মালিক ইবনে হারিছ। আশতারকে মিশরের গভর্নর নিয়োগ করে নিয়োগ পত্রের সাথে এ দলিল” দিয়েছিলেন। আল্লাহর বান্দা ও আমিরুল মোমেনিন আলী এ আদেশ মালিক ইবনে হারিছ। আশতারকে দিচ্ছে যখন তাকে রাজস্ব আদায়ের জন্য, শত্রুর সাথে যুদ্ধ করার জন্য, জনগণের মঙ্গল সাধনের জন্য ও নগরসমূহকে সম্পদশালী করার জন্য মিশরের গভর্নর নিয়ােগ করা হলো। তাকে আদেশ করা হচ্ছে আল্লাহকে ভয় করার জন্য এবং তাঁর অনুগত হবার জন্য। আল্লাহ কুরআনে যা আদেশ করেছেন তা অনুসরণ করার জন্য তাকে আদেশ করা হচ্ছে। আল্লাহর আদেশ অনুসরণ না করে কেউ দ্বিনাৰ্জন করতে পারে না। শয়তান ছাড়া কেউ আল্লাহর আদেশের বিরোধিতা ও অবহেলা করে না। তাকে আরো আদেশ করা হচ্ছে যেন সে তার হৃদয়-মন, হাত আর কণ্ঠ দিয়ে আল্লাহকে সাহায্য করে, কারণ মহিমান্বিত আল্লাহ্ তাকে সাহায্য করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। যে আল্লাহকে সাহায্য করে এবং যে তাকে সমর্থন করে, তাকেই তিনি রক্ষা করেন। তাকে আরো আদেশ করা হচ্ছে যেন সে তার হৃদয়কে কামনা-বাসনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং
কামনা-বাসনা বৃদ্ধির সাথে সাথে হৃদয়কে নিয়ন্ত্রন করে। কারণ আল্লাহর রহমত না হলে হৃদয় মানুষকে পাপের পথে নিয়ে যায়।
গভর্নরের গুণাবলী ও দায়িত্ব
হে মালিক, মনে রেখো, আমি তোমাকে এমন এক এলাকায় পাঠাচ্ছি যেখানে তোমার পূর্বেও সরকার ছিল— তাদের কেউ কেউ ছিল ন্যায়পরায়ণ আবার কেউ কেউ ছিল অত্যাচারী। জনগণ এখন তোমার কর্মকান্ড নিরীক্ষণ করবে যেভাবে তুমি তোমার পূর্ববর্তী শাসকগণকে নিরীক্ষণ করতে এবং তারা তোমার সমালোচনা করবে যেভাবে তুমি পূর্ববর্তী শাসকগণের সমালোচনা করেছে। নিশ্চয়ই, দ্বিনদারগণের পরিচয় পাওয়া যায় তাদের খ্যাতির মাধ্যমে যা আল্লাহ তার বান্দাগণের জিহবা দ্বারা ছড়িয়ে দেন। সুতরাং তোমার ভালো কর্মকান্ডই তোমার সর্বোত্তম সঞ্চয়। সেহেতু তোমার কামনা-বাসনা ও হৃদয়কে নিয়ন্ত্রণ করে প্রদমিত রেখো যাতে তোমার জন্য যা জায়েজ নয় তা করা থেকে বিরত থাকতে পার। কারণ হৃদয়কে নিয়ন্ত্রণ করাই হলো ইচ্ছা-অনিচ্ছার অর্ধেক প্ৰদমিত করা।
প্রজাদের প্রতি দয়া, মমতা ও সহৃদয়তা প্রদর্শন করা অভ্যাস করো। মনে রেখো, প্ৰজারা দুপ্রকারের—হয় তারা তোমার দ্বিনি ভাই, না হয় তারা তোমার মতোই সৃষ্ট বান্দা। সুতরাং তাদের মাথার ওপর লোভাতুর পশুর মতো দাঁড়িয়ে না। পশু মনে করে গোগ্রাসে গিলে ফেলাই যথেষ্ট। প্ৰজাগণের পদস্থলন হতে পারে—তারা ভুল করতে পারে। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে অথবা অবহেলা বশে ভুল করতে পারে। সুতরাং তাদের প্রতি ক্ষমা ও অনুকম্পা প্রদর্শনে কার্পণ্য করো না। কারণ তুমিও তো চাও আল্লাহ যেন তাঁর সর্বোচ্চ ক্ষমা তোমার প্রতি প্রদর্শন করেন। মনে রেখো, তুমি তাদের ওপর আর তোমার ওপর হলেন দাযিত্বশীল ইমাম (আলী) এবং আল্লাহ হলেন তার ওপর যিনি তোমাকে নিয়োগদান করেছেন। আল্লাহ চান যে, তুমি তাদের কর্মকান্ডের ব্যবস্থাপনা কর এবং এ দায়িত্বের মাঝেই তিনি তোমার বিচার করবেন।
কখনো আল্লাহর সাথে যুদ্ধ করতে চেয়ে না, কারণ তাঁর ক্ষমতার কাছে তোমার কোন ক্ষমতাই নেই এবং তার ক্ষমা ও রহমত ছাড়া তুমি কিছুই করতে পারবে না। কখনো ক্ষমা করতে অনুতাপ করো না এবং শাস্তি প্রদানে দয়া দেখিয়ো না। ক্রোধের সময় কখনো তাড়াহুড়া করে কিছু করো না—ক্রোধ সম্বরণ করতে চেষ্টা করো। কখনো এ কথা বলাে না, “আমাকে কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে—আমি যা আদেশ করি। তাই মানতে হবে।” কারণ এটা হৃদয়ে দ্বিধা-দ্বন্দূের উদ্রেক করে, দ্বিনকে দুর্বল করে দেয় এবং ধ্বং নিকটবর্তী করে দেয়। যে কর্তৃত্ব তোমাকে দেয়া হয়েছে তাতে যদি তোমার মনে কোন প্ৰগলভ্যতা বা অহমবোধ আসে। তবে আল্লাহর বিশাল রাজত্বের প্রতি এবং তাঁর মহাশক্তির প্রতি লক্ষ্য করে দেখো । তাতে তোমার নিজের ওপরই তোমার কর্তৃত্ব আছে বলে মনে হবে না। এটা তোমার মনের অহমকে কুকড়ে দেবে, তোমার উগ্ৰ মেজাজের চিকিৎসা করে দেবে এবং যে প্রজ্ঞা তোমার কাছ থেকে সরে গিয়েছিল তা ফিরিয়ে আনবে। সাবধান, আল্লাহর মহত্ত্বের সঙ্গে কখনো নিজকে তুলনা করো না অথবা তার শক্তির মতো নিজকে শক্তিধর মনে করো না। কারণ প্ৰত্যেক ক্ষমতার দাবিদারকে তিনি অবদমিত করেছেন এবং প্রত্যেক অহংকারীকে তিনি অবমানিত করেছেন। আল্লাহর জন্য ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করো এবং জনগণের প্রতি ন্যায় বিচার করো। তোমার নিজের প্রতি, আত্মীয়-স্বজনের প্রতি এবং প্রজাদের মধ্যে যাদেরকে তুমি পছন্দ কর তাদের প্রতি কোন পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করো না। যদি তুমি স্বজন-গ্ৰীতি কর তবে তুমি অত্যাচারীদের মধ্যে পরিগণিত হবে। আর যখন কেউ আল্লাহর বান্দাদের উপর অত্যাচার ও নিপীড়ন করে তখন বান্দার পরিবর্তে আল্লাহ নিজেই জালিমের প্রতিপক্ষ হন। আর যখন আল্লাহ কারো প্রতিপক্ষ হন, তিনি তাকে অবজ্ঞাভরে পদদলিত করেন এবং যে পর্যন্ত সে অনুতপ্ত হয়ে তওবা না করে সে পর্যন্ত সে আল্লাহর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়া বা তার মহাশাস্তি অত্যাচার ও নিপীড়ন ছাড়া অন্য কিছুতে
এতবেশি ত্বরান্বিত হয় না। কারণ আল্লাহ মজলুমের আর্তনাদ শোনেন এবং জালিমদের প্রতি রোষাবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকান। সর্বসাধারণের স্বার্থে প্ৰশাসন
তোমার এমন পথ অবলম্বন করা উচিত হবে যা সাম্য ও ন্যায় ভিত্তিক, যা হবে ন্যায় বিচারের দিক থেকে সার্বজনীন এবং যা তোমার অধীনস্থ সকলেই একবাক্যে গ্রহণ করবে। কারণ জনসাধারণের মধ্যে কোন ব্যবস্থা সম্পর্কে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলে তা নেতার যুক্তি-তর্ককে খর্ব করে দেয়। আবার নেতাদের মধ্যে কোন বিষয়ে অনৈক্য থাকলে তা গুরুত্ব সহকারে না দেখলেও চলে যদি ওই বিষয়ে জনগণের মধ্যে ঐকমত্য থাকে। তোমার অধীনস্থ যত লোক আছে তাদের মধ্যে সমাজপতি কতিপয় ব্যক্তিই একজন শাসকের জীবনের সুখ-শান্তিতে অধিকতর বোঝা । সংকটের সময় এরা কম উপকারী। এরা সাম্য ও ন্যায়ের প্রতি অনীহা প্রদর্শনকারী। সুবিধা আদায়ে এরা সুচতুর। প্রদত্ত অনুগ্রহের জন্য এরা কম কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী। এদের দাবি পূরণে অপারগতার জন্য যুক্তি ও কারণ মেনে নিতে এরা সবচেয়ে নিম্পূহ ও অনাগ্রহী। কোন প্রকার অসুবিধায় ধৈর্য ধারণে এরা সবচেয়ে দুর্বল। বস্তৃত সমাজের সাধারণ মানুষই দ্বিনের স্তম্ভ, তারা মুসলিম সমাজের আসল শক্তি এবং তারা শত্রুর বিরুদ্ধে প্ররক্ষা। তাদের প্রতি তোমার মনের দুয়ার খুলে দিয়ো এবং তাদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ও সহানুভূতিশীল হয়ো ।
