দুনিয়া ও এর মানুষ সম্পর্কে
কিভাবে আমি এ দুনিয়ার বর্ণনা দেব যার প্রারম্ভ দুঃখ-দূরদর্শা এবং পরিসমাপ্তি ধ্বংসে? এখানে সম্পাদিত হালাল কাজের জন্য জবাবদিহিতা রয়েছে এবং নিষিদ্ধ কাজের জন্য শাস্তি রয়েছে। এখানে যে ধন্যবান তাকে ফেতনা-ফ্যাসাদ মোকাবেলা করতে হয়, আর যে দরিদ্র সে দুঃখ-দুৰ্দশায় নিপতিত। যে ব্যক্তি দুনিয়ার প্রতি লালায়িত হয় সে তা পায় না। আবার যে ব্যক্তি দুনিয়া থেকে দূরে সরে থাকে তার দিকে দুনিয়া এগিয়ে যায়। যদি কেউ দুনিয়ার মধ্য দিয়ে দেখতে চায়। তবে দুনিয়া তাকে দৃষ্টিদান করে। কিন্তু কারো চোখ যদি স্থিরভাবে দুনিয়ার ওপর থাকে। তবে দুনিয়া তাকে অন্ধ করে দেয় (অর্থাৎ গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট করে দেয়)।
১। “এ দুনিয়ার প্রারম্ভ দুঃখ-দূরদর্শা আর সমাপ্তি ধ্বংসে”- আমিরুল মোমেনিনের এ কথাটি কুরআন সমর্থিত ৪ প্রকৃত পক্ষে আমরা দুঃখ-দূরদর্শার মধ্যেই মানুষকে সৃষ্টি করেছি (৯০ ? ৪)।
এ কথা সত্য যে, মায়ের সংকীর্ণ জরায়ু থেকে বিশাল মহাশূন্য পর্যন্ত মানব জীবনের পরিবর্তনের পরিসমাপ্তি ঘটে না। জীবনের প্রথম স্পন্দনে মানুষ নিজকে এমন একটা সংকীর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন বন্দিখানায় দেখতে পায় যেখানে সে না পারে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নাড়াতে, না পারে পাশ পরিবর্তন করতে। এ বন্দিখানা থেকে মুক্তি লাভ করে পৃথিবীতে পদার্পণ করেই সে অগণিত দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হয়। শুরুতেই সে কথা বলতে পারে না, ফলে নিজের দুঃখ-বেদনা-ব্যথা কিছুই প্রকাশ করতে পারে না এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালন করে নিজের প্রয়োজন মিটাতে পারে না। শুধু তার ফোফানো কান্না আর গড়িয়ে পড়া অশ্রুজিল তার প্রয়োজন ও দুঃখ-বেদনা প্রকাশ করে। এ অবস্থা অতিক্রম করে শিক্ষনের স্তরে পদার্পণ করলেই শাসন আর নির্দেশ তাকে ভীত সন্ত্রস্ত রাখে। এ অবস্থা থেকে অব্যাহতি পেতে না পেতেই পারিবারিক ও জীবিকার দুশ্চিন্তা তাকে ঘিরে ধরে। তখন কখনো পেশার সহচরদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, কখনো শত্রুর সাথে সংঘর্ষ, কখনো ভাগ্যের উত্থান-পতন, কখনো রোগের আক্রমণ, কখনো সন্তানের শোক, কখনো বার্ধক্যের জরা-এভাবে পৃথিবীকে বিদায় জানানো পর্যন্ত দুঃখ-দুৰ্দশায় থাকতে হয়। এরপর আমিরুল মোমেনিন বলেন যে, এ পৃথিবীতে হালাল কাজের জবাবদিহিতা ও হারাম কাজের জন্য শাস্তি রয়েছে। ফলে আনন্দ-উপভোগও তার কাছে তিক্ত হয়ে পড়ে। অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্য মানুষকে এমনভাবে উদ্বিগ্ন করে তোলে যে তার মানসিক শান্তি বিনষ্ট হয়ে পড়ে; আবার দারিদ্র-পীড়িত হলে সে সম্পদের জন্য হাহুতাশ করে। দুনিয়ার প্রতি লালায়িত ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষার কোন শেষ নেই; একটা পূরণ হতে না হতেই অন্যটি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এ দুনিয়া প্রতিবিম্বের মতো— এর পেছনে যতই দৌড়াবে তা ততই এগিয়ে যাবে; আবার তাকে ত্যাগ করে যতই পিছু হটবে, তা তোমাকে অনুসরণ করে তোমার পিছু নেবে। অর্থাৎ যদি কোন ব্যক্তি লোভ-লালসার দৃঢ়মুষ্টি থেকে নিজকে মুক্ত করে দুনিয়ার পিছু নেয়া থেকে নিজকে বিরত রাখে তবুও সে দুনিয়া থেকে বঞ্চিত হয় না। সুতরাং যে ব্যক্তি দুনিয়াকে ভাসাভাসাভাবে দেখে, এর ঘটনা প্রবাহ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং এর বহুরূপী পরিবর্তন থেকে আল্লাহর শক্তি, জ্ঞান, বিচার শক্তি, করুণা, ক্ষমা এবং সংরক্ষণ ক্ষমতা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে পারে সে ব্যক্তি প্রকৃত চক্ষুষ্মান হয়। অপরপক্ষে যে ব্যক্তি দুনিয়ার চাকচিক্যে ও রংঢং-এ নিজকে হারিয়ে ফেলে সে দুনিয়ার অন্ধকারে নিপতিত হয়। আল্লাহ বলেনঃ তোমার চোখ কখনো প্রসারিত করো না তার প্রতি, যা আমরা তাদের বিভিন্ন শ্রেণিকে পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য স্বরূপ উপভোগের উপকরণ হিসাবে দিয়েছি, তা দিয়ে তাদের পরীক্ষা করার জন্য । তোমার প্রতিপালকের জীবিকা উৎকৃষ্ট ও অধিক স্থায়ী (কুরআন – ২০:১৩১)