কুরাইশগণ* আমাদের রাসুলকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল এবং আমাদের মূলোৎপাটন করতে চেয়েছিল। তারা আমাদেরকে সর্বদা উদ্বিগ্ন অবস্থায় রাখতো, আমাদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করতো, আমাদের জীবনের আরাম-আয়েশ দূর করে দিয়েছিলো, আমাদেরকে সর্বদা-আতঙ্কিত রাখতো, পাহাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করতে আমাদেরকে বাধ্য করেছিলো এবং আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধানল প্রজুলিত করেছিলো । এ অবস্থায় মহান আল্লাহ তাঁর দ্বিনকে রক্ষা করা ও তাঁর সম্মানকে সমর্থন করার জন্য আমাদেরকে দৃঢ়-সংকল্প-চিত্ত করে দিলেন ; আমাদের মধ্যকার ইমানদারগণ ঐশী পুরস্কারের আশায় এবং অবিশ্বাসীগণ জ্ঞাতিত্বের টানে আমাদেরকে সমর্থন দিয়েছিল। কুরাইশদের মধ্যে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল তারা আমাদের চেয়ে অনেক কম দুঃখ-দুৰ্দশা ভোগ করেছিল। এর কারণ হলো— হয় তারা প্রতিরক্ষামূলক প্রতিশ্রুতির আওতাভুক্ত ছিল, না হয় তাদের গোত্রগত অবস্থান (অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কিছু করলে গোটা গোত্র তার সমর্থনে চলে যাবে)। সেজন্য তারা হত্যা থেকে নিরাপদ ছিল। রাসুলের (সঃ) হাতে যে একটা পথ ছিল তা হলো যুদ্ধ যখন ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করতো এবং তার যোদ্ধাদের যখন অবস্থান হারানোর উপক্রম হতো তখন তিনি স্বজনদেরকে অগ্রগামী করে পাঠাতেন এবং তাদের মাধ্যমে নিজের অনুচরদেরকে তরবারি ও বর্শা থেকে রক্ষা করতেন। এভাবেই বন্দরের যুদ্ধে উবাদাহ ইবনে আল-হারিছ, ওহুদের যুদ্ধে হামজাহ্ ইবনে আবদাল মুত্তালিব এবং মুতা যুদ্ধে জাফর ইবনে আবি তালিব শহিদ হয়েছিলেন। রাসুল (সঃ) তাঁর আপনজনদের মধ্যে আরেকজনকেও (যার নাম তুমি ভালোভাবে জান অর্থাৎ আলী) বারবার যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রগামী করে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু শাহাদত বরণ করার জন্য তার প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মৃত্যু নির্ধারিত ছিল না বলে সে এখনো বেঁচে আছে। এটা বড়ই আশ্চর্যোব- বিষয় যে, আমি কিরূপে এমন একজনের দলভুক্ত হতে পারি যে ধর্ম বিষয়ে আমার মতো কর্মচঞ্চল পদক্ষেপ কখনো দেখে নি অথবা এ বিষয়ে আমার মতো কোন অবস্থান যার নেই এবং সে এমন কিছু অবদান দাবি করে যা আমার জানা নেই এবং আমি মনে করি তাঁর এসব দাবি সম্পর্কে আল্লাহও অবহিত নন। যা হোক, সকল প্রশংসা মহিমান্বিত আল্লাহর ।
উসমানের হত্যাকারীদেরকে তোমার হাতে তুলে দেয়ার জন্য তোমার অনুরোধের প্রেক্ষিতে আমি বলতে চাই যে, আমি বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করে দেখেছি এবং তাদেরকে তোমার হাতে বা অন্য কারো হাতে তুলে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার জীবনের শপথ, যদি তুমি তোমার ভ্রান্ত পথ ও ফেতনামূলক কর্মকান্ড পরিত্যাগ না কর তবে নিশ্চয়ই তুমি তাদেরকে চেন। তারা সহসাই তোমাকে খোজ করে নেবে। তাদেরকে জলে-স্থলে-পর্বতে- সমতলে খোঁজার কষ্ট তারা তোমাকে দেবে না। কিন্তু তাদের এ অনুসন্ধান তোমার জন্য বেদনাদায়ক হবে এবং তাদের সাক্ষাত তোমাকে আনন্দ দেবে না। যারা শান্তি চায় তাদের ওপর শান্তি বৰ্ষিত হোক ।
১। আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে আল্লাহর রাসুল যখন আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য মানুষকে আহবান করেছিলেন তখন কাফের কুরাইশ গোত্র এ সত্যের বাণী স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য তাদের সমগ্ৰ শক্তি দিয়ে রুখে দাড়িয়েছিল। এ প্রতিমা পূজারী দলের হৃদয়ে প্রতিমা-প্রীতি এত প্রকট ছিল যে, তারা তাদের প্রতিমার বিরুদ্ধে একটা কথাও শুনতে রাজি ছিল না। এক আল্লাহর ধারণা তাদের সকল ধৈর্যচ্যুতির জন্য যথেষ্ট ছিল। এ অবস্থায় তারা শুনতে পেল তাদের দেবতাগুলো সামান্য নিজীব, নিশ্চল ও জড় পাথর ছাড়া আর কিছুই নয়। যখন তারা দেখলো তাদের বিশ্বাস ও নীতি বিপদাপন্ন হয়ে পড়ছে তখন তারা রাসুলকে (সঃ) বিপদগ্ৰস্থ করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ ও সকল উপায় অবলম্বন করতে লাগলো। তারা এমন সব ক্লেশদায়ক উপায় অবলম্বন করলো যে, ঘরের বাইরে যাওয়া পর্যন্ত রাসুলের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়লো। এ সময় যারা ইসলাম গ্ৰহণ করেছিল তাদের ওপর অবারিত অত্যাচার তারা চালিয়ে যাচ্ছিলো। এ সময় নওমুসলিমগণ সিজদা করলে তাদেরকে জ্ঞান হারানো পর্যন্ত বেত্ৰাঘাত ও প্রস্তরাঘাত করা হতো। কুরাইশদের এরূপ নিষ্ঠুর অত্যাচার দেখে রেসালতের পঞ্চম বছরে রাসুল (সঃ) তাঁর অনুসারীগণকে আবিসিনিয়া হিজরত করার অনুমতি দিয়েছিলেন। নিষ্ঠুর কুরাইশগণ তাদের পিছু নিয়ে আবিসিনিয়াও গিয়েছিল, কিন্তু আবিসিনিয়ার শাসক রাসুলের অনুসারীদেরকে কুরাইশদের হাতে তুলে দেন নি। এবং তার মহত্ত্বের ফলে তারা সেখানে কোন বিপদে পড়ে নি।
এদিকে রাসুলের বাণী ক্রমাগত বেড়েই চলছে এবং সত্যের আকর্ষণ মানুষের মনে দোলা দিতে লাগলো। তাঁর বাণী ও ব্যক্তিত্বে মোহিত হয়ে মানুষ দলে দলে তাঁর ছাতার নিচে আশ্রয় গ্রহণ করতে দেখে কুরাইশগণ জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিলো এবং তাদের অবলম্বিত সকল উপায় ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে দেখে বনি হাশিমের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলো। তারা আশা করেছিল। সকল প্রকার সামাজিক সম্পর্ক ও লেনদেন বন্ধ করে দিলে বনি হাশিম ও বনি আবদ-আল মুত্তালিব রাসুলকে (সঃ) সমৰ্থন দেয়া বন্ধ করে দেবে এবং তাতে স্বাভাবিকভাবেই রাসুল (সঃ) দমে যাবেন। কুরাইশগণ নিজেদের মধ্যে এ বয়কট বাস্তবায়নের জন্য পরস্পর চুক্তিবদ্ধ হলো। এ চুক্তির ফলে বনি হাশিম একত্বরে হয়ে পড়লো। কেউ তাদের সঙ্গে সাক্ষাত করে না— তাদের দেখলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এমনকি তাদের সঙ্গে মালপত্র বেচাকেনা করাও বন্ধ করে দেয়। এ সময় বনি হাশিমের জন্য একটা