তোমার অধীনস্থ লোকদের মধ্যে তারা নিকৃষ্টতম। যারা অন্যদের দোষত্রুটির বিষয়ে অত্যন্ত অনুসন্ধিৎসু। কারণ মানুষের দোষত্রুটি থাকতে পারে এবং তা ঢেকে রাখার জন্য শাসকই যথোপযুক্ত ব্যক্তি। যে সব দোষত্রুটি তোমার কাছে গোপন রয়েছে তা ফাঁস করে দিয়ো না, কারণ যা তোমার কাছে প্রকাশ পেয়েছে তা সংশোধন করাই তোমার দায়িত্ব। আর যা তোমার কাছে গোপন রয়েছে তা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দাও। সুতরাং যতটুকু পারা যায় মানুষের দোষত্রুটি ঢেকে রেখো। তাহলে তোমার যে সব দোষত্রুটি প্রজাদের কাছে প্রকাশ না হয়ে পড়ার ইচ্ছা তুমি পোষণ করা আল্লাহ তা ঢেকে রাখবেন। মনের সকল বন্ধন মুক্ত করে মানুষের সঙ্গে চলো। এতে শক্রতার কোন কারণ থাকবে না। যা তোমার কাছে স্পষ্ট নয়। তাতে জানার ভান করো না। কুৎসা রটনাকারীদের সাথে পাল্লা দিয়ে না; কারণ কুৎসা রটনাকারী আপাতঃদৃষ্টিতে ভালো মানুষ মনে হলেও মূলত সে প্রতারক।
উপদেষ্টা
কখনো কোন কৃপণ ও কাপুরুষকে উপদেষ্ট হিসাবে গ্রহণ করো না। কারণ কৃপণ তোমাকে ঔদার্যপূর্ণ কাজ থেকে বিরত রাখবে এবং আর্থিক অনটনের ভয় দেখাবে। আবার কাপুরুষ তোমার কর্মকান্ডে তোমাকে নিরুৎসাহীত করবে এবং আদেশ-নির্দেশ কার্যকরী করতে দুর্বল করে তুলবে। একইভাবে কোন লোভী ব্যক্তিকেও উপদেষ্ট করো না। তারা অন্যায়ভাবে কর আদায় করে সম্পদের প্রাচুর্য তোমাকে দেখাবে। কৃপণতা, কাপুরুষতা ও লোভ ভিন্ন ভিন্ন দোষ হলেও এরা কিন্তু আল্লাহর প্রতি ভুল ধারণা সম্পর্কে অভিন্ন। যেসব লোক তোমার পূর্ববর্তী শোষক ও নিপীড়কদের মন্ত্রনাদাতা ছিল তারাই হবে তোমার নিকৃষ্টতম মন্ত্রী। কারণ তারা নিপীড়কদের পাপের সহযোগী ছিল। কাজেই এসব লোককে তোমার দলের প্রধান করো না। কারণ তারা পাপী, দুষ্কর্মের সাহায্যকারী এবং অত্যাচারীদের দোসর ছিল। তুমি তাদের পরিবর্তে ভালো মানুষও পাবে—যারা প্রভাবশালী। কিন্তু নিপীড়কদের কর্মকান্ড ও পাপের জন্য তাদের ঘূণা করে। এরা তোমাকে সবচেয়ে কম জ্বালাতন করবে এবং তোমার সবচেয়ে বড় সহযোগী হবে। এরা তোমার প্রতি সবচেয়ে বেশি সহনশীল হবে এবং অন্যদের সাথে কম সম্পর্ক রাখবে। কাজেই এ ধরনের লোককে গোপনীয় ও প্রকাশ্য কাজে তোমার প্রধান সহচর করো। যেসব লোক তোমার সমালোচনায় স্পষ্ট ও সত্য ভাষণ করে এবং যারা তোমার পদমর্যাদা ও ক্ষমতার তোয়াক্কা না করে আল্লাহ্ কর্তৃক অনুমোদিত বিষয়ে অপ্রিয় সত্য কথা বলবে তাদের প্রতি পূর্ণ আস্থা স্থাপন করো। সর্বদা খোদাভীরু ও সত্যবাদীদের সাথে মেলা মেশা করো। তাদেরকে এমনভাবে শিক্ষা দিয়ো যেন তারা কোন কাজে তোমার কর্তৃত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে তোষ্যমুদে কথা না বলে। কারণ সংসার আধিক্য মানুষের অহমবোধ সৃষ্টি করে তাকে ঔদ্ধত্যের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। তোমার কাছে ধামিক ও পাপী যেন সমান মর্যাদা না পায়। এতে ধাৰ্মিকগণের সৎকর্মের প্রতি অনীহা জন্মাবে এবং পাপীগণ পাপের প্রতি আগ্ৰহান্বিত হবে। যে যেমন মর্যাদার অধিকারী সে যেন তোমার কাছে সে রকম মর্যাদা পায়। মনে রেখো, শাসকের সুনাম অর্জনের সবচেয়ে বড় উপায় হলো তার প্রজাদের প্রতি সদারচণ করা, তাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করা এবং তাদের ওপর কোন অসহনীয় কর আরোপ না করা। কাজেই এ বিষয়ে তুমি এমন পথ অবলম্বন করবে যাতে করে প্রজাদের মাঝে তোমার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে এবং এতে তারা তোমার অনুগত থাকবে। তাতে তোমার উদ্বেগ ও আশঙ্কা বহুলাংশে কমে যাবে | যে সমাজ ব্যবস্থায় তুমি যাচ্ছো তাদের পুরাতন কল্যাণকর প্রথা-যা দ্বারা সাধারণ ঐক্য ও প্রজাদের উন্নতি সাধিত হয় তা বন্ধ করে দিয়ে না। এমন কোন কর্মপদ্ধতি উদ্ভাবন করো না যা জনগণের প্রচলিত কল্যাণকর প্রথাকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। এমনটি করলে যারা ঐ প্রথাগুলোর প্রবর্তন করেছিল তাদের সুনাম থেকে যাবে আর তা বন্ধ করার দায়-দায়িত্ব তোমার ওপর বর্তাবে। যে এলাকার দায়িত্ব তোমাকে দেয়া হয়েছে সেখানকার পন্ডিত ব্যক্তি ও জ্ঞানী লোকদের সাথে তোমার আলাপ-আলোচনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করো। এতে এলাকার উন্নতি স্থিতিশীল হবে এবং জনগণ দৃঢ়চিত্ত থাকবে। বিভিন্ন শ্রেণির লোক জেনে রাখো, জনগণ বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত হলেও একে অপরের সহায়তা ছাড়া উন্নতি লাভ করতে পারে না এবং তারা কেউ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তাদের মধ্যে আল্লাহর পথে নিয়োজিত সৈনিক রয়েছে, বিভাগীয় প্রধান ও জনগণের সচিবালয়ের কর্মচারী রয়েছে, ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য বিচারক রয়েছে, আশ্রিত অমুসলিম ও মুসলিমগণের মধ্য থেকে জিজিয়া ও খারাজ প্রদানকারী অনেকেই রয়েছে, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি রয়েছে এবং দুঃস্থ ও অভাবগ্ৰস্থ রয়েছে। আল্লাহ তাদের প্রত্যেকের হিস্যা ও সীমা তার কুরআনে এবং তার রাসুলের সুন্নাহয় নির্ধারিত করে দিয়েছেন যা আমাদের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
সেনাবাহিনী (ইনশাল্লাহ) জনগণের জন্য দুর্গ স্বরূপ, শাসকদের অলঙ্কার, দ্বিনের শক্তি এবং শান্তির উপায়। সেনাবাহিনী ছাড়া জনগণ টিকতে পারবে না। আবার রাজস্বের যে অংশ আল্লাহ তাদের জন্য নির্ধারিত করেছেন সে অংশ দ্বারা তারা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি পাচ্ছে এবং তাদের প্রয়োজন মেটাচ্ছে। এ দুশ্রেণির লোক তৃতীয় শ্রেণি অৰ্থাৎ বিচারক, নির্বাহী ও সচিব ছাড়া চলতে পারে না। যারা চুক্তি সম্পর্কে রায় দেয়, রাজস্ব সংগ্রহ করে এবং সাধারণ কল্যাণ ও বিশেষ বিষয়াবলী পরিচালনা করে।
