অনুচরগণকে যুদ্ধে* উদ্বুদ্ধকরণ বৰ্মাচ্ছদিত লোকদের সামনে রেখো এবং বর্মবিহীনদেরকে পিছনে রেখো। তোমরা দাতে দাত চেপে ধরো, কারণ এতে তরবারি মাথার খুলির ওপর পড়বে না। যে দিকে (শত্রুর) বর্শাধারী সেদিকে “ডজ’ (হঠাৎ সরে পড়া) দিয়াে, কারণ তাতে বর্শার ফলার দিক পরিবর্তিত হয়ে যাবে। চোখ বন্ধ করো কারণ এতে আত্মশক্তি বৃদ্ধি পায় এবং হৃদয়ে শান্তি আসে। গলার স্বর বন্ধ করো কারণ এতে সাহসহীনতা দূর
হয়। তোমাদের ঝান্ডা কখনো বাকা করো না এবং ঝান্ডা কখনো ফেলে যেয়ো না। সাহসী ও মর্যাদা
রক্ষক ছাড়া অন্য কারো কাছে ঝান্ডা দিয়ে না, কারণ বিপদ ঘটলে তারাই শুধু সহ্য করতে পারে; তারা ঝান্ডাকে চর্তুদিক থেকে ঘিরে রাখে এবং সম্মুখ ও পিছন উভয় দিকে তা চক্রাকার করে রাখে। তারা ঝান্ডা থেকে আলাদা হয় না পাছে তা শত্রুর হাতে চলে যায়। তারা ঝান্ডা ছেড়ে এগিয়ে যায় না পাছে তা একা পড়ে যায়। প্রত্যেকে তার বিপক্ষের মোকাবেলা করবে এবং নিজের জীবন দিয়ে হলেও সাথিকে সাহায্য করবে। বিপক্ষকে তোমার সাথি মোকাবেলা করবে মনে করে কখনো ছেড়ে দিও না। এতে তোমার বিপক্ষ তোমার সাথির বিপক্ষের সাথে যোগ দেবে। আল্লাহর কসম, তোমরা আজকের তারবারি থেকে পালিয়ে গেলেও পরকালের তরবারি থেকে নিরাপদ থাকতে পারবে না। তোমরা আরবদের মধ্যে অগ্রণী এবং অঙ্গ-সৌষ্ঠবেও তোমরা উন্নত । নিশ্চয়ই, জিহাদ থেকে পলায়নে রয়েছে আল্লাহর রোষ, চিরস্থায়ী অসম্মান ও লজ্জা । নিশ্চয়ই, একজন পলায়নকারী তার জীবন দীর্ঘায়িত করতে পারে না এবং পলায়নকারী ও তার মৃত্যুর মধ্যে কোন কিছুই হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কে আছে এমন যে আল্লাহর দিকে ছুটে যায়। যেমন করে তৃষ্ণার্ত পানির দিকে যায়? বর্শার ফলার নিচে বেহেশত রয়েছে। আজ শৌর্যের সুখ্যাতি পরীক্ষিত হবে। আল্লাহর কসম, তারা তাদের ঘরে ফেরার জন্য যতটুকু উৎসুক আমি তাদেরকে যুদ্ধে দেখার জন্য ততোধিক উৎসুক। হে আমার আল্লাহ, যদি তারা সত্য পরিত্যাগ করে তবে তাদের দল ছত্রভঙ্গ করো, তাদের মধ্যে মতদ্বৈধতা সৃষ্টি করো এবং তাদের পাপের কারণে তাদেরকে ধ্বংস করো। তারা তাদের মনোভাব পরিবর্তন করবে না যে পর্যন্ত না বর্শার আঘাতে তাদের শরীর এমনভাবে বিদীর্ণ হয় যাতে এদিক থেকে সেদিক বাতাস পার হয়ে যায়, তরবারির আঘাতে তাদের মাথার খুলি কেটে যায়, হাড় ভাঙ্গে ও হাত-পা বিছিন্ন হয়। তারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করবে না যে পর্যন্ত না তারা একের পর এক বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাদের শহরসমূহ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয় এবং ঘোড়ার পদাঘাতে তাদের চারণভূমি ও ভূমির শেষ সীমা পর্যন্ত দলিত ও বিনষ্ট হয়।
