এটা খোৎবায়ে শিকশিকিয়্যাহ” নামে খ্যাত
সাবধান!! আল্লাহর কসম, আবু কুহাফার পুত্র (আবু বকর) নিজে নিজেই ওটা (খেলাফত) পরিধান করে নিয়েছিল। সে নিশ্চিতভাবেই জ্ঞাত ছিল যে, খেলাফতের জন্য আমার অবস্থান এমন যেন যাতার কেন্দ্রিয় শলাকা । বন্যার পানি আমার কাছ থেকে প্রবাহিত হয় এবং পাখী আমার কাছ পর্যন্ত উড়ে আসতে পারে না। আমি খেলাফতের সামনে একটা পর্দা টেনে দিলাম এবং নিজেকে সেটা থেকে নির্লিপ্ত রাখলাম । –
এরপর আমি প্রবল বেগে আক্রমণ করা অথবা ধৈর্য সহকারে চোখ বন্ধ করে অন্ধকারের সকল দুঃখ-দুর্দশা সহ্য করার বিষয়ে চিন্তা করতে লাগলাম। এরই মধ্যে বয়স্কগণ দুর্বল হয়ে পড়লো, যুবকেরা বৃদ্ধ হয়ে গেল এবং মোমেনগণ চাপের মুখে আমরণ কষ্ট করে কাজ করছিলো। আমি দেখলাম এ অবস্থায় ধৈর্য ধারণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। সুতরাং আমি ধৈর্য ধারণ করলাম। যদিও তাদের কর্মকান্ড কাঁটার মতো চোখে বিধিছিলো এবং সামগ্রিক অবস্থা শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে পড়েছিলো। প্রথম জনের মৃত্যু পর্যন্ত আমার লুষ্ঠিত উত্তরাধিকারের জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সে তা ইবনে খাত্তাবের হাতে তুলে দিয়ে গেল। এরপর আমার দিন উটের পিঠে (অতি দুঃখ-কষ্টে) কাটতে লাগল। শুধুমাত্র জাবিরের ভ্রাতা হাইয়ানের সহচর্যে ক’টি দিন ভালো গেল।
এটা এক অদ্ভুত ব্যাপার যে, জীবদ্দশায় সে খেলাফত থেকে অব্যাহতি পাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। কিন্তু মৃত্যুকালে সে তা অন্য একজনের হাতে তুলে দিয়ে গেল। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এরা দুজনই পরিকল্পিতভাবে একই স্তনের বঁটিগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। এ জন। (উমর) খেলাফতকে একটা শক্ত বেষ্টনীর মধ্যে রাখলো, যেখানে কথাবার্তা ছিল উদ্ধত এবং স্পর্শ ছিল রূঢ়া; অনেক ভুল-ভ্রান্তি ও ত্রুটি-বিচূতি ছিল এবং তদ্রুপ ওজরও দেখানো হতো। খেলাফতের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তি মাত্রই অবাধ্য উটের সওয়ারের মতো হয়ে যেতো— লাগাম টেনে ধরলে নাসারন্ধ কেটে যায়, আবার টেনে না ধরলে সওয়ার নিক্ষিপ্ত হয়। আল্লাহর কসম, ফলত, মানুষ বলগাহীনতা, ভিন্নরূপিতা, অদৃঢ়তা ও পথভ্রষ্টতায় জড়িয়ে পড়েছিল।
তা সত্ত্বেও কালের দৈর্ঘ্য আর কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে তার (উমর) মৃত্যু পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করে রইলাম। সে খেলাফতের বিষয়টি একটা দলের হাতে ন্যস্ত করলো এবং আমাকেও তাদের একজন মনে করলো। হায় আল্লাহ! এ “মনোনয়ন বোর্ড” দিয়ে আমি কী করবো? তাদের প্রথম জনের তুলনায় আমার শ্রেষ্ঠত্ব বিষয়ে কি কখনো কোন সংশয় ছিল যে, এখন আমাকে এসব লোকের সমপর্যায়ের মনে করা হলো? কিন্তু তারা শান্ত থাকলে আমিও শান্ত থাকতাম এবং তারা উচুতে উড়লে আমিও উচুতে উড়তাম। তাদের একজন আমার প্রতি হিংসাপরায়ণতার কারণে আমার বিরোধী হয়ে গেল এবং অপর একজন তার বৈবাহিক আত্মীয়তা ও এটা-সেটা নিয়ে আমার বিরুদ্ধে চলে গেল। ফলে এদের তৃতীয় জন বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার সাথে তার পিতামহের সন্তানেরা (উমাইয়াগণ) দাঁড়িয়ে গেল এবং এমনভাবে আল্লাহর সম্পদ” গলাধঃকরণ করতে লাগলো যেভাবে বসন্তের পত্রপল্লব ক্ষুধার্তা উট গোগ্রাসে গিলতে থাকে। তার ক্রিয়াকলাপ তাকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে গেল এবং তার অতিভোজন তাকে অবনত করলো ।
সে সময় আমার দিকে জনতার দ্রুত আগমন ছাড়া আর কোন কিছুই আমাকে বিস্মