আল্লাহর প্রশধ্বংসা সম্পর্কে আল্লাহর রায় সুবিবেচনাপূর্ণ এবং প্রজ্ঞাময়। তাঁর সন্তুষ্টি মানেই সুরক্ষা ও করুণা। তিনি অসীম জ্ঞানের সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং সহনশীলতার সাথে ক্ষমা করেন। হে আল্লাহ, তুমি যা নিয়ে যাও এবং যা দিয়ে দাও তার জন্য আমরা তোমার প্রশধ্বংসা করি। যা দিয়ে তুমি রোগমুক্ত কর এবং যা দিয়ে তুমি রোগাক্রান্ত কর তার জন্য আমরা তোমার প্রশধ্বংসা করি। যে প্রশধ্বংসা তোমার কাছে সবচেয়ে বেশি গ্রহণীয়, যে প্রশধ্বংসা তুমি সবচাইতে বেশি পছন্দ কর এবং যে প্ৰশধ্বংসা তোমার কাছে সবচাইতে মর্যাদাশীল আমরা তোমার সেই প্ৰশধ্বংসা করি। আমরা তোমার সেই প্রশধ্বংসা করি যা তোমার সৃষ্টিকে আপ্লুত করে এবং তুমি যেখানে ইচ্ছা কর সেখানে পৌছে। আমরা তোমার সেই প্রশধ্বংসা করি যা তোমার কাছে গুপ্ত নয়, যার কোন শেষ নেই এবং যার অবিরাম চলমানতা কখনো স্থগিত হবে না।
আল্লাহর মহত্ত্ব
আমরা তোমার প্রকৃত মহত্ত্ব সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না। আমরা শুধু জানি তুমি চিরঞ্জীব ও স্বয়ম্ভর এবং সবকিছু তোমার ওপর নির্ভরশীল। তন্দ্রা বা নিদ্ৰা তোমাকে স্পর্শ করে না, দৃষ্টি তোমার কাছে পৌছে না এবং দৃষ্টিশক্তি তোমাকে আঁকড়ে ধরতে পারে না। তুমি মানুষের চক্ষু দেখ এবং কাল গণনা করা। কপাল ও পা দ্বারা তুমি মানুষকে তোমার গোলাম কর। আমরা তোমার সৃষ্টিকে দেখি এবং তাতে তোমার কুদরত দেখে বিস্মিত হই। তোমার কর্তৃত্ব প্রকাশের জন্য আমরা সৃষ্টির বর্ণনা করি। কিন্তু যা আমাদের কাছে গুপ্ত, যা আমাদের দৃষ্টি দেখতে পায় না, যা আমাদের বুদ্ধিমত্তা আয়ত্ব করতে পারে না এবং যে সব বিষয় ও আমাদের মধ্যে কুদরতের পদ ফেলে রাখা হয়েছে সে সব বিষয় আরো অনেক মহান ।
পৃথিবীর সব কিছু থেকে হৃদয়কে মুক্ত করে যদি কেউ তার সমগ্ৰ চিন্তাশক্তি নিয়োগ করে এসব বিষয় জানতে চায় যে, কিভাবে তুমি আরাশে অধিষ্ঠিত, কিভাবে তুমি বস্তুনিচয় সৃষ্টি করেছো, কিভাবে তুমি আকাশে বাতাস প্রবাহিত করেছো এবং কিভাবে তুমি জল-তরঙ্গের ওপর পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছো, তবে তার চোখ ক্লান্ত হয়ে পড়বে, তার বুদ্ধিবৃত্তি ও জ্ঞান রুদ্ধ হয়ে যাবে, তার কান বন্ধ হয়ে যাবে এবং তার চিন্তাশক্তি স্থবির হয়ে যাবে।
আল্লাহতে ভয় ও আশা সম্পর্কে
যে তার চিন্তাশক্তি অনুযায়ী দাবি করে যে, সে আল্লাহর কাছ থেকে অনেক আশা করে; মহান আল্লাহর কসম, সে মিথ্যা কথা বলে। অবস্থা এমন যে, সে আমলের মাধ্যমে আল্লাহর কাছ থেকে আশা করে না। অথচ সে জানে যারা আল্লাহর আশা করে তারা শুধু আমলের মাধ্যমেই তা করে থাকে। মহিমান্বিত আল্লাহকে পাবার আশা ছাড়া অন্য সকল আশা অপবিত্র এবং আল্লাহর ভয় ছাড়া অন্য ভয় প্রকৃত ভয় নয়।