১। আমিরুল মোমেনিন। সিফফিনের যুদ্ধের প্রাক্কালে এ ভাষণ দিয়েছিলেন। ৩৭ হিজরি সনে আমিরুল মোমেনিন ও সিরিয়ার গভর্নর মুয়াবিয়ার মধ্যে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। খলিফা উসমানের হত্যার তথাকথিত প্রতিশোধের কারণ দেখিয়ে মুয়ারিয়া এ যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়। বস্তৃত এ যুদ্ধ ছিল মুয়াবিয়ার কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য। মুয়াবিয়া খলিফা উমরের সময় থেকে সিরিয়ার গভর্নর নিয়োজিত থেকে সেখানে স্বশাসন চালিয়ে আসছিলো। উসমানের সময় তার ক্ষমতা যথেচ্ছ প্রয়োগ করে সিরিয়াকে করতলগত করে নিয়েছিল। আমিরুল মোমেনিন খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর মুয়াবিয়া তার বায়াত গ্ৰহণ করে নি। কারণ সে মনে করতো। আমিরুল মামোমেনিনের বায়াত গ্রহণ করলে তার কর্তৃত্ব থাকবে না। ফলে সে তার সহজাত ধূৰ্ততা প্রয়ােগ করে কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য উসমানের হত্যাকে একটা ইসু’ হিসাবে ব্যবহার করেছিল। তার পরবতী কার্যাবলী থেকে এটা সুস্পষ্ট বুঝা যায়। সে ক্ষমতা দখলের পর কোনদিন ভুলেও উসমানের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের বিষয়টি মুখে আনে নি বা হত্যাকারীদের বিষয়ে কোন শব্দ করে নি। যদিও প্রথম দিন থেকেই আমিরুল মোমেনিন বুঝতে পেরেছিলেন যে, যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবি তবুও সকল ওজর নিঃশেষ করার প্রয়োজনে জামালের যুদ্ধ শেষে কুফায় ফিরে এসে ৩৬ হিজরি সনের ১২ রজব সোমবার তিনি জারির ইবনে আবদিল্লাহ আল-বাজালীকে একটা পত্রসহ মুয়াবিয়ার কাছে দামস্কে প্রেরণ করেছিলেন। পত্রে তিনি লেখেছিলেন যে, মুহাজির ও আনসারগণ তাঁর বায়াত গ্রহণ করেছে এবং মুয়াবিয়াও যেন বায়াত গ্রহণ করে উসমানের হত্যা মামলা পেশ করে, যাতে তিনি কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী রায় প্রদান করতে পারেন। কিন্তু মুয়াবিয়া নানা তালবাহানা করে জারিরকে বিলম্ব করাতে লাগলো। অপরদিকে আমর ইবনে আল-আসের পরামর্শক্রমে উসমান হত্যার কারণ দেখিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণার ব্যবস্থা করলো। সে সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মাধ্যমে অজ্ঞ জনগণকে বুঝিয়েছিল যে, উসমানের হত্যার জন্য আলী দায়ী—তিনি তাঁর আচরণ দ্বারা অবরোধকারীদের উৎসাহ ও প্রশ্রয়
দিয়েছেন। ইতোমধ্যে মুয়াবিয়া উসমানের রক্তমাখা জামা ও তার স্ত্রী নায়লাহ বিনতে ফারাফিসার কর্তিত আঙ্গুল দামস্কের কেন্দ্রীয় মসজিদে ঝুলিয়ে রেখেছিল এবং তার চারদিকে সত্তর হাজার সিরিয়ান কান্নারত ছিল এবং তারা উসমানের রক্তের প্রতিশোধ নেয়ার শপথ গ্রহণ করেছিলো। এভাবে মুয়াবিয়া সিরিয়দের অনুভূতি এমন এক অবস্থায় নিয়ে গেল যে, তারা উসমানের রক্তের বদলা নেয়ার জন্য নিজেদের জীবন বিসর্জন দিতেও দৃঢ় সংকল্প হলো। তখন মুয়াবিয়া “উসমানের হত্যার প্রতিশোধ” ইসু্যর ওপর তাদের বায়াত গ্রহণ করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে লাগলো। মুয়াবিয়া জারিরকে সিরিয়দের অনুভূতি ও মনােভাব দেখিয়ে দিয়ে অপমান করে ফেরত পাঠিয়ে निव्ल ।