এ শ্রেণিগুলো আবার ব্যবসায়ী ও শিল্প-কারখানা ছাড়া চলতে পারে না। কারণ এরা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করে ও বাজার স্থাপন করে। ফলে অন্যদেরকে এগুলো নিজ হাতে করতে হয় না। এরপর থাকে অভাবগ্ৰস্থ ও দুঃস্থগণ, যাদেরকে সাহায্য করা আবশ্যক এবং তারা সকলেই আল্লাহর নামে জীবিকা পায়। শাসকের ওপর তাদের প্রত্যেকের অধিকার আছে যাতে তাদের উন্নতি সাধিত হয়। শাসকের ওপর এ বিষয়ে আল্লাহ যে দায়িত্ব অৰ্পণ করেছেন তা কোন ক্রমেই পরিত্যাগ করা যাবে না।
১ । সেনাবাহিনী
এমন লোককে তোমার সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব অর্পণ করো যে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুল এবং তোমার ইমামের প্রতি সবচেয়ে বেশি আনুগত্য রাখে ও তাদের শুভাকাঙ্খী। সেনাবাহিনীর নেতাদের মধ্যে সেই সবচাইতে সৎ ও ধৈর্যশীল যে ওজর ছাড়া সহজে কাউকে আক্রমণ করে না, যে দুর্বলের প্রতি সদয় এবং সবলের প্রতি নমনীয় নয়। এরা কখনো অন্যের উদ্ধৃঙ্খলতায় উত্তেজিত হয়ে পড়ে না এবং দুর্বলতা এদের বসিয়ে রাখতে পারে না ।
উচ্চ বংশমর্যাদা সম্পন্ন, ধাৰ্মিক ও সুন্দর ঐতিহ্যের অধিকারী, সাহসী ও বীরত্বপূর্ণ এবং উদার ও দয়াদ্র লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করো, কারণ তারা সম্মানের পাত্র এবং ধাৰ্মিকতার ঝরনাধারা। তাদের বিষয়াদি নিয়ে এমনভাবে সংগ্ৰাম করবে যেন পিতামাতা সন্তানের জন্য সংগ্রাম করে। তাদের শক্তিশালী করতে তুমি যা কিছু কর তা অনেক বড় কিছু করেছে বলে মনে করো না অথবা তাদের জন্য যা কিছু করতে তুমি সম্মত হয়েছে তা ক্ষুদ্ৰ মনে করে পরিত্যাগ করো না। এতে তারা তোমার শুভানুধ্যায়ী হবে এবং তোমার সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করবে। তাদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলীর প্রতি নিজকে অধিক ব্যস্ত রেখে ক্ষুদ্র বিষয়গুলোকে অবহেলা করো না। কারণ তোমার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্ৰ আনুকূল্যগুলোও তাদের অনেক উপকারে আসতে পারে ।
সেনাবাহিনীর কমান্ডারগণ তোমার কাছে এমন মর্যাদা সম্পন্ন হবে যেন তারা তাদের অধীনস্থগণকে ন্যায়ানুগ সাহায্য করে এবং তাদের পরিবারের দুঃখ-দুৰ্দশা মোচন করতে অর্থ ব্যয় করে। এতে সাধারণ সৈন্যদের নানাবিধ উদ্বিগ্নতা থাকবে না এবং তারা শুধু শত্রুর সাথে লড়াই করার জন্য একাগ্র থাকবে। তাদের প্রতি তোমার দয়াদ্রতা তাদের মনে তোমার প্রতি ভালোবাসার উদ্রেক করবে। একজন শাসকের জন্য সব চাইতে আনন্দদায়ক বিষয় হলো ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও প্রজাদের ভালোবাসা অর্জন করা। প্রজাদের মন পরিষ্কার হলেই তাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে । তাদের শুভেচ্ছা কেবলমাত্র তখনই সঠিক হবে যখন তারা তাদেরকে রক্ষা করার জন্য কমান্ডারের চারপাশে ভিড় করে। তাদের পদমর্যাদাকে কখনো বোঝা মনে করো না এবং তাদের মেয়াদকাল সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে থেকে না। সুতরাং তাদের আশা-আকাঙখার প্রতি উদারমনা হয়ো, তাদের প্রশংসা করো এবং যারা ভালো কাজ করবে তাদের কাজের কথা বারবার বলো, কারণ ভালো কাজের প্রশংসা করলে বীরগণ আনন্দিত হবে এবং দুর্বলগণ সতেজ হয়ে উঠবে, ইনশাল্লাহ। তাদের প্রত্যেকের কৃতিত্বপুর্ণ কাজের জন্য প্রশংসা করো। এক জনের কৃতিত্ব অন্য জনের ওপর দিয়ে না এবং কর্মের তুলনায় কম পুরস্কার প্রদান করো না। উচ্চ পদমর্যাদার জন্য কারো ক্ষুদ্র কাজকে বড় করে প্রকাশ করো না এবং নিম্ন পদমর্যাদার বলে কারো বৃহৎ কাজকে ক্ষুদ্র বিবেচনা করো না।
যে সমস্ত ব্যাপার তোমাকে উদ্বিগ্ন করে এবং তোমার কাছে গোলমেলে মনে হয় সে বিষয়ে আল্লাহ ও তার রাসুলের আশ্রয় গ্রহণ করো। কারণ যাদেরকে মহিমান্বিত আল্লাহ সঠিক পথ দেখাতে চান তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, “ওহে, তোমরা যারা বিশ্বাস কর! তারা আল্লাহ্ ও রাসুল এবং যাদের কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে তাদের আনুগত্য কর; আর তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে বিবাদ উপস্থিত হলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের হাতে ছেড়ে দাও, যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ বিচারে বিশ্বাস কর (কুরআন-৪ঃ ৫৯) ।
আল্লাহর হাতে ছেড়ে দেয়া মানেই কুরআনের স্পষ্ট বিধান অনুযায়ী কাজ করা এবং রাসুলের হাতে ছেড়ে দেয়া মানেই তার সুন্নাহ অনুসরণ করা যাতে কোন মতদ্বৈধতা নেই।
২। বিচারপতি
জনগণের মধ্যে বিরোধ নিম্পত্তির জন্য তোমার মতে প্ৰজাগণের মধ্যে যে ব্যক্তি সব চাইতে সম্মানিত তাকে বিচারক মনোনীত করো। তার সামনে যেসব মামলা আসবে তাতে সে যেন ক্ষিপ্ত না হয় এবং বিরোধের বিষয়ে সে যেন উত্তেজিত না হয়। কোন ভুল বিষয়ে সে যেন জেদ না ধরে এবং যখন সে সত্য বিষয় বুঝতে পারে তখন যেন তা গ্রহণ করতে অসম্মত না হয়। সে যেন লোভের বশবর্তী না হয় এবং কোন বিষয়ের গভীরে না গিয়ে ভাসা-ভাসা জ্ঞান নিয়ে বিচার না করে । সন্দেহজনক বিষয়ে থেমে যাওয়া তার চলবে না—যুক্তিতর্কের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং বিরোধকারীদের ঝগড়া-তর্কে তার বিরক্ত হওয়া চলবে না। তাকে ধৈর্যের সাথে বিষয়ের গভীরে অনুপ্রবেশ করতে হবে এবং রায় প্রদান কালে চরম নির্ভিকতা প্রদর্শন করতে হবে। কোন পক্ষের প্রশংসা যেন তাকে উৎফুল্ল না করে তোলে। এ ধরনের লোক খুব
কমই পাওয়া যায়।
তারপর মাঝে মধ্যে তার রায় পরীক্ষা করে দেখো এবং তাকে সে পরিমাণ অর্থ পারিশ্রমিক দেবে যাতে সে অসৎ হবার জন্য কোন ওজর দেখাতে না পারে । এতে তার কোন প্রয়োজনে অন্যের কাছে হাত বাড়াবার প্রয়োজন থাকবে না। তাকে এমন পদবীতে ভূষিত করবে যাতে করে তোমার কোন অফিসার তার উপর কর্তৃত্ব করতে না পারে। এ বিষয়ে তীক্ষ দৃষ্টি রেখো, কারণ এ দ্বিন ইতোপূর্বে দুষ্ট ও দুনীতিপরায়ণদের হাতে বন্দি ছিল যখন আবেগের বশবর্তী হয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো এবং তাতে জাগতিক সম্পদ চাওয়া হতো ।
৩। নির্বাহী অফিসার