সে আল্লাহর কাছে বড় জিনিস ও মানুষের কাছে ক্ষুদ্র জিনিস আশা করে। কিন্তু এ ব্যাপারে সে মানুষকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়। আল্লাহকে সেভাবে গুরুত্ব দেয় না। মহামহিম আল্লাহর প্রশধ্বংসা করতে বাধা কোথায়? তিনি তাঁর বান্দাকে যা দিয়েছেন সে তুলনায় তাঁকে কমই দেয়া হচ্ছে। তোমাদের কি ভয় হয় না যে, তোমরা আল্লাহর কাছে ভূয়া আশা কর? অথবা তোমরা কি তাকে তোমাদের আশার কেন্দ্ৰবিন্দু মনে কর না? একইভাবে, কোন মানুষ যদি অন্য লোককে ভয় করে তবে সেই ভয়ের কারণে সে তাকে যতটুকু গুরুত্ব দেয় আল্লাহর ভয়ের কারণে আল্লাহকে ততটুকু গুরুত্ব দেয় না। এভাবে সে মানুষের প্রতি ভয়কে নগদ এবং স্রষ্টার প্রতি ভয়কে বাকি অথবা প্রতিশ্রুতিতে পরিণত করেছে। যাদের দৃষ্টিতে দুনিয়া বড় ও গুরুত্বপূর্ণ এবং যাদের হৃদয়ে দুনিয়ার মর্যাদা বেশি তাদের প্রত্যেকের বেলায় এ অবস্থা বিদ্যমান। সে আল্লাহ অপেক্ষা দুনিয়াকে অধিক পছন্দ করে; সুতরাং সে দুনিয়ার দিকে ঝুকে পড়ে এবং দুনিয়ার শিষ্য হয়ে পড়ে। রাসুলের (সঃ) উপমা নিশ্চয়ই, আল্লাহর রাসুলের (সঃ) মাঝে দুনিয়ার কুফল, দোষত্রুটি, অগণিত অমর্যাদাকর অবস্থা এবং এর পাপ সম্বন্ধে অনেক উদাহরণ, উপমা ও প্রমাণ রয়েছে। কারণ, দুনিয়ার পার্শ্বদেশ তাঁর জন্য সঙ্কুচিত করা হয়েছে। অথচ এর বাহু অন্যদের জন্য বিস্তৃত করা হয়েছে। তিনি দুনিয়ার দুগ্ধ থেকে বঞ্চিত ছিলেন এবং এর সাজ-সজ্জা ও চাকচিক্য থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন। মুসার উপমা যদি তোমরা চাও তবে আমি দ্বিতীয় উদাহরণ হিসাবে মুসার কথা বলবো। আল্লাহর সাথে কথোপকথনকারী মুসা (আঃ) বলেছিলেন, “হে আল্লাহ, যা কিছু মঙ্গল তুমি আমার জন্য মঞ্জর কর ওটাই আমার প্রয়োজন” (কুরআন-২৮ : ২৪)। আল্লাহর কসম, তিনি খাবার জন্য শুধু রুটি চেয়েছিলেন। কারণ, তিনি লতাপাতা খেয়ে থাকতেন। এবং তাঁর পেটের কোমল চামড়ায় সবুজাভ রং দেখা যেত। কারণ তিনি অত্যন্ত কৃশ ছিলেন এবং তাঁর শরীর মাংশল ছিল না ।
দাউদের উপমা
যদি তোমরা জানতে চাও তবে আমি দাউদের (আঃ) তৃতীয় উপমা উপস্থাপন করতে পারি। তিনি বেহেশতে আল্লাহর গুণকীর্তন আবৃত্তিকারী। তিনি খেজুর গাছের পাতার ঝুড়ি নিজ হাতে তৈরী করতেন এবং তার অনুচরদেরকে বলতেন, “তোমাদের মধ্যে কে আছে যে এই ঝুড়ি ক্রয় করে আমাকে সাহায্য করতে পারে?” বুড়ি বিক্রি লব্ধ অর্থ দিয়ে তিনি বার্লির রুটি ক্রয় করতেন।
ঈসার উপমা