জারীরের কাছে বিস্তারিত জানতে পেরে আমিরুল মোমেনিন অত্যন্ত দুঃখ পেয়েছিলেন এবং মালিক ইবনে হাবিব আল-ইয়ারবুইকে নুখায়লাহ উপত্যকায় সৈন্য সমাবেশ করার আদেশ দিলেন। ফলে কুফার উপকণ্ঠে প্ৰায় আশি হাজার লোক জড়ো হয়েছিল। প্রথমে আমিরুল মোমেনিন জিয়াদ ইবনে নদীর আল-হারিছির নেতৃত্বে আট হাজারের একটা শক্তিশালী বক্ষীবাহিনী এবং সুরায়হ ইবনে হানি আল-হারিছির নেতৃত্বে অন্য একটা চার হাজারের শক্তিশালী বাহিনী সিরিয়া অভিমুখে প্রেরণ করলেন। অবশিষ্ট সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব নিজে গ্রহণ করে ৫ শাওয়াল বুধবার আমিরুল মোমেনিন সিাষ্ট্রয়া অভিমুখে যাত্রা করলেন। কুফার সীমান্ত অতিক্রম করে তিনি যোহর সালাত আদায় করলেন এবং তারপর দােয়র আবু মুসা, নাহর, নারস, কুব্বাত কুব্বিন, বাবিল, দােয়র কা’ব, কারবালা, সাবাত, বাহুরা সিনি, আল-আনবার ও আর জাযিরাহ স্থানসমূহে বিশ্রাম গ্রহণ করে আর-রিক্কায় উপনীত হলেন। এখানকার জনগণ উসমানের পক্ষে ছিল এবং এখানেই সিমাক ইবনে মাখতামাহ আল আসাদী তার আটশত লোকসহ তাঁবু খাটিয়েছিল। এসব লোক আমিরুল মোমেনিনের পক্ষ ত্যাগ করে মুয়াবিয়ার সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্য কুফা থেকে বেরিয়ে এসেছিলো। যখন তারা আমিরুল মামোমেনিনের বাহিনী দেখতে পেল তখন তারা ফোরাত নদীর ওপরের সেতু খুলে ফেললো যাতে তিনি নদী পার হতে না পারেন। কিন্তু মালিক ইবনে হারিছ। আলআশাঁতারের ধমকে তারা ভীত হয়ে গেল এবং উভয়ের মধ্যে আলাপ-আলোচনার পর তারা সেতু জোড়া লাগিয়ে দিল এবং আমিরুল মোমেনিন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে নদী পার হয়ে গেলেন। নদীর অপর তীরে অবতরণ করে তিনি দেখতে পেলেন যে, জিয়াদ ও সুরায়হ। সেখানে ছাউনি পেতে অপেক্ষা করছে। তারা আমিরুল মোমেনিনকে বললো যে, এ স্থানে পৌছার পর তারা খবর পেয়েছিল মুয়াবিয়ার বাহিনী ফোরাত অভিমুখে এগিয়ে আসছে। তার বিশাল বাহিনীর গতিরোধ করা সম্ভব হবে না মনে করে তারা আর না এগিয়ে আমিরুল মোমেনিনের জন্য অপেক্ষা করছিলো। তাদের থেমে থাকার ওজর আমিরুল মোমেনিন গ্রহণ করলেন এবং তাদেরকে অগ্রবর্তী হওয়ার জন্য আদেশ দিলেন। তারা যখন সুর-আর-রুম নামক স্থানে পৌছলো তখন দেখতে পেলো যে, আবু আল-আওয়ার আস-সুলামী তথায় ক্যাম্প করে সৈন্যসহ অবস্থান করছে। তারা উভয়ে আমিরুল মোমেনিনকে এ সংবাদ দিল। তিনি মালিক ইবনে হারিছ। আল-“আশতারকে সেনাপতি নিয়োগ করে সেখানে প্রেরণ করলেন এবং নির্দেশ দিলেন। যে, যতদূর সম্ভব যুদ্ধ এড়িয়ে তাদেরকে যেন প্রকৃত অবস্থা বুঝিয়ে বলা হয় এবং উপদেশের মাধ্যমে তাদের মনোভাব পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। মালিক-আল-আশতার তাদের কাছ থেকে অল্প দূরে ক্যাম্প করলেন। কিন্তু তিনি যুদ্ধের কোন ভাব দেখালেন না। অপর দিকের অবস্থা থমথমে ছিল, যে কোন সময় যুদ্ধ শুরু করার জন্য তারা উন্মুক্ত আসি হাতে অপেক্ষা করছিলো। আবু আল-আওয়ার হঠাৎ করে রাতের বেলা আক্রমণ করে বসলো এবং সামান্য