এরপর নির্বাহী অফিসারদের কর্মকাণ্ডের প্রতি নজর দিয়ো। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাদেরকে নিয়োগ করো। কখনো স্বজন-গ্ৰীতি ও কাউকে আনুকূল্য প্রদর্শন করে তাদের নিয়োগ করো না, কারণ এ দুটি জিনিসই অবিচার ও অন্যায়ের উৎস। অভিজ্ঞ এবং বিনয়ী দেখে তাদের নিয়োগ করো। যারা ধাৰ্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে এবং পূর্বে ইসলাম ধর্মে ছিল তারা অকলঙ্কিত সম্মানের অধিকারী। তারা লোভের বশবর্তী হয় না এবং কোন বিষয়ের পরিণামের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখে। তাদের বেতন এমনভাবে দেবে যাতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে পর্যাপ্ত জীবিকা নির্বাহ করতে পারে । এতে তারা নিজেদেরকে সৎপথে রাখতে পারবে এবং তাদের তত্ত্বাবধানে রক্ষিত সম্পদের প্রতি নজর দেবে না। এতে যদি তারা কখনো তোমার আদেশ অমান্য করে এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করে তবে তাতে তাদের কোন যুক্তি চলবে না। তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতি নজর রেখে তোমাকে রিপোর্ট দেয়ার জন্য কিছু সংখ্যক সত্যবাদী ও বিশ্বাসী লোক রেখো, কারণ তোমার গোপন সংবাদ রাখার কথা জানতে পারলে তারা সততা রক্ষা করতে ও জনগণের প্রতি সদয় হতে বাধ্য হবে। সহকারীগণ সম্পর্কে সতর্ক থেকে । যদি তাদের মধ্যে কেউ সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ করতে সাহস করে এবং তোমার গোপন সংবাদদাতার সংবাদে তা সত্য বলে জানা যায়। তবে তাই প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করো। তখন তুমি তাকে শারীরিক শাস্তি প্ৰদান করো এবং যা সে আত্মসাৎ করেছে তা উদ্ধার করে নিয়ো । এ রকম লোককে আমর্যাদাকর অবস্থানে নামিয়ে দিয়ো এবং আত্মসাতের অপরাধে তাকে ব্ল্যাকলিষ্ট করে দিয়ো এবং তার অপরাধের জন্য
অপমানের মালা তাকে পরিয়ে দিয়ো ।
৪ । রাজস্ব প্ৰশাসন
রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যে, রাজস্ব। (খারাজ) প্রদানকারীগণ যেন তাদের সম্পদে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। কারণ রাজস্ব দাতাদের উন্নতির ওপরই সমাজের অন্য সকলের উন্নতি নির্ভরশীল। রাজস্ব দাতাগণ ছাড়া অন্যরা উন্নতি লাভ করতে পারে না, কারণ জনগণ রাজস্ব ও রাজস্ব দাতাদের ওপর নির্ভরশীল। রাজস্ব আদায় অপেক্ষা চাষাবাদের প্রতি তোমাকে বেশি নজর দিতে হবে। কারণ চাষাবাদ ছাড়া রাজস্ব আদায় করা সম্ভব নয় এবং চাষাবাদ ছাড়া রাজস্ব দাবি করা মানেই জনগণকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া । এ রকম শাসন বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না।
যদি প্ৰজারা আরোপিত করা সহনীয় নয় বলে অভিযোগ করে অথবা রোগব্যাধি অথবা পানির অভাব অথবা পানির আধিক্য অথবা জমির অবস্থা পরিবর্তন অথবা বন্যা অথবা খরার কবলে পড়ে তবে তাদের কষ্টের কথা বিবেচনা করে কর মওকুফ করো যাতে তাদের কষ্ট লাঘব হয়ে অবস্থার উন্নতি হয়। প্রজাদের দুঃখ-দুৰ্দশা লাঘব করার জন্য রাজস্ব হার কমিয়ে দেয়াতে কখনো বিচলিত বা অসম্মত হয়ে না, কারণ এটা শাসকের জন্য এমন বিনিয়োগ যা প্রশংসা ছাড়াও দেশের সুখ-সমৃদ্ধি এবং শাসনকালকে সুখ-সমৃদ্ধি ও শান্তি-শৃংখলার মধ্যে রাখবে। এ বিনিয়ােগের কারণে তুমি তাদের শক্তির উপর আস্থা রাখতে পারবে এবং তাদের প্রতি দয়া দেখিয়ে যে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবে। সেজন্য তারা তোমার প্রতি আস্থাশীল থাকবে। এরপর অবস্থা এমনও হতে পারে যে তাদের সাহায্য তোমার প্রয়োজন হয়ে পড়বে। তখন তারা সানন্দে তা বহন করবে, কারণ সমৃদ্ধ হলে তারা যে কোন বোঝা বহন করতে সক্ষম হবে। কৃষকের দারিদ্র যে কোন দেশের ধ্বংস নিয়ে আসে। যখন কৃষকেরা দরিদ্র হয়ে পড়ে আর অফিসারগণ চাকরি বাঁচানোর জন্য করা আদায়ে তৎপর থাকে তখনই দেশে অসন্তোষ ও গোলযোগ দেখা দেয় ।
৫। কর্মচারীদের সংস্থাপন তারপর কর্মচারীদের প্রতি যত্নবান হয়ো। তাদের মধ্যে যে সর্বোত্তম তাকে তোমার কাজকর্ম
চালাবার ভার দিয়ো । তাদের মধ্যে যে উত্তম চরিত্রের এবং সম্মানের কারণে গর্বিত নয় এমন লোককে তোমার পলিসি ও গোপন বিষয় সংক্রান্ত পত্রের দায়িত্ব অর্পণ করো। তোমার অফিসারদের চিঠি-পত্ৰ তোমার সামনে তুলে ধরতে সে যেন কখনো গাফলতি না করে এবং ওই সব পত্রের সঠিক জবাব যেন তোমার পক্ষ থেকে পাঠায়। সে যেন তোমার পক্ষ থেকে ক্ষতিকারক কোন চুক্তি সম্পাদন না করে এবং তোমার বিরুদ্ধে যায় এমন চুক্তি প্রত্যাখ্যান করতে ব্যর্থ না হয়। কোন বিষয়ে সে যেন তার নিজের মৰ্যদার বিষয়ে বেমালুম না হয়, কারণ যে নিজের মর্যাদা বুঝতে পারে না সে অন্যের মর্যাদা মোটেই বুঝতে পারে না। এসব লোক নিয়োগ করতে শুধুমাত্র তোমার জানাশোনা, আস্থাবান ও তাদের প্রতি তোমার ভালো ধারণার উপর নির্ভর করো না, কারণ তুমি মুষ্টিমেয় ক্ষেত্রে তাদের দেখতে পেয়েছে। তাদের অনেকেই কৃত্রিম ভালো আচার-আচরণ দ্বারা তোমার মন জয় করতে পারে। কাজেই তোমার পূর্ববর্তী শাসন আমলে তাদের কর্মকাণ্ডের রেকর্ড দেখে তাদের নিয়োগ করো। জনসাধারণের কাছে যার সুনাম ও বিশ্বাসযোগ্যতার খ্যাতি রয়েছে তার অনুকূলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করো। এতে আল্লাহর প্রতি তোমার দৃঢ় প্রত্যয় প্রকাশ পাবে এবং তোমার ইমামের প্রতি ও শ্রদ্ধা প্ৰদৰ্শিত হবে । সরকারি কর্মকান্ডকে কয়েকটি ভাগ করে প্রত্যেক বিভাগের জন্য একজন প্রধান নিয়োগ করো। তাকে এমন হতে হবে যেন বড় বড় বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সে অযোগ্য না হয় এবং কাজের চাপে যেন সে হতবুদ্ধি হয়ে না পড়ে। সচিবদের ত্রুটি-বিচূতি যদি তুমি এড়িয়ে যাও তবে তোমাকে দায়ী করা হবে।
৬। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিগণ
এখন ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিগণ সম্পর্কে কিছু উপদেশ নাও। তারা দোকানদার হোক, ব্যবসায়ী হোক আর কায়িক শ্রমিক হোক তাদেরকে ভালো উপদেশ দিয়ো, কারণ তারা লাভের উৎস এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের যোগানদার। সুদূর এলাকা, পাহাড়-পর্বত-সমুদ্র যেখানে মানুষ যেতে সাহস পায় না। সেখান থেকে এরা দ্রব্য সামগ্ৰী নিয়ে আসে। এরা শান্তি প্রিয় এবং এদের কাছ থেকে বিদ্রোহের কোন ভয় নেই। এরা কখনো দেশদ্রোহী হয় না।
তোমার সামনে এদের কোন বিষয় উত্থাপিত হলে তা সমাধান করে দিয়ো এবং তোমার সীমানার যে কোন স্থানে তাদের যেতে দিয়ে। এর সাথে মনে রেখো, তাদের অধিকাংশই হীনমনা ও ধনলোভী। তারা বেশি মুনাফা অর্জনের লোভে মালপত্র মজুদ করে রাখে এবং অধিক মূল্যে পরে বিক্রি করে। এটা জনগণের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং ভারপ্রাপ্ত অফিসারদের জন্য কলঙ্ক । মালামালের মজুদদারী বন্ধ করে দিয়ো, কারণ আল্লাহর রাসুল এটা নিষিদ্ধ করেছেন। সঠিক দামে ও ওজনে রীতিমত মালামাল বিক্রি করতে হবে। এতে ক্রেতা ও বিক্রেতা কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হয় না। তোমার শাসনকালে যারা মজুদদারী করবে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ো, কিন্তু কঠোর শাস্তি নয়।
৭ । নিম্ন শ্রেণির লোক
নিম্ন শ্রেণির লোকদের ব্যাপারে আল্লাহকে স্মরণ করো এবং আল্লাহকে ভয় করো। এরা হলো সেই শ্রেণি যারা গরীব, দুঃস্থ, কপৰ্দকহীন ও আঁতুর। এশ্রেণি দুভাগে বিভক্ত – একদল অতৃপ্ত— অন্যদল ভিক্ষুক। এদের প্রতি আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করতে যত্নবান হয়ো। তা না করলে আল্লাহর কাছে তুমি দায়ী হবে। তাদের জন্য সরকারি কোষাগার থেকে ভাতা নির্ধারণ করে দিয়ে এবং প্রত্যেক এলাকার শস্য থেকে ভাতা নির্ধারণ করে দিয়ো এবং যা যুদ্ধ লব্ধ হয় তার একটা অংশ নির্ধারণ করো দিয়ে। কারণ এতে নিকটবর্তী ও দূরবর্তীগণ সমান অংশ পাবে। সব লোকের দায়িত্ব তোমার হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। সুতরাং জাকজমকে গা এলিয়ে দিয়ে এদের কথা ভুলে যেয়ো না এবং এদের কাছ থেকে দূরে সরে থেকো না। এটা ক্ষুদ্র বিষয় হলেও এড়িয়ে গিয়ে ক্ষমা পাবে না, করণ এর চাইতে অনেক বড় সমস্যার সিদ্ধান্ত তুমি গ্রহণ করবে। ফলে তাদের প্রতি কখনো অমনোযোগী হয়ে না অথবা অহম বশত তাদের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে না। যারা সহজে তোমার কাছে আসতে পারে না অথবা মানুষ যাদের নিচ বলে মনে করে তাদের ব্যাপারে যত্নবান হয়ো। তাদের অবস্থা দেখা-শুনার জন্য এমন কিছু লোক নিয়োগ করো যারা বিনয়ী ও খোদাভীরু । এ সব লোক তাদের প্রকৃত অবস্থা সঠিকভাবে তোমাকে অবহিত করবে। তাদের বিষয়াবলী নিষ্পত্তি করতে আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত দায়িত্বের কথা মনে রেখো। কারণ এ দায়িত্বের জন্য তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে যখন তুমি তার সাক্ষাতে যাবে। মনে রেখো, প্রজাদের মধ্যে এরা সব চাইতে বেশি ন্যায়াচরণ পাবার দাবি রাখে। একই সাথে অন্যদের অধিকারও পূর্ণ করে দিয়ো যাতে আল্লাহর কাছে হিসাব দিতে পার। এতিম ও বৃদ্ধ যাদের জীবিকার্জনের কোন উপায় নেই। অথচ তারা ভিক্ষাবৃত্তিও গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। এদের প্রতি বিশেষ যত্নবান হয়ো। এ দায়িত্ব অফিসারদের ওপর গুরুভার; বস্তুত প্রত্যেক অধিকার ও দয়িত্ব এক একটা গুরুভার। যারা পরকালের পুরস্কার চায় তাদের জন্য আল্লাহ এ দায়িত্ব হালকা করেছেন এবং তাদের প্রতি আল্লাহ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার সত্যতা সম্বন্ধে আস্থা রেখো। প্রজাদের নালিশ শোনার জন্য একটা সময় নির্ধারণ করে নিয়ো। ওই সময়ে মনোযোগ সহকারে এবং সর্বসাধারণের সামনে প্রকাশ্যে তাদের অভিযোগ শ্রবণ করো। এ সময়ে তোমার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কথা স্মরণ করে বিনয়ী অবস্থায় থেকো। যখন তুমি প্রজাদের অভিযোগ শোনবে তখন তোমার কোন সৈন্যবাহিনীর সদস্যকে ধারে কাছে রেখো না। এতে করে মানুষ যা বলতে এসেছে তা নিদ্বিধায় ও নিঃশঙ্ক চিত্তে বলতে পারবে। আমি একাধিক স্থানে আল্লাহর রাসুলকে বলতে শুনেছি, যে জনগোষ্ঠীতে দুর্বলের অধিকারে সবলেরা নিরাপত্তা প্ৰদান করে না এবং দুর্বলদের শঙ্কাহীন করে না, সে জনগোষ্ঠী কখনো পবিত্রতা অর্জন করতে পারবে না। কোন কিছু বলতে তাদরে অক্ষমতা ও প্রতিবন্ধকতা সহ্য করে নিয়ো। এজন্য আল্লাহ তার রহমতের ছায়া তোমার ওপর ছড়িয়ে দেবেন এবং তার অনুগত্যের জন্য মহাপুরস্কার তোমার জন্য নির্ধারণ করে দেবেন। যা কিছু তুমি দান কর না কেন, প্রফুল্ল মনে দান করো। কিন্তু যখন তুমি দান করতে পারবে না এবং যাচনাকারীকে ফিরিয়ে দাও তখন ভালোভাবে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে ফিরিয়ে দিয়ো । এরপর আরো কিছু কাজ থেকে যাবে যা তুমি নিজ হাতে সম্পাদন করবে। উদহারণ স্বরূপ, তোমার অফিসারদের পত্রের জবাব, যদি তোমার সচিবগণ তা করতে সক্ষম না হয়, অথবা জনগণের অভিযোগ নিম্পত্তিকরণ যা তোমার সহকারীগণ করতে শঙ্কিত হয় । দিনের কাজ দিনেই শেষ করো কারণ প্রতিদিনই নির্ধারিত কাজ আছে। দিনের উত্তম ও বেশির ভাগ ইবাদতের জন্য নির্ধারিত রেখো; যদিও প্রতিটি কাজই আল্লাহর কাজ যখন নিয়্যত পবিত্র হয় এবং প্রজাদের মঙ্গলের জন্য হয়।
আল্লাহর ধ্যান তোমার বিশেষ দায়িত্বগুলো পালন ও পূর্ণ করা। সুতরাং দিনে ও রাতে কিছু শারীরিক কসরত দ্বারা আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হয়ো। তুমি আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য যা কিছু কর না কেন তা হতে হবে পরিপূর্ণ, ত্রুটিহীন ও ঘাটতিবিহীন। এটা করতে যতই শারীরিক কষ্ট হোক না কেন তাতে পিছপা হয়ো না। যখন তুমি নামাজে ইমামতি করবে তখন মনে রাখবে, তা যেন এত লম্বা না হয় যাতে মানুষ অস্বস্তি অনুভব করে। আবার এমন খাটে যেন না হয় যাতে তা পণ্ড হয়ে যায়। কারণ তোমার পিছনে এমন লোকও থাকতে পারে যে রুগ্ন অথবা যার নিজের কিছু জরুরী প্রয়োজন রয়েছে। যখন আল্লাহর রাসুল আমাকে ইয়েমেন প্রেরণ করেছিলেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিভাবে তাদের সাথে নামাজ আদায় করবো। তিনি বলেছিলেন, “এমনভাবে সালাত কায়েম করো যাতে তাদের মধ্যকার সবচাইতে
দুর্বল ব্যক্তিও তা করতে পারে এবং ইমানদারগণের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ো।”
শাসকের আচরণ ও কর্ম সম্পর্কে
