ.) তাকে বাড়িতে নিয়ে যান এবং তাকে টাকা দেন এবং বলেন অমি তোমার জীবন রক্ষা করতে চাই অথচ তুমি আমাকে হত্যা করতে চাও। ইবনে মুলজাম এ কথা শুনার পরে বলে হে আলী! যদি এমনটি হয় তাহলে আপনি আমাকে হত্যা করুন। ইমাম (আ.) তার জবাবে বলেনঃ কাউকে অপরাধের আগে শাস্তি দেওয়া ঠিক না।
জামালের যুদ্ধে ইবনে মুলজাম হজরত আলী (আ.) এর পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করে এমনকি সে সিফফিনের যুদ্ধেও ইমাম আলী (আ.) এর পক্ষে যুদ্ধ করে।
খারেজি ফেরক্বা প্রকৃতপক্ষে সিফফিনের যুদ্ধ থেকেই এর সূত্রপাত ঘটে। উক্ত দলটি ছিল আগ্রাসী ও অন্ধবিশ্বাসী তারা নিজেদেরকে ঈমান ও তাকওয়ার পোষাকের মধ্যে নিজেদেরকে লুকিয়ে রেখেছিল। তারা তাদের অদ্ভুত চিন্তাধারা এবং অযৌক্তিক দলিলের ভিত্তিতে হজরত আলী (আ.) খেলাফতকালে সমস্যার সৃষ্টি করে। ইমাম আলী (আ.) তাদেরকে সকল ভুল চিন্তাধারা থেকে সত্য পথের আহবান জানান। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে তারা ইমাম আলী (আ.) এর কথা কে মেনে নেয়নি। সুতরাং ইমাম আলী (আ.) ও তাদের সাথে যুদ্ধ করা ছাড়া আর অন্য কোন পথ খুজে পাননি। তারা তাদের একগুঁয়েমি এবং বিদ্রোহপূর্ণ চিন্তাচেতনার অনুসরণ করে চলছিল। অবশেষে তারা নাহরাওয়ানের যুদ্ধে পরাজিত হয়।
সাহাবীরা মনে করেছিল যে উক্ত যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর খারেজিরা হয়তো নিমূল
হয়ে যাবে। একজন বলেঃ হে আমিরুল মুমিনিন আলী (আ.) সব খারেজিরা ধ্বংস হয়ে গেছে।
ইমাম (আ.) তার জবাবে বলেনঃ না। খোদার শপথ! এমনটি না। বরং তারা বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন রূপে আসবে এবং ধ্বংস হবে এবং তারা চুরি, লুটতারাজ এবং ছিনতাইকারীদের সাথে যোগ দিবে। রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, ইবনে মুলজাম সিফফিনের যুদ্ধ থেকেই হজরত আলী (আ.) কাছ থেকে পৃথক হয়ে যায় এবং নাহরাওয়ানের যুদ্ধে হজরত আলী (আ.) এর বিপক্ষে যুদ্ধে অংগ্রহণ করে।
সে খারেজিদের মধ্যে একটি পরিবারের মেয়ে যার নাম ছিল কোত্তাম তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। উক্ত মেয়েটি ছিল হজরত আলী (আ.) কে হত্যা করার পিছনে অন্যতম কারণ। এ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছেঃ
ইমাম আলী (আ.) সিফফিন এবং নাহরাওয়ানের যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পূর্বেই ইবনে মুলজাম কুফাতে পৌছায় এবং জনগণকে ইমাম (আ.) এর বিজয়ের সুসংবাদ দেয়। যখন সে কোত্তামের বাড়ির কাছে পৌছায় তখন কোত্তাম তাকে নাহরাওয়ানের শহীদদের নাম জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে যে তার গোত্রের কয়েকজন উক্ত যুদ্ধে মারা যায়। তখন কোত্তাম অনেক ক্রন্দন করে। তখন ইবনে মুলজাম কোত্তামকে বিবাহের প্রস্তাব দেয়। কোত্তামও তার এ প্রস্তাবকে কবুল করে এবং তাকে দেনমোহর হিসেবে কয়েকটি শর্ত দেয় যে,
– হজরত আলী (আ.) কে হত্যা করতে হবে।
– তিন হাজার দিনার।
– একটি দাশ ও একটি দাসী।
ইবনে মুলজাম ভয় পেয়ে বলে হজরত আলীকে মারা সহজ ব্যাপার না। কোত্তাম মুলজামকে আকর্ষিত করার জন্য নিজেকে পরিপাটি করে রাখতো এবং তাকে বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখাত যেন সে উক্ত বিষয়টি কবুল করে।
তখন ইবনে মুলজাম বাকর বিন উবাইদুল্লাহ তামীমী এবং আমরু বিন বাকর তামীমী নামক আরো দুজন খারেজিদের সাথে সাক্ষাত করে এবং পরিকল্পনা করে যে আলী, মাবিয়া এবং আমরু আসকে কিভাবে হত্যা করা যায়। তারা একেকজনকে হত্যার দ্বায়িত্ব নেয়।
১৯শে রমজান ৪০ হিজরীতে ইবনে মুলজাম ইমাম আলী (আ.) এর উপরে হামলা করে এবং বলেঃ (الحکمُ للّه یا على لا لَکَ) তার একাজ থেকে স্পষ্ট হয় যে সে ছিল খারেজি।
উক্ত ঘটনা থেকে আমরা বেশ কিছু বিষয় বুঝতে পারি তা হচ্ছেঃ
– যদিও ইবনে মুলজাম হজরত আলী (আ.) কে শহীদ করে কিন্তু তাদের মূখ্যে উদ্দেশ্য ছিল ইমামতকে চীরতরে শেষ করে দেয়া এবং এটা ছিল একটা বাতিল চিন্তাধারা।
– ইবনে মুলজাম ছিল সেই বাতিল ফেরক্বার একজন সদস্য মাত্র।
– উক্ত চিন্তাধারা শুধুমাত্র হজরত আলী (আ.) এর যুগেই ছিল না বরং তা রাসুল (সা.) যুগেও পরিলক্ষিত হয়। উক্ত চিন্তধারা হজরত আলী (আ.) কে হত্যা করেই শেষ হয়ে যায়নি বরং তা আজও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
– উক্ত চিন্তাধারাটি হচ্ছে এমন এক বাতিল চিন্তাধারা যা ইমামতকে তুচ্ছ জ্ঞান করে।
সূত্রঃ
১- ফুরুগ্বে বেলায়াত, আয়াতুল্লাহ জাফর সুবহানী।
২- তারিখে তাহলিলি ইসলাম তা পায়ান উমাভিয়ান।
৩- যিন্দেগানী আমিরুল মুমিনিন।
৪- তাতেম্মা ফি তাওয়ারিখিল আয়েম্মা (আলাই হিমুস সালাম), পৃষ্ঠা ৫৪।
Source: TVSHIA