সময় যুদ্ধের পর সে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে পালিয়ে গেল। পরদিন আমিরুল মোমেনিন সসৈন্যে সেখানে পৌছে সিফফিন অভিমুখে যাত্রা করলেন। মুয়াবিয়া পূর্বেই সিফফিন পৌছে ছাউনি পেতেছিলো এবং ফোরাত কুল অবরোধ করে সৈন্য মোতায়েন করেছিলো। আমিরুল মোমেনিন সেখানে পৌছে মুয়াবিয়াকে অনুরোধ করে পাঠালেন যেন সে ফোরাত কুল থেকে সৈন্য সরিয়ে নিয়ে পানি নেয়ার ব্যবস্থা অবরোধমুক্ত করে। কিন্তু মুয়াবিয়া আমিরুল মোমেনিনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় ইরাকি সৈন্যগণ সাহসিকতার সাথে আক্রমণ করে ফোরাতকুল দখল করে। তারপব আমিরুল মোমেনিন মুয়াবিয়ার কাছে বশির ইবনে আমার আল-আনসারি, সাঈদ ইবনে কায়েস আল-হামদানি ও শাবাছ ইবনে রিবি আত-তামিমীকে প্রেরণ করলেন এ জন্য যে, তারা যেন যুদ্ধের ভয়াবহতা তাকে বুঝিয়ে বলে এবং সে যেন বায়াত গ্রহণ করে একটা মীমাধ্বংসায় আসতে রাজি হয়। এ প্রস্তাবে মুয়াবিয়া সরাসরি বলে দিল যে, উসমানের রক্তের প্রতি সে উদাসীন থাকতে পারে না; কাজেই তরবারিই একমাত্র মীমাধ্বংসা— এর কোন বিকল্প নেই। ফলে ৩৬ হিজরি সনের জিলহজ মাসে উভয় পক্ষের যোদ্ধাগণ একে অপরের মোকাবেলা করার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে পড়লো। আমিরুল মোমেনিনের পক্ষে যারা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ কায়েস ইবনে সা’দ আল-আনসারী ও মালিক ইবনে হারিছ। আল-আশতার। অপরপক্ষে সিরিয়দের মধ্য থেকে যারা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল তারা হলো ঃ আবদার রহমান ইবনে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ, আবু আল-আওয়ার আস-সুলামী, হাবিব ইবনে মাসলামাহ আল-ফিহরি, আবদুল্লাহ ইবনে জিলকালা, উবায়দুল্লাহ ইবনে উমর ইবনে আল-খাত্তাব, শুরাহবিল ইবনে সিমৃত আল-কিন্দি, ও হামজাহ ইবনে মালিক আল-হামদানী। জিলহজ মাসের শেষের দিকে মুহরামের জন্য যুদ্ধ বন্ধ রাখতে হলো এবং ১ সফর পুনরায় যুদ্ধ শুরু হলো। ঢাল, তলোয়ার ও বর্শ নিয়ে উভয় পক্ষ সারিবদ্ধভাবে একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়ালো। আমিরুল মোমেনিনের পক্ষ থেকে কুফি অশ্বারোহীগণের কমান্ডার হলেন মালিক আশ্যতার ও কুফি পদাতিক বাহিনীর কমান্ডার হলেন আম্মার ইবনে ইয়াসির এবং বসরি অশ্বারোহীর কমান্ডার হলেন সহল। ইবনে হুনায়েফ আল-আনসারী ও বসরি পদাতিকের উতবাহ। অপরপক্ষে সিরিয়দের দক্ষিণ বাহুর কমান্ডার ছিলো ইবনে জিলকালা ও বাম বাহুর কমান্ডার ছিলো হাবিব ইবনে মাসলামাহ এবং অশ্বারোহীর কমান্ডার ছিলো আমর ইবনে আস ও পদাতিক বাহিনীর কমান্ডার হলো দাহহাক ইবনে কায়েস। প্রথম দিন মালিক ইবনে আশতার যুদ্ধের ময়দানে তার লোকজন নিয়ে নেমেছিল এবং হাবিব ইবনে মাসলমাহ তার লোকজন নিয়ে মালিকের মোকাবেলা করলো। সারাদিন তরবারি ও বর্শার যুদ্ধ চলেছিলো। পরদিন হাশিম ইবনে উতবাহ আলীর সৈন্য নিয়ে ময়দানে নামলো এবং আবু আল-আওয়ার তার মোকাবেলা করলো। অশ্বারোহী অশ্বারোহীর