আবু বকর কর্তৃক খেলাফত দখলের পর আব্বাস ও আবু সুফিয়ান খেলাফতের জন্য আমিরুল মোমেনিনকে সাহায্য করার প্রস্তাব করায় এ খোৎবা প্রদান করেন।
হে জনমন্ডলী*!
ফেতনার তরঙ্গ মাঝে শক্ত হাতে হাল ধরে মুক্তির নৌকা চালিয়ে যাও; বিভেদের পথ থেকে ফিরে এসো; এবং অহংকারের মুকুট নামিয়ে ফেলো। সে ব্যক্তি সফলকাম, যে ডানার সাহায্যে উড়ে (যখন তার ক্ষমতা থাকে) অথবা সে শান্তিপূর্ণভাবে থাকে এবং তাতে অন্যরা সুখে-শান্তিতে থাকতে পারে। এটা (খেলাফতের লালসা) পঙ্কিল পানি অথবা শক্ত খাদ্য টুকরার মতো— যে কেউ গলাধঃকরণ করলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাবে। যে ব্যক্তি পাকার আগেই ফল তোলে সে ওই ব্যক্তির মতো, যে অন্যের জমিতে চাষাবাদ করেছে।
যদি আমি বলেই ফেলি (খেলাফতের কথা) তবে তারা আমাকে বলবে ক্ষমতালোভী; আর যদি আমি নিশূপ হয়ে থাকি তবে তারা বলবে আমি মৃত্যুর ভয়ে ভীত। দুঃখের বিষয় এই যে, সকল উত্থানপতনের মধ্যেও আমি টিকে আছি। আল্লাহর কসম, আবু তালিবের পুত্ৰ মৃত্যুর সাথে এমনভাবে পরিচিত যেমন একটি শিশু তার মায়ের স্তনের সাথে । আমি নীরব রয়েছি আমার গুপ্ত জ্ঞানের কারণে যা আমাকে দান করা হয়েছে। যদি আমি তা প্রকাশ করি তবে গভীর কূপ থেকে পানি উত্তোলনরত রশির মতো তোমরা কাপতে থাকবে ।
১। রাসুলের (সঃ) ইনতিকালের সময় আবু সুফিয়ান মদিনায় ছিল না। তার গন্তব্যে যাবার পথিমধ্যে সে রাসুলের (সঃ) দেহত্যাগের খবর শুনে মদিনায় ফিরে এসেছিল। মদিনায় আসা মাত্রই সে জানতে চাইল কে নেতা মনোনীত হয়েছে। তাকে বলা হলো যে, জনগণ আবু বকরের বায়াত গ্রহণ করেছে। এটা শোনামাত্রই আরবের চিহ্নিত কলহ-পসারি এ লোকটি গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হলো এবং তৎক্ষণাৎ আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালিবের কাছে গিয়ে বললো, “দেখ, এসব লোকেরা ফন্দি করে বনি তায়েমের হাতে খেলাফত হস্তান্তর করে দিয়েছে এবং বনি হাশিম চিরতরে বঞ্চিত হলো। এ ব্যক্তি (আবু বকর।) তার পরে বনি আদির কোন উদ্ধত ব্যক্তিকে আমাদের মাথার ওপর বসিয়ে দেবে। চল, আমরা আলী ইবনে আবি তালিবের নিকট যাই এবং তার অধিকার আদায়ের জন্য ঘর থেকে বের হয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বলি।” এরপর সে আব্বাসকে সঙ্গে নিয়ে আলীর কাছে এসে বললো, “আপনার হাত দিন— আমি বায়াত গ্রহণ করি এবং যদি কেউ এর বিরুদ্ধাচরণ করে তবে পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য দিয়ে আমি মদিনার রাস্তা ভরে দেব।” এ মুহূর্তটুকু আমিরুল মোমেনিনের জন্য অত্যন্ত নাজুক ছিল। তিনি নিজকে রাসুলের সত্যিকার উত্তরাধিকারী মনে করতেন। তদুপরি, আবু সুফিয়ানের মতো গোত্র-নেতা তার গোত্রসহ তাকে সমর্থন দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। এ অবস্থায় যুদ্ধের শিখা জ্বলিয়ে দেয়ার জন্য একটা ইঙ্গিতই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু আমিরুল মামোমেনিনের দূরদর্শিতা ও সঠিক বিচার ক্ষমতা মুসলিমগণকে গৃহযুদ্ধ থেকে রক্ষা করেছিল। তাঁর সুতীক্ষ্ম দৃষ্টিতে ধরা পড়লো যে, এ ব্যক্তি গোত্রীয় আবেগ ও কৌলন্যের ধুয়া তুলে গৃহযুদ্ধ ঘটাতে চায় যাতে প্রবল আলোড়নে ইসলামের মূলভিত্তি আলোড়িত হয়ে পড়ে। আমিরুল মোমেনিন। তাই তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এবং তাকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিলেন। মানুষ যেন কলহ সৃষ্টির প্রস্তাব নিয়ে তার কাছে আসতে না পারে সে জন্য তিনি তাঁর অবস্থা সম্পর্কে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে বলেন যে, তার জন্য শুধুমাত্র দুটি পথই খোলা ছিল— হয় অস্ত্রধারণ করা, না হয় নিশ্চপ ঘরে বসে থাকা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, যুদ্ধে নামলে তাঁর কোন সমর্থক থাকবে না; ফলে তিনি বিদ্রোহ দমন করতে পারবেন না। কাজেই নিশ্চঞ্চুপ থেকে অনুকূল অবস্থা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পথ তিনি বেছে নিয়েছিলেন।
এ পর্যায়ে আমিরুল মোমেনিনের নীরবতা তাঁর দূরদর্শিতা ও উচ্চমানের পলিসির ইঙ্গিতবহ । কারণ সে সময় মদিনা যুদ্ধকেন্দ্রে পরিণত হলে এর শিখা ছড়িয়ে পড়ে সারা আরবকে গ্রাস করে ফেলতো। মুহাজের ও আনসারদের মধ্যে যে বিরোধ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল তা চরমে ওঠে যেতো এবং মোনাফেকগণের খেলার ষোলকলা পূর্ণ হতো। এতে ইসলামের তরী এমন এক জলঘূর্ণিতে পড়ে যেতো যার সমতা সাধন করা কষ্টসাধ্য হতো। এসব চিন্তা করে আমিরুল মোমেনিন অভাবনীয় দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। কিন্তু হস্ত উত্তোলন করেন নি। ইতিহাস সাক্ষ্য বহন করে যে, মব্ধি জীবনে রাসুল (সঃ) বিভিন্ন প্রকার দুঃখ কষ্ট সহ্য করেছিলেন। কিন্তু তিনি ধৈর্য পরিহার করে সংগ্রাম ও বিরোধে লিপ্ত হন নি। কারণ তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, সে সময় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে ইসলামের প্রসার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অবশ্য, যখন তাঁর সমর্থক ও সাহায্যকারীর সংখ্যা আল্লাহ দ্রোহীদের দমনে যথেষ্ট বিবেচিত হলো তখন তিনি শত্রুর মুখোমুখি হলেন। অনুরূপভাবে আমিরুল মোমেনিন রাসুলের জীবনকে আলোক বর্তিকা হিসেবে গ্রহণ করে শক্তি প্রদর্শনে বিরত ছিলেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সমর্থক ও সাহায্যকারী ছাড়া শত্রুর মোকাবেলা করলে জয়ের পরিবর্তে পরাজয় অনিবার্য। এ পরিস্থিতিতে আমিরুল মোমেনিন খেলাফতকে পঙ্কিল পানি বা শ্বাসরুদ্ধকর খাদ্য মনে করেছিলেন। অপরদিকে যে সমস্ত লোক এ খাদ্য জোরপূর্বক কেড়ে নিয়েছিল এবং জোরপূর্বক তা গলাধঃকরণ করতে চেয়েছিল; তা তাদের গলায় আটকে পড়লো। ওরা সেটা গিলতেও পারছিলো না, বমিও করতে পারছিলো না। অর্থাৎ ইসলামি বিধি-নিষেধে তারা যে সব ভুল-ভ্রান্তি করেছিল তা শুধরে নিয়ে খেলাফত চালাতে পারে নি; আবার তাদের ঘাড় থেকে এ রাশির বাঁধন খুলেও ফেলতে পারে নি।