দীর্ঘ সময় ব্যাপী নিজকে জনগণ থেকে দূরে সরিয়ে রেখো না। কারণ যারা প্রশাসনের কর্তৃত্ব প্রাপ্ত তারা জনগণের কাছ থেকে সরে থাকা অদূরদর্দশীতার পরিচায়ক এবং এতে জনগণ তাদের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে অনবহিত থেকে যায়। জনগণ থেকে দূরে সরে থাকলে তারা যা জানে না সে বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতে পারে না। ফলে তারা ছোট ছোট বিষয়গুলোকে বড় এবং বড় বড় বিষয়গুলোকে ছোট মনে করে ভুল পথে চলতে থাকে। তারা ভালোকে মন্দ এবং মন্দকে ভালো মনে করে ভুল করতে পারে। এ সবের ফলে সত্য বিষয়ে মতদ্বৈধতা দেখা দেয় এবং অসত্য প্রচলিত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। মোটের উপর শাসকও একজন মানুষ; কাজেই জনগণ যা তার কাছে গোপন রাখে তা সে জানতে পারে না । সত্যের বিভিন্ন প্রকাশকে মিথ্যা থেকে আলাদা করার জন্য কোন সুস্পষ্ট রং বা আলেখ্য নেই। এতে দুপ্রকার মানুষের মধ্যে তুমি এক প্রকার হতে পার। হয় তুমি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় উদার হতে পার, সে ক্ষেত্রে তোমার দায়িত্ব ও কর্ম সঠিকভাবে সম্পাদন করে কেন তুমি জনগণের কাছ থেকে আত্মগোপন করে থাকবে? অথবা তুমি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কার্পণ্য প্রদর্শন করতে পারে, সেক্ষেত্রে জনগণ। হতাশ হয়ে পড়বে, যেহেতু তোমার কাছ থেকে উদার ব্যবহার পাওয়ার আর কোন আশা তাদের থাকবে না। তাসত্ত্বেও তোমার কাছে জনগণের এমন সব প্রয়োজন রয়ে গেছে যা তোমাকে কোন প্রকার অভাব-অনটন বা কষ্টে ফেলবে না; যেমন— অত্যাচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ বা কোন বিষয়ে ন্যায় বিচারের আবেদন । একজন শাসকের কিছু প্রিয় লোক থাকে যারা সহজে তার কাছে যেতে পারে। এরাই সচরাচর জনগণের সম্পদ আত্মসাৎ করে। এরা উদ্ধত ও স্বেচ্ছাচারী হয় এবং এরা কোন বিষয়ে ন্যায়ের তোয়াক্কা করে না। এসব পাপাচারের মূলোৎপাটন তোমাকে করতে হবে এবং এ ধরনের লোকদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে। তোমার সমর্থক অথবা যারা তোমার পিছনে পিছনে ঘুরে তাদের কখনো জমি মঞ্জর করো না। তারা যেন তোমার কাছে থেকে জমির দখল আশা করতে না পারে যা পার্শ্ববর্তী লোকদের চাষাবাদ, সেচ ও অন্যান্য কাজে ক্ষতি সাধন করতে পারে। এসব লোকদের জমি দিলে তোমার কোন উপকার হবে না এবং যারা অসুবিধায় পড়বে তারা তোমাকে দোষারোপ করবে এবং পরকালেও তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে। প্রত্যেককে তার প্রাপ্যতা অনুসারে প্রাপ্য পরিশোধ করো, সে যে কেউ হোক না কেন— হোক সে তোমার নিকট আত্মীয় অথবা দূরবর্তী কোন লোক। এ কাজে তোমাকে সহিষ্ণু ও সর্তক হতে হবে। যদিও এতে তোমার আত্মীয় অথবা কোন প্রিয় ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা তোমার জন্য বেদনাদায়ক হতে পারে। কিন্তু এর ফলে তোমার জন্য যা বিনিময় আসবে তা অতি সুন্দর (সুনাম ও আল্লাহর পুরস্কার ) । যদি প্রজারা তোমাকে উদ্ধত ও স্বেচ্ছাচারী মনে করে তবে খোলাখুলিভাবে তাদের কাছে তোমার অবস্থা বর্ণনা করো এবং তোমার ব্যাখ্যা দ্বারা তাদের সন্দেহ দূর করার চেষ্টা করো। কারণ এ ব্যাখ্যা তোমার আত্মার প্রশান্তি আনবে এবং প্রজাদেরকে সত্য উপলব্ধি করতে সহায়তা করবে।
যদি তোমার শত্রু শান্তি স্থাপনের আহবান জানায় তবে তাতে সাড়া দিয়ো-আহবান বাতিল করে
দিয়ে না। শান্তি স্থাপনে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া যায়। শান্তি স্থাপিত হলে তোমার সৈন্যবাহিনী বিশ্রাম পাবে, তুমি উদ্বিগ্নতা থেকে নিস্তার পাবে এবং তোমার দেশ নিরাপদ থাকবে। একটা বিষয় মনে রেখো, শান্তি স্থাপনের পর শত্রুর আক্রমণের ভয় বেশি। কারণ শত্রু অনেক সময় অবহেলার সুযোগ গ্রহণ করার জন্য শান্তির প্রস্তাব দেয়। কাজেই এদিকে সতর্ক থেকে এবং এ ব্যাপারে গা এলিয়ে দিয়ে না। যদি কখনো শত্রুর সংগে কোন ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হও তবে চুক্তির শর্ত মেনে চলো এবং বিশ্বস্ততার সাথে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করো। তোমার প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য নিজকে বর্ম করে রেখো। কারণ মানুষের মধ্যে ধ্যান-ধারণা, আদর্শ ও মতের পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু প্রতিশ্রুতি পালনকারীর প্রতি সকলেরই সম্মানবোধ থাকে এবং আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ। শুধু মুসলিম নয়, কাফেরগণ পর্যন্ত চুক্তির শর্ত মেনে চলে, কারণ চুক্তিভঙ্গের মারাত্মক পরিণতি তারা অনুধাবন করতে পেরেছিল। সুতরাং শক্রকে প্রতারণা করো না, কারণ অজ্ঞ ও পাপাচারী ছাড়া কেউ আল্লাহকে অসন্তষ্ট করে না। আল্লাহ তার চুক্তি ও প্রতিশ্রুতিকে তার বান্দাদের ওপর দয়া ও ক্ষমার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে নিরাপত্তা দান করেছেন, যার মধ্যে তারা নিরাপদে বাস করে এবং তাঁর নৈকট্যের সুফল অনুসন্ধান করে। সুতরাং প্রতিশ্রুতিতে কোন প্রকার প্রবঞ্চনা, চাতুর্য বা কুটবুদ্ধি থাকতে পারবে না।
এমন কোন চুক্তি করো না যার অন্য কোন ব্যাখ্যা হতে পারে অর্থাৎ চুক্তিতে দ্ব্যর্থক কথা ব্যবহার করো না। চুক্তি সম্পাদন সমাপ্ত হবার পর এর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা পরিবর্তন করো না। যদি আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা কোন চুক্তিতে তুমি কোন দুৰ্দশাগ্ৰস্থ হও তবুও যথেষ্ট যৌক্তিকতা ব্যতীত তা বাতিল করো না। কারণ গোলযোগ অপেক্ষা কষ্ট সহ্য করা অধিকতর ভালো। গোলযোগের পরিণতি ভয়াবহ এজন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে এবং ইহকাল ও পরকালে এর জন্য ক্ষমা পাবে না।