ওপর ও পদাতিক পদাতিকের ওপর ঝাপিয়ে পড়লো এবং ভয়ানক যুদ্ধে হাশিম দৃপ্তপদে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেছিলো। তৃতীয় দিন আম্মার ইবনে ইয়াসির অশ্বারোহী ও জিয়াদ ইবনে নদীর পদাতিক বাহিনী নিয়ে ময়দানে নামলো। আমর ইবনে আস বিশাল বাহিনী নিয়ে তাদের মোকাবেলা করলো। মালিক ও জিয়াদের প্রবল আক্রমণে শক্ৰপক্ষ গ্রাউন্ড হারিয়ে ফেলে এবং আক্রমণ রোধ করতে ব্যর্থ হয়ে আমার লোকজন নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে গিয়েছিলো। চতুর্থ দিন মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিল। উবায়দুল্লাহ ইবনে উমর তার মোকাবেলায় এসেছিল। মুহাম্মদ বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে শক্রর প্রভূত ক্ষতিসাধন করেছিল। পঞ্চম দিনে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস ময়দানে গেল এবং তার মোকাবেলা করার জন্য ওয়ালিদ ইবনে উকবা এসেছিল। কিন্তু আবদুল্লাহ বীরবিক্রমে এমন প্রচন্ড আক্রমণ করলো যে, শক্র ময়দান ত্যাগ করে পিছু হটে গেল। যষ্ঠ দিনে কায়েস ইবনে সা’দ আল-আনসারী ময়দানে নামলো এবং তার মোকাবেলা করার জন্য ইবনে জিলকালা এসেছিল। উভয় পক্ষে এমন প্রচন্ড লড়াই হয়েছিলো যে, প্রতি পদক্ষেপে মৃতদেহ দেখা গিয়েছিল এবং রক্তের স্রোতধারা বয়ে গিয়েছিল। অবশেষে রাত্রি নেমে আসায় উভয় বাহিনী আলাদা হয়ে গেল। সপ্তম দিনে মালিক আশতার ময়দানে নামলে হাবিব ইবনে মাসলামাহ তার মোকাবেলায় এসে যোহরের নামাজের পূর্বেই ময়দান ছেড়ে পিছিয়ে গেল। অষ্টম দিনে আমিরুল মোমেনিন নিজেই ময়দানে গেলেন এবং এমন প্রচন্ড বেগে আক্রমণ করলেন যে, যুদ্ধক্ষেত্র প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল। বর্শা ও তীরবৃষ্টি উপেক্ষা করে বৃহের পর বৃহ ভেদ করে শত্রুর উভয় লাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং মুয়াবিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে বললেন, “অযথা লোক ক্ষয় করে লাভ কী? তুমি আমার মোকাবেলা কর। তাতে একজন নিহত হলে অপরজন শাসক হবে।” এসময় ইবনে আস মুয়াবিয়াকে বললো, “আলী ঠিক বলেছে। একটু সাহস সঞ্চার করে তার মোকাবেলা কর।” মুয়াবিয়া বললো, “তোমার প্ররোচনায় আমি আমার প্রাণ হারাতে প্ৰস্তুত নই।” এ বলে সে পিছনের দিকে চলে গেল। মুয়াবিয়াকে পিছনে হটতে দেখে আমিরুল মোমেনিন মুচকি হেসে ফিরে এলেন। যে সাহসিকতার সাথে আমিরুল মোমেনিন। সিফফিনে আক্রমণ রচনা করেছিলেন তা নিঃসন্দেহে অলৌকিক। যখনই তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতেন তখন শত্রু বৃহ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত এবং দুঃসাহসী যোদ্ধারাও তার মুখোমুখি হতো না। এ কারণেই তিনি কয়েকবার পোশাক বদল করে যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছিলেন। একবার আরার ইবনে আদ’হামের মোকাবেলায় আব্বাস ইবনে রাবি ইবনে হারিছ। ইবনে আবদাল মুত্তালিব গিয়েছিল। আব্বাস অনেকক্ষণ লড়াই করেও আরারকে পরাজিত করতে পারতেছিলো না। হঠাৎ সে দেখতে পেল আরারের বর্মের একটা আংটা খুলে আছে। আব্বাস কাল বিলম্ব না করে তরবারি দিয়ে আরো ক’টি আংটা কেটে দিয়ে চোখের নিমিষে আরারের বুকে তরবারি ঢুকিয়ে দিল। আরারের পতন দেখে মুয়াবিয়া বিচলিত হয়ে গেল এবং আব্বাসকে হত্যা করতে পারে এমন কেউ আছে কিনা বলে চিৎকার করতে লাগলো। এতে লােখম গোত্রের কয়েকজন এগিয়ে এসে আব্বাসকে চ্যালেঞ্জ করলে সে বললো যে, সে তার প্রধানের অনুমতি নিয়ে আসবে। আব্বাস আমিরুল মোমেনিনের কাছে গেলে তিনি তাকে সেখানে রেখে তার পোশাক পরে ও তার ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করলেন। আব্বাস মনে করে লাখম গোত্রের লোকেরা বললে, “তাহলে তুমি তোমার প্রধানের অনুমতি নিয়েছো।” প্রত্যুত্তরে আমিরুল মোমেনিন নিম্নের আয়াত আবৃত্তি করলেন ৪ করা হয়েছে । আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদের সাহায্য করতে সক্ষম। / (কুরআন-২২৫৩৯)
তখন লাখম গোত্রের একজন লোক হাতির মত গর্জন করতে করতে আমিরুল মোমেনিনের ওপর আঘাত হানলো। তিনি সে আঘাত প্রতিহত করে এমন জোরে আঘাত করলেন যে, লোকটি দ্বিখন্ডিত হয়ে ঘোড়ার দুদিকে দুখন্ড পড়ে গেল। তারপর সে গোত্রের অন্য একজন এসেছিল। সেও চোখের নিমিষে শেষ হয়ে গেল। অসি চালনা ও আঘাতের ধরণ দেখে লোকেরা বুঝতে পারলো যে আব্বাসের ছদ্মবেশে আমিরুল মোমেনিন। যুদ্ধ
করছেন। তখন আর কেউ সাহস করে তার সামনে আসে নি। নবম দিনে দক্ষিণ বাহুর দায়িত্ব দেয়া হলো আবদুল্লাহ ইবনে বুদায়লকে ও বাম বাহুর দায়িত্বে ছিলেন
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস এবং মধ্যভাগে আমিরুল মোমেনিন নিজে ছিলেন। অপরদিকে সিরিয় সৈন্যদের নেতৃত্বে ছিল হাবিব ইবনে মাসলামাহ। উভয় লাইন মুখোমুখী হলে সিংহের মত একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং চতুর্দিক থেকে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। আমিরুল মোমেনিনের বাহিনীর ঝান্ডা বনি হামদানের হাতে ঘুরছিলো। একজন শহীদ হলে আরেকজন তা তুলে ধরে। প্রথমে কুরায়ব ইবনে শুরায়রের হাতে ছিল, তার পতনে শুরাহবিল ইবনে শুরায়রের হাতে গেল, এরপর ইয়ারিম ইবনে শুরায়র, এরপর সুমায়ার ইবনে শুরায়র, এরপর হুবায়রাহ ইবনে শুরায়র, এরপর মারসাদ ইবনে শুরায়র-এই ছয় ভ্রাতা শহিদ হবার পর ঝান্ডা গ্ৰহণ করলো সুফিয়ান, এরপর আবদ, এরপর কুরায়ব— জায়েদের এ তিন পুত্র। তারা শহিদ হবার পর ঝান্ডা ধারণ করলো বশিরের দুপুত্ৰ— উমায়ার ও হারিছ। তারা শহিদ হবার পর ঝান্ডা ধারণ করলো। ওহাব ইবনে কুরায়ব। এদিনের যুদ্ধে শক্রর বেশি লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ বাহুর দিকে। সে দিকে এত তীব্ৰ বেগে আক্রমণ করেছিলে যে, আবদুল্লাহ ইবনে বুদায়লের সাথে মাত্র তিন শত সৈন্য ছাড়া সকলেই যুদ্ধক্ষেত্র পিছিয়ে গিয়েছিল। এ অবস্থা দেখে আমিরুল মোমেনিন মালিক আশতারকে বললেন, “ওদের ফিরিয়ে আনা। ওদের জীবন যদি ফুরিয়ে এসে থাকে