দুশ্চিন্তা প্রকট হয়ে উঠেছিলো; তা হলো শহরের বাইরের উপত্যকায় যে কোন সময় রাসুলের (সঃ) আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। সবকিছু বিবেচনা করে বনি হাশিম “আবি তালিবের শিব (বাসা)” নামক স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধা হয়েছিলেন। বনি হাশিমের যে সকল সদস্য ইসলাম গ্রহণ করেছিল তারা সকলেই “শিব-ই- আবি তালিব”-এ আশ্রয় নিয়েছিল। আর যারা তখনো ইসলাম গ্রহণ করে নি। তারা জ্ঞাতিত্ব ও গোত্র টানে তাদের প্রতিরক্ষা বিধান করেছিল। এ সময় হামজা ও আবি তালিব নিজেদের আরাম আয়েশ ত্যাগ করে রাসুলের (সঃ) প্রতিরক্ষা বিধান করেছিল এবং তারা সারাক্ষণ রাসুলকে (সঃ) সান্তুনা দিতেন। শত্রুর আক্রমণের ভয়ে প্রতিরাতে রাসুলকে কয়েকবার বিছানা বদল করে ঘুমাতে দিতেন। রাসুলকে একটা বিছানা থেকে সরিয়ে তাঁর স্থলে আলীকে শুইয়ে রাখতেন।
বয়কটের এ দিনগুলো বনি হাশিমের জন্য বড়ই কষ্টদায়ক ছিল। তারা দিনের পর দিন উপোস করে কাটিয়েছে—এমন কি গাছের পাতা খেয়েও দিনাতিপাত করেছে। তিন বছর এভাবে নিদারুণ কষ্টে কাটানোর পর জুহায়র ইবনে আবি উমাইয়া (যার মাতা ছিল আতিকা বিনতে আবদ আল মুত্তলিব), হিশাম ইবনে আমর ইবনে রাবিয়াহ (যে তার মায়ের দিক থেকে বনি হাশিমের আত্মীয়), আল মুন্তিম ইবনে আদি ইবনে নওফল ইবনে আবদ মনাফ, আবুল বখতারী আল-আস ইবনে হিশাম ইবনে আল-মুঘিরাহ এবং জামাআহ ইবনে আল-আসওয়াদ ইবনে আল-মুত্তালিব বয়কট চুক্তি বাতিলের প্রস্তাব করলে কুরাইশ নেতাগণ কাবায় একটা আলোচনা বৈঠক করে। আবু তালিব উপত্যকার নির্বাসন স্থান থেকে এসে এ বৈঠকে হাজির হয়ে বললেন, “আমার ভ্রাতুষ্পপুত্র মুহাম্মদ বলেছে তোমাদের চুক্তির সমুদয় লেখা সাদা-পিপীলিকায় খেয়ে ফেলেছে; শুধুমাত্র আল্লাহর নামটুকু অবশিষ্ট আছে। তোমরা চুক্তিপত্রটি আনা। যদি তার কথা সত্য হয় তবে তোমরা তার শক্রিতা পরিহার করা। আর যদি তার কথা সত্য না হয় তবে আমি তাকে তোমাদের হাতে তুলে দেব।” এতে তারা রাজি হয়ে চুক্তিপত্র এনে দেখতে পেলো যে, আল্লাহর নাম ব্যতীত অপর সকল লেখা সাদা-পিপড়ায় খেয়ে ফেলেছে। এ অবস্থা দেখে আল-মুন্তিম ইবনে আদি চুক্তি পত্রটি ছিড়ে ফেলে দিয়েছিলো। এভাবে বয়কট চুক্তির অবসান ঘটে এবং বনি হাশিম নিদারুণ দুঃখ কষ্ট হতে নিস্কৃতি পায়। এরপরও রাসুলের (সঃ) প্রতি কাফেরদের আচরণে তেমন কোন পরিবর্তন আসে নি; বরং তারা রাসুলের (সঃ) প্ৰাণনাশের ফন্দি এটেছিল, যে কারণে তাকে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করতে হয়েছিল। অবশ্য এ সময় আবু তালিব জীবিত ছিলেন না। হিজরতের সময়ও আলী রাসুলের (সঃ) বিছানায় শুয়ে থেকে রাসুলকে রক্ষা করার শেখানো পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন।
এসব ঘটনা মুয়াবিয়ার অজানা ছিল না। তবুও আমিরুল মোমেনিন তার পূর্ব পুরুষদের আচরণ তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে সে সত্যের অনুসারী ও মিথ্যার অনুসারীদের আচরণ বুঝতে পেরে ন্যায়, সত্য ও হেদায়েতের পথে আসতে পারে।