যথেষ্ট যৌক্তিকতা ছাড়া রক্তপাত এড়িয়ে যেয়ো। কারণ আল্লাহর মহাশাস্তি আমন্ত্রণে, কুপরিণতি আনয়নে, সমৃদ্ধির পথে বাধা দিতে ও জীবন-পথকে খাট করে দিতে অহেতুক রক্তপাতের কোন জুড়ি নেই। শেষ বিচারের দিনে মহিমান্বিত আল্লাহ রক্তপাতের ঘটনা দিয়ে তাঁর বিচার কার্য শুরু করবেন। সুতরাং তোমার সরকারকে শক্তিশালী এবং ক্ষমতাকে সুসংহত করার জন্য নিষিদ্ধ রক্তপাত ঘটিয়ে না। কারণ অহেতুক রক্তপাত কর্তৃত্ব দুর্বল ও ক্ষীণ করে ধ্বংসের দিকে নিয়ে ক্ষমতার বদল ঘটায়। ইচ্ছাকৃত হত্যার জন্য তুমি আল্লাহর অথবা আমার সম্মুখে কোন কৈফিয়ত দিতে পারবে না। কারণ এ ধরনের কাজে অবশ্যই প্রশ্ন বা প্রতিশোধ নেয়ার বিষয় থাকে। যদি তুমি ভুল বশত অথবা তোমার তরবারি সম্বরণ করতে না পেরে অথবা শাস্তি প্ৰদানে কঠোর হয়ে কাউকে হত্যা কর। তবে তোমার ক্ষমতার দম্ভ যেন তার উত্তরাধিকারীদেরকে ক্ষতিপূরণ প্ৰদান থেকে বিরত না করে।
তোমার মধ্যে যেসব ভালো গুণ আছে তা ভেবে কখনো আত্মগৌরব ও আত্মপ্রশংসা অনুভব করো না এবং মানুষের অতিরঞ্জিত প্রশংসায় আত্মপ্রসাদ লাভ করো না। কারণ ধাৰ্মিকদের ভালো কাজগুলো পণ্ড করে দেয়ার জন্য এটা হচ্ছে শয়তানের একটা মোক্ষম সুযোগ। প্রজাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যেসব কল্যাণকর কাজ তুমি করবে তা তাদরেকে দেখিয়ে দেয়া অথবা নিজের কাজের প্রশংসা করা অথবা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভঙ্গ করা এড়িয়ে যেয়ো। কারণ দায়িত্ব পালন করে অন্যকে মনে করিয়ে দেয়া ভালো কাজের সুফল নষ্ট করে দেয়; আত্মপ্রশংসা সত্যের আলো কেড়ে নিয়ে যায় এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী আল্লাহ ও মানুষের ঘূণা অর্জন করে। মহিমান্বিত আল্লাহ বলেন, “তোমরা যখন যা বল তা না করাটাই আল্লাহর কাছে সব চাইতে অপছন্দনীয়।”
সময় হবার আগেই কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তড়িঘড়ি করো না। আবার সময় হয়ে গেলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে শৈথিল্য করো না। কোন কাজের পরিণাম অনুধাবন করতে না পারলে তা করতে জেদ ধরো না। আবার পরিণাম অনুধাবন করতে পারলে দুর্বল হয়ে পড়ো না। প্রত্যেক কাজ যথাসময়ে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ও যথাস্থানে করতে যত্নবান হয়ো ।
যেসব বিষয়ে সবার সমান অংশ রয়েছে তা নিজের জন্য সংরক্ষিত করে রেখো না । অন্যের জন্য তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে, এ অজুহাতেও সবার প্রকাশ্য বিষয় নিজের জন্য সংরক্ষিত করো না। সহসাই তোমার দৃষ্টি থেকে সকল বিষয়ের পর্দা উন্মোচিত হবে এবং মজলুমের দুঃখ দূর করার জন্য তোমার দরকার হবে। আত্মসম্মান বোধ, ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ, বাহুবল ও জিহবার তীক্ষতার ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখো। কোনো কিছুতে তাড়াহুড়া করো না, ক্ৰোধ প্রশমিত না হওয়া পর্যন্ত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে বিলম্ব করো এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ শক্তি অর্জন করো। যে পর্যন্ত আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন বিষয়টি সর্বদা তোমার মনে জাগারুক না হবে সে পর্যন্ত তুমি এসব গুণ অর্জন করতে পারবে না।
তোমাকে স্মরণ করতে হবে যে, তোমার পূর্ববর্তীগণ তাদের কর্মকাণ্ড কিভাবে চালিয়েছে। এটা একটা সরকার হতে পারে, অথবা একটা মহৎ ঐতিহ্য হতে পারে অথবা আমাদের রাসুলের (সঃ) নজির হতে পারে অথবা আল্লাহর পবিত্র গ্রন্থে বিধৃত কোন অবশ্যপালনীয় আদেশ হতে পারে। তুমি সেগুলোকে এমনভাবে মানবে যেমন করে আমরা সেগুলোকে মেনে চলেছি। একইভাবে এ দলিলে আমি তোমাকে যা আদেশ করেছি তা তুমি পালন করো। যদি তোমার হৃদয় কামনা-বাসনার দিকে ঝুকে পড়ে তবে এ দলিল তোমাকে ফিরিয়ে রাখতে সহায়তা করবে। তুমি যেন সত্যের পথে সুদৃঢ় থাকতে পার সে জন্য
আমি তোমার প্রতি আমার কর্তব্য পালন করলাম ।
আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন তোমাকে ও আমাকে তার হেদায়েতর পথে সুদৃঢ় থাকার তৌফিক দান করেন। তাঁর সন্তুষ্টি ও তাঁর বান্দাদের কল্যাণ সাধন এবং দেশের সমৃদ্ধি সাধনই যেন আমাদের সকলের কাজের লক্ষ্য হয় । তিনি যেন তোমাকে ও আমাকে শাহাদাত বরণ করার সৌভাগ্য দান করেন। নিশ্চয়ই, আমরা তার কাছেই প্রত্যাবর্তন করবো। আল্লাহর রাসুল ও তাঁর বংশধরগণের ওপর দরূদ ও সালাম । এখানেই শেষ করলাম ।
১ । এ দলিলখানাকে ইসলামি সমাজের গঠনতন্ত্র বলা যেতে পারে। এ দলিলখানা এমন এক ব্যক্তি লেখেছিলেন যিনি ঐশী বিধান পালন করতেন। আমিরুল মোমেনিনের এ দলিল থেকে তাঁর দেশ শাসনের প্রকৃতি সহজেই অনুমান করা যায় এবং তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল আল্লাহর দ্বীন কায়েম করা ও সমাজের উন্নতি সাধন করা। তিনি জনগণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা, লুটপাট করে রাজকোষ ভরে তোলা অথবা ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা না করে রাষ্ট্রের সীমানা বর্ধিত করার পক্ষপাতী ছিলেন না। যে সব সরকার জাগতিক বিষয়ে লোলুপ, তারা তাদের সুবিধা অর্জনের মতো করে গঠনতন্ত্র তৈরী করে এবং তাদের জাগতিক স্বাৰ্থ হাসিলের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে এমন সব আইন-কানুন বদল করে ফেলে। কিন্তু আমিরুল মোমেনিনের এ দলিল সর্বসাধারণের স্বাৰ্থ রক্ষার জিম্মাদার এবং সমষ্টিগত সংগঠনের রক্ষক। এটা নির্বাহকরণে স্বার্থপরতার কোন ছোয়াচ নেই। আল্লাহর প্রতি দায়িত্ব পালনের মৌলনীতি এতে বিধৃত রয়েছে। কোন ধর্ম বা গোত্র আলাদা না করে মানুষের অধিকার সংরক্ষণের নীতি এতে রয়েছে। এতে রয়েছে দরিদ্র ও দুঃস্থের প্রতি যত্ন নেয়ার বিধান, নিচ ও অবহেলিতদের বাচার উপায়, শান্তি, নিরাপত্তা সমৃদ্ধি ও মানুষের কল্যাণ। এক কথায় অধিকার ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার পূর্ণ দেশনা এতে রয়েছে।
৩৮ হিজরি সনে যখন মালিক ইবনে হারিছ। আশতারকে মিশরের গভর্নর নিয়োগ করা হয়েছিল তখন আমিরুল মোমেনিন তাকে এটা লেখেছিলেন। আমিরুল মোমেনিনের প্রধান সহচরদের মধ্যে মালিক আশ্যতার অন্যতম। তিনি আমিরুল মোমেনিনের প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস এবং ধৈর্য ও দৃঢ়তা দেখিয়েছিলেন।