তাহলে পালিয়ে গিয়ে মৃত্যুকে এড়ানো যাবে না। দক্ষিণ বাহুর পরাজয় বাম বাহুকেও প্রভাবিত করবে ভেবে আমিরুল মোমেনিন বাম বাহুর দিকে এগিয়ে গেলেন এবং শক্রর বু্যুহ ভেদ করতে লাগলেন। এসময় উমাইয়াদের একটা ক্রীতদাস (যার নাম আহমার) বললো, “তোমাকে কতল করতে না পারলে আল্লাহ আমার মৃত্যু করুন।” এ কথা শোনামাত্র আমিরুল মোমেনিনের ক্রীতদাস ফায়সান তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। কিন্তু আহমারের হাতে শহিদ হয়ে গেল। তারপর আমিরুল মোমেনিন আহমারকে আকর্ষণ করে শূন্যে তুলে এমন জোরে আছাড় দিলেন যে, তার শরীরের সব ক’টি জোড়া খুলে গিয়েছিলো। তখন ইমাম হাসান ও মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া তাকে জাহান্নামে প্রেরণ করলেন। এদিকে মালিক আশাঁতারের আহবানে দক্ষিণ বাহুর পলাতক লোকজন ফিরে এসে তীব্রভাবে আক্রমণ করে শক্রকে পূর্বস্থানে ঠেলে নিয়ে গেল— এখানে আবদুল্লাহ ইবনে বুদায়েল শত্রু কর্তৃক ঘেরাও হয়ে রয়েছিল। নিজের লোকজন দেখে আবদুল্লাহর সাহস ফিরে এলো। সে খোলা তরবারি হাতে নিয়ে মুয়াবিয়ার তাবুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। মালিক আশতার তাকে থামাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। মুয়াবিয়া আবদুল্লাহকে দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে গেল এবং তার রক্ষীদের বললো আবদুল্লাহকে পাথর মারতে। এতে আবদুল্লাহ শহিদ হলো। মালিক আশতার এটা দেখে বনি হামদান ও বনি মুযহিজ-এর যোদ্ধাগণকে নিয়ে মুয়াবিয়ার ওপর আক্রমণ চালাবার জন্য এগিয়ে গেল এবং মুয়াবিয়ার রক্ষীবাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করতে লাগলো। রক্ষীবাহিনীর পাঁচটি চক্রের মধ্যে মাত্র একটি ছত্রভঙ্গ হওয়ার বাকী থাকাকালে মুয়াবিয়া পালিয়ে যাবার জন্য ঘোড়ার রেকবে পা রেখেছিল, এমন সময় কে একজন সাহস দেয়ায় সে ফিরে দাঁড়ালো। যুদ্ধ ক্ষেত্রের অপরদিকে আম্মার ইবনে ইয়াসির ও হাশিম ইবনে উতত্বার তরবারি প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। আম্মার যে দিকে যেত। রাসুলের (সঃ) সাহাবিগণ সে দিকে জড়ো হয়ে তাকে ঘিরে থাকতো এবং তারা এমন প্রবল আক্রমণ রচনা করতো যে, শত্রু বৃহে লাশের পর লাশ পড়ে যেত। মুয়াবিয়া এ অবস্থা দেখে আম্মারের দিকে সংরক্ষিত সৈন্য থেকে বেশ কিছু প্রেরণ করলো। কিন্তু আম্মারের তরবারি ও বর্শা নৈপুণ্যের কাছে তারা টিকতে পারে নি। এক পর্যায়ে আবু আদিয়াহ আল-জুহানির বর্শার আঘাতে তিনি আহত হলেন এবং ইবনে হাওয়াইয়ার (জওন আস-সাকসিকি) তাঁকে কতল করে শহিদ করলো। আম্মারের মৃত্যুর ফলে মুয়াবিয়ার দলের অভ্যন্তরে রাসুলের (সঃ) একটা বাণী নিয়ে আলোড়ন শুরু হলো। লোকেরা বলতে লাগলো যে, তারা শুনেছে রাসুল (সঃ) বলেছেন, “আম্মার একটা বিদ্রোহী দলের হাতে নিহত হবে।” জুলকালা আমরকে বললো, “আমি দেখতে পাচ্ছি। আম্মার আলীর দলে; তাহলে কি আমরা বিদ্রোহী?” আমরা একথার সুস্পষ্ট জবাব দিতে পারে নি। তখন