যদি তোমরা চাও তবে আমি মরিয়ম তনয় ঈসা (আঃ) সম্বন্ধে বলবো। তিনি একখণ্ড পাথরকে বালিশ হিসাবে ব্যবহার করতেন, মোটা কাপড় পরিধান করতেন এবং অতি সাধারণ খাবার খেতেন। ক্ষুধা ছিল তাঁর নিত্য সাথি। চন্দ্র ছিল তাঁর রাতের বাতি। শীতকালে তাঁর আশ্রয়স্থল ছিল পূর্ব ও পশ্চিম দিকে পৃথিবীর বিস্তৃতি (অর্থাৎ খােলা আকাশ)। তাঁর ফল ও ফুল ছিল তা যা পশুর জন্য মাটিতে জন্মে। তার কোন স্ত্রী ছিল না যে তাকে প্রলুব্ধ করবে, তার কোন পুত্র ছিল না। যার জন্য তিনি শোকাহত হবেন, তাঁর কোন সম্পদ ছিল না যা তাঁর দৃষ্টি সরিয়ে নিতে পারে এবং তাঁর কোন লোভ ছিল না যাতে তাঁর অমর্যাদা হবে। তাঁর দুপা ছিল তাঁর বাহন এবং তার দুহাত ছিল চাকর।
রাসুলের (সঃ) উপমা অনুসরণ
তোমাদের রাসুলকে (সঃ) অনুসরণ করা তোমাদের উচিত। তিনি ছিলেন পবিত্রতম ও পরিশুদ্ধতম। তাঁর মধ্যে অনুসরণকারীর জন্য রয়েছে উপমা এবং সান্তুনা-সন্ধানীর জন্য রয়েছে সান্তুনা। আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা প্রিয় যে তাঁর রাসুলকে অনুসরণ করে এবং যে রাসুলের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলে। তিনি দুনিয়া থেকে অতি অল্পই গ্রহণ করেছিলেন এবং কখনো দুনিয়ার প্রতি পুরোপুরি দৃষ্টিপাত করেন নি। পৃথিবীর মানুষের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বাপেক্ষা পরিতৃপ্ত ও অভুক্ত। তাঁকে দুনিয়া সাধাসাধি করা হয়েছিলো কিন্তু তিনি তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিলেন। যখন তিনি জানলেন যে, মহিমান্বিত আল্লাহ কোন কিছুকে ঘূণা করেছেন, তিনি তখনই তা ঘূণা করেছেন; আল্লাহ কোন কিছুকে হীন করলে, তিনিও তা হীন মনে করতেন; আল্লাহ কোন কিছুকে ক্ষুদ্র করলে, তিনিও তা ক্ষুদ্ৰ মনে করতেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যা ঘূণা করেন তা যদি আমরা ভালবাসি এবং তারা যা ক্ষুদ্র করেছেন তা যদি আমরা বড় মনে করি তবে তাই আল্লাহ থেকে দূরে সরে যাওয়া ও তাঁর আদেশের সীমালঙ্ঘনের জন্য যথেষ্ট। রাসুল (সঃ) মাটিতে বসে খেতেন এবং ক্রীতদাসের মতো বসতেন। তিনি নিজ হাতে জুতা মেরামত করতেন এবং নিজ হাতেই নিজের কাপড়ে তালি লাগাতেন। তিনি জিনবিহীন খচ্চরে আরোহণ করতেন এবং তার পিছনে অন্য কাউকে উঠিয়ে নিতেন। যদি তিনি তার দরজায় চিত্রাঙ্কিত কোন পর্দা দেখতেন তবে স্ত্রীদের কাউকে বলতেন, “হে অমুক, এপর্দা আমার দৃষ্টির আড়াল কর, কারণ এর দিকে দৃষ্টি পড়লে দুনিয়া ও তার সাজ-সজ্জার কথা আমার স্মরণ হয়।” এভাবে তিনি তাঁর হৃদয় থেকে দুনিয়াকে বিতাড়িত করেছিলেন এবং তার মন থেকে দুনিয়ার স্মরণকে বিনষ্ট করেছিলেন। দুনিয়ার চাকচিক্য তাঁর দৃষ্টির আড়াল রাখতে তিনি ভালোবাসতেন। সেজন্য তিনি মূল্যবান পােষাক পরিধান করতেন না। তিনি পৃথিবীকে বাসস্থান হিসাবে গণ্য করতেন না এবং এর মধ্যে বাস করার আশাও