একই কথা তিনি অন্যভাবেও ব্যক্ত করেছেনঃ “খেলাফতের কাচা ফল যদি আমি পাড়তে চেষ্টা করতাম তবে বাগান উৎসাদিত হতো এবং আমিও কিছুই পেতাম না; যেমন অন্যের জমি কর্ষণকারী না পারে একে পাহারা দিতে, না পারে এতে যথাসময়ে পানি দিতে, না পারে এর ফসল কাটতে। এসব লোকের অবস্থা এমন ছিল যে, যদি আমি দখল ছেড়ে দিতে বলতাম যাতে মালিক নিজেই চাষ করতে ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে, তবে তারা বলবে আমি কতই না লোভী। আবার আমি নিশ্চপ থাকলে তারা ভাবে আমি মৃত্যু ভয়ে ভীত। তারা বলুক তো জীবনে আমি কখনো ভীতি অনুভব করেছি। কিনা অথবা প্রাণভয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এসেছি কিনা? ছোট বড় যে কেউ যুদ্ধে আমার সম্মুখীন হয়েছে সেই আমার বীরত্ব, সাহসিকতা ও নিভীকতার পরিচয় পেয়েছে। যে ব্যক্তি সারা জীবন তরবারি নিয়ে খেলা-করেছে আর পাহাড়গুলোকে আঘাত করেছে সে মৃত্যুকে ভয় করতে পারে না। আমি মৃত্যুর সাথে ততটুকু পরিচিত যতটুকু একটা শিশু তার মায়ের স্তনের সাথে নয়। শোন!! আমার নীরবতার একমাত্র কারণ হলো আমার জ্ঞান যা রাসুল (সঃ) আমার বক্ষে রেখে গেছেন। যদি আমি তা ফাঁস করি তবে তোমরা হতবুদ্ধি হয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়বে। কিছু দিন গেলেই তোমরা আমার নিস্ক্রিয়তার কারণ জানতে পারবে। তখন তোমরা নিজ চোখে দেখতে পাবে যে, ইসলামের নামে কী ধরনের লোকেরা খেলাফতের মঞ্চে এসেছিল এবং কতটুকু ধ্বংস তারা সংঘটিত করেছিল। এমনটি ঘটবে সেজন্যই আমার নীরবতা। এটা কারণবিহীন নীরবতা নয়।”
একজন ফারসি কবি বলেছেনঃ নীরবতা এমন অর্থ বহন করে যা আক্ষর দ্বারা শেখানো যায় না । ২। মৃত্যু সম্পর্কে আমিরুল মোমেনিন বলেন যে, মৃত্যুকে তিনি যতটুকু ভালোবাসেন একটা শিশু তার মায়ের কোলে থেকেও তার পুষ্টিকর উৎসকে (মায়ের স্তন) ততটুকু ভালোবাসে না। মায়ের স্তনের সাথে একটা শিশুর সংযোগ হয় প্রাকৃতিক প্রেরণায়। কিন্তু বয়সের সাথে সাথে এ প্রকৃতিক প্রেরণা পরিবর্তিত হয়। সীমিত শিশুকাল শেষ হলেই তার মানসিকতা বদলে যায়— এত প্রিয় মায়ের স্তনের দিকে সে ফিরেও তাকায় না। কিন্তু নবি ও আউলিয়াগণের প্ৰেম আল্লাহর সঙ্গে মিলনের জন্য এবং এটা সম্পূর্ণ মানসিক ও আধ্যাত্মিক। মানসিক ও আধ্যাত্মিক অনুভূতি কখনো বদলায় না এবং দুর্বলতা ও ধ্বংস একে স্পর্শ করে না। যেহেতু মৃত্যুই এ মিলনের উপায় সেহেতু মৃত্যুর প্রতি তাদের ভালোবাসা এত বৃদ্ধি পায় যে, তারা এর ভয়াবহতায় আনন্দ এবং তিক্ততায় সুস্বাদ অনুভব করে। মৃত্যুর প্রতি তাদের ভালোবাসা এমন, যেমন তৃষ্ণার্তা ব্যক্তির কূপের প্রতি বা পথ হারানো পথিকের গন্তব্যস্থলের প্রতি। তাই আবদুর রহমান ইবনে মুলজামের (তার ওপর আলাহর লা’নত) মারণাঘাতের পর আমিরুল মোমেনিন বলেছিলেন, “আমি সেই পথিকের মতো যে গন্তব্যস্থলে পৌছেছে অথবা সেই অনুসন্ধানকারীর মতো যে উদ্দিষ্ট বস্তু খুঁজে পেয়েছে এবং আল্লাহর সাথে মিলনের জন্য সকল কিছুই উত্তম।” রাসুলও (সঃ) বলেছিলেন, “আল্লাহর সাথে মিলন অপেক্ষা অধিক আনন্দদায়ক আর কিছু নেই।”