মুয়াবিয়া সিরিয়দেরকে সম্বোধন করে বললো, “আমরা আম্মারকে হত্যা করি নি। তাকে হত্যা করেছে আলী, কারণ আলীই তো তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে এনেছে।” মুয়াবিয়ার এহেন ধূৰ্ততাপূর্ণ কথা শুনে আমিরুল মোমেনিন বললেন, “তাহলে বলতে হয়। রাসুল (সঃ) হামজাকে হত্যা করেছেন, কারণ তিনিই হামজাকে ওহুদের যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়েছেন।” আম্মার নিহত হবার পর হাশিম ইবনে উতবাও শাহাদত বরণ করেন। হারিছ ইবনে মুনয্যির তাকে নিহত করে। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র আবদুল্লাহ্ বাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণ করে। এসব অকুতোভয় যোদ্ধাগণের মৃত্যুতে আমিরুল মোমেনিন দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে হামদান ও রাবিয়াহ গোত্রদ্বয়ের লোকদেরকে বললেন, “আমার কাছে তোমরা বর্ম ও বর্শা সমতুল্য। উঠে দাড়াও—এসব বিদ্রোহীকে উচিত শিক্ষা দাও।” ফলে রাবিয়াহ ও হামদান গোত্রদ্বয়ের বার হাজার সৈন্য তরবারি হাতে নিয়ে দাড়িয়ে গেল । তাদের ঝান্ডা ছিলো। হুদায়ন ইবনে মুনযিরের হাতে। তারা বিপুল বিক্রমে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করলো এবং শত্রুর বৃহ। একের পর এক ভেদ করে রক্তের স্রোত বইয়ে দিল এবং লাশ স্তুপীকৃত হয়ে রইল। রাতের গাঢ় অন্ধকার না নামা পর্যন্ত তাদের তরবারি থামলো না। এটাই সেই ভয়ঙ্কর রাত্রি যা ইতিহাসে “আল-হারিরের রাত্ৰি” বলে খ্যাত। এ রাতে অস্ত্রের ঝনঝনানি, ঘোড়ার খুরের শব্দ ও সিরিয়দের আর্তনাদে আকাশ প্রকম্পিত হয়েছিলো এবং তাদের আর্ত-চিৎকার ছাড়া অন্য কিছু কর্ণকুহরে প্রবেশ করে নি। মাঝে মাঝে আমিরুল মোমেনিনের দিক থেকে “অন্যায় ও বিভ্রান্তি নিপাত যাক”-শ্লোগানে তাঁর সৈন্যগণের সাহস ও শৌর্য বৃদ্ধি করছিলো এবং শত্রুর হৃদয় শুকিয়ে দিয়েছিলো। যুদ্ধ যখন চরমে পৌছালো তখন তীরন্দাজের তীর নিঃশেষ হয়ে গেল- বর্শার বাট ভেঙ্গে গেল—হাতে হাতে তরবারি যুদ্ধ চলছিলো। সকাল বেলায় দেখা গেল ত্ৰিশ হাজারের উর্ধে লোক নিহত হয়েছে।
দশম দিনে আমিরুল মোমেনিনের লোকেরা একই মনোবল নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে গেল। দক্ষিণ বাহুর কমান্ডার ছিলেন মালিক আল-আশতার এবং বাম বাহুর কমান্ডার ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস। তারা এমন তীব্র আক্রমণ রচনা করেছিলেন যে, সিরিয়দের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো এবং তারা যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পলায়ন করতে শুরু করেছিলো। এমন সময় শত্রুপক্ষ পাঁচশত কুরআন বর্শার আগায় বেঁধে তুলে ধরলো যাতে যুদ্ধের অবস্থা বদলে গেল—তরবারি চালনা থেমে গোল— ছলনা কৃতকার্য হলো—অন্যায়ের পথ পরিষ্কার হয়ে গেল। এ
যুদ্ধে সিরিয়দের পক্ষে পয়তাল্লিশ হাজার লোক নিহত হয়েছিল এবং পচিশ হাজার ইরাকি শহিদ হয়েছিলো। (মিনকারী***, তাবারী*, ১ম খন্ড, পৃঃ ৩২৫৬-৩৩৪৯)।