করতেন না। ফলে দুনিয়াকে তিনি তাঁর মন থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন, তার হৃদয় থেকে একে দূর হতে বাধ্য করেছিলেন এবং তাঁর চক্ষু থেকে একে গুপ্ত রেখেছিলেন। একইভাবে যে ব্যক্তি কোন কিছুকে ঘূণা করে তার উচিত তৎপ্রতি দৃষ্টিপাত করতে বা কানে শুনতে ঘূণাবােধ করা। নিশ্চয়ই, আল্লাহর রাসুলের মধ্যে এমন গুণ ছিল যা তোমাদেরকে দুনিয়ার অমঙ্গল ও দোষত্রুটি দেখিয়ে দেবে। তিনি তাঁর প্রধান সাহাবীগণসহ ক্ষুধার্তা থাকতেন এবং দুনিয়ার ভোগ-বিলাসের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা থেকে দূরে সরে থাকতেন। এখন তোমরা তোমাদের বুদ্ধিমত্তা দ্বারা দেখতে পারে, এর ফলে আল্লাহ মুহাম্মদকে (সঃ) সম্মানিত করেছিলেন নাকি অসম্মানিত করেছিলেন? যদি কেউ বলে আল্লাহ তাকে অপমানিত করেছিলেন। তবে সে নিশ্চয়ই মিথ্যা কথা বলে এবং একটা মহা অসত্যের মাঝে নিজেকে জড়িয়ে নেয়। যদি কেউ বলে আল্লাহ তাকে সম্মানিত করেছিলেন। তবে মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তাদেরকে অপমানিত করেন যাদের প্রতি তিনি দুনিয়াকে প্রসারিত করেন এবং যারা তার নিকটতম হয়েছে তাদের কাছ থেকে দুনিয়াকে সরিয়ে রাখেন। সুতরাং প্রত্যেকের উচিত। আল্লাহর রাসুলকে অনুসরণ করা, তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলা এবং তার প্ৰদৰ্শিত পথে প্রবেশ করা। অন্যথায় সে ধ্বংস থেকে নিরাপদ থাকতে পারবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ মুহাম্মদকে (সঃ) বিচার দিনের নির্দশন, বেহেশতের সুসংবাদদাতা ও মহাশাস্তির সতর্ককারী হিসাবে প্রেরণ করেছেন। তিনি ক্ষুধার্ত অবস্থায় এ পৃথিবী ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু নিরাপত্তার সাথে পরকালে প্রবেশ করেছিলেন। তিনি পৃথিবী ত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত ঘর নির্মাণের জন্য একটা পাথরের ওপর আরেকটা পাথর রাখেন নি এবং আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। আল্লাহর রহমত কত মহান যে, তিনি রহমত স্বরূপ রাসুলকে (সঃ) আমাদের মাঝে দিয়েছেন যাকে আমরা অনুসরণ করতে পারি এবং যিনি একজন নেতা যার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমরা চলতে পারি। আমিরুল মোমেনিনের নিজের উপমা আল্লাহর কসম, আমি আমার পিরাহানে (শার্ট) এত বেশি তালি লাগিয়েছি যে এখন আমি তা পরতে লজ্জা বোধ করি। কেউ একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো আমি এই পিরাহান খুলে ফেলবো কিনা। আমি তাকে বলেছিলাম, “আমার কাছ থেকে সরে যাও।” শুধুমাত্র ভোরবেলা মানুষ এর সুবিধা অনুধাবন করতে পারে এবং রাতের পথ চলায় এর প্রশধ্বংসা করে ।