আমিরুল মোমেনিনের আচরণ ও প্রকৃতি অনুসরণ করে তিনি তাঁর নৈকট্য ও সংশ্ৰব লাভ করেছিলেন এবং একজন পরিপূর্ণ মানবে পরিণত হয়েছিলেন। আমিরুল মোমেনিনের এ কথা থেকে তার অবস্থান সহজে নির্ণয় করা যায়“আমি আল্লাহর রাসুলের কাছে যেরূপ ছিলাম মালিক আমার কাছে তদ্রুপ” (হাদীদ”**, ১৫শ খণ্ড, পৃঃ ৯৮; খায়াত”, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃঃ ১৩১)। মালিকও স্বার্থহীনভাবে আমিরুল মোমেনিনের পক্ষে সকল যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে আমিরুল মোমেনিনের বাহু হিসাবে নিজকে প্রমাণ করেছেন। তিনি এরূপ সাহস ও বীরত্ব দেখিয়েছিলেন যে, সারা আরবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এ বীরত্বের সাথে তিনি ছিলেন অসীম ধৈর্য ও ক্ষমার মূর্তপ্রতীক। ওয়াররাম ইবনে আবি ফিরাছ আন-নাখাই লেখেছেন যে, একদিন মালিক কুফার বাজার দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার গায়ের কাপড় ও মাথার পাগড়ি ছিল চটের। একজন দোকানদার তাকে দেখে তার গায়ে পচা পাতা নিক্ষেপ করেছিল। এ নোংরা ব্যবহারে তিনি কিছু মনে করেন নি। এমনকি লোকটির দিকে ফিরেও না তাকিয়ে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। এক ব্যক্তি দোকানদারকে বললো, “কাকে তুমি অপমান করলে তা কি জান?” দোকানদার বললো, “না, আমি চিনি না।” লোকটি বললো, “ইনিই আমিরুল মোমেনিনের সহচর— মালিক আশ্যতার।” এ কথা শোনা মাত্রই লোকটি পিছুপিছু দৌড়াতে লাগলো। ততক্ষণে মালিক মসজিদে প্রবেশ করে সালাত আদায় করতে শুরু করেছেন। সালাত শেষে লোকটি মালিকের পায়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে তার অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে লাগলো। মালিক লোকটিকে তুলে ধরে বললেন, আল্লাহর কসম, তোমার জন্য ক্ষমা চাইতেই আমি মসজিদে প্রবেশ করেছি। আমি তোমাকে সেই মুহুর্তেই ক্ষমা করে দিয়েছি এবং আশা করি আল্লাহও তোমাকে ক্ষমা করবেন।
(ফিরাস”, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২৫ মজলিসী***, ৪২ তম খণ্ড, পৃঃ ১৫৭) আরবের বিখ্যাত একজন বীর যার নামে শত্রুর বুক কেঁপে উঠতো তার আচরণ ও ধৈর্য এমন ছিল। এ বিষয়ে আমিরুল মোমেনিন বলেছিলেন, সে ব্যক্তিই সব চাইতে বীর যে নিজের কামনা-বাসনা, ক্রোধ ও অহমবোধকে পরাভূত করতে পেরেছে।
এসব চরিত্র বৈশিষ্ট্য এবং গুণাবলী ছাড়াও প্রশাসন এবং সংগঠনে তার যথাৰ্থ বুৎপত্তি ছিল। যখন উসমানি পার্টি (উসমানিয়া) মিশরে ফেতনা-ফাসাদ ও বিদ্রোহ করে আইন শৃংখলা বিনষ্ট করে এবং দেশটাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছিলো আমিরুল মোমেনিন তখন মুহাম্মদ ইবনে আবি বকরকে শাসনকর্তার পদ থেকে সরিয়ে মালিক আশতারকে তার স্থলে নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করলেন। এ সময় মালিক নাসিবিনের গভর্নর ছিলেন। যাহোক, আমিরুল মোমেনিন মালিককে নির্দেশ দিলেন তিনি যেন কাউকে তার স্থলে ডেপুটি হিসাবে পছন্দ করে আমিরুল মোমিনের কাছে চলে আসেন। আদেশ পাওয়া মাত্ৰ মালিক শাহবিব ইবনে আমির আজদীকে নাসিবিনের দায়িত্ব দিয়ে আমিরুল মোমেনিনের কাছে চলে এসেছেন। আমিরুল মোমেনিন তাকে নিয়োগ পত্র প্রদান করে মিশরের দিকে যাত্রা করতে আদেশ দিলেন এবং মিশরবাসীদের উদ্দেশ্যেও একটা নির্দেশ লেখে দিলেন যেন তারা মালিককে মান্য করে চলে। এ দিকে মুয়াবিয়া তার গুপ্তচরদের মাধ্যমে এ খবর পেয়ে হতবুদ্ধি হয়ে গেল, কারণ সে আমর ইবনে আসকে মিশরের গভর্নর করার আশা দিয়েছিলো এবং সেজন্য ইবনে আস তার সেবাদাসে পরিণত হয়েছিল। মুয়াবিয়া ভেবেছিল মুহাম্মদ ইবনে আবি বাবরকে পরাভূত করে মিশর দখল করা তার জন্য সহজ হবে। কিন্তু মালিকের নিয়োগের কথা শুনে তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল। কারণ মালিককে পরাস্থ করা মুয়াবিয়ার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠবে না। ফলে মিশর জয় করা দুরাশায় পর্যবসিত হবে। মুয়াবিয়া তার চিরাচরিত গুপ্ত হত্যার আশ্রয় গ্রহণ করতে মনস্থ করলো এবং মিশরের ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বেই মালিককে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আরিশ (কুলজুম) শহরের এক জমিদারের দ্বারস্থ হয়ে সমস্ত খাজনা মওকুফ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে বললো মালিক আরিশ দিয়ে যাবার সময় সে যেন মালিককে হত্যা করে। ফলে মালিক যখন সৈন্য-সামন্ত নিয়ে আরিশ পৌছলো তখন আরিশের প্রধান তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে তার মেহমান হবার অনুরোধ করলো। মালিক তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। খাবার পর মেজবান তাকে মধু মিশ্রিত শরবত পান করতে দিল যাতে বিষ মিশ্রিত ছিল। এ শরবত খাবার পরই বিষক্রিয়া দেখা দিল এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই এ মহাবীর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।
যখন মুয়াবিয়া জানতে পারলো যে তার চাতুর্যপূর্ণ কৌশল কৃতকার্য হয়েছে তখন সে আনন্দে ফেটে পড়লো এবং উল্লাসে বলতে লাগলো, “ওহে, মধুও আল্লাহর সৈনিক।” তারপর সে বক্তৃতায় বললো, “আলী ইবনে আবি
তালিবের দুই দক্ষিণ হস্তস্বরূপ দুটি লোক ছিল। এর একটি হলো আম্মার ইবনে ইয়াসির যাকে সিফফিনে হত্যা করা হয়েছে এবং অপরটি হলো মালিক আশ্যতার যাকে এখন হত্যা করা হলো।”
কিন্তু মালিক নিহত হবার সংবাদ পেয়ে আমিরুল মোমেনিন দারুণভাবে মর্মাহত হয়েছেন এবং দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তিনি বললেন, “মালিক! কে মালিক? যদি মালিক পাথর হতাে। তবে সে সুকঠিন ও প্রকৃত পাথর; যদি সে পাহাড় হতো। তবে সে সাদৃশ্যবিহীন মহৎ পাহাড়। মনে হয় তার মৃত্যু আমাকে জীবনহীন করে দিয়েছে। আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, তার মৃত্যু সিরিয়ানদের জন্য আনন্দের হলেও ইরাকিদের জন্য অপমানজনক। এ রকম আরেকটা মালিক প্রসব করতে মহিলারা বন্ধ্যা হয়ে গেছে” (তাবারী ‘, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩৩৯২-৯৫; আছীর, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ৩৫২-৫৩; ইয়াকুবী’, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৯৪; বার”, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ১৩৬৬; হাদীদ *** ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃঃ ৭৪-৭৭; কাহীর’, ৭ম খণ্ড, পৃঃ ৩১৩-৩১৪; ফিন্দা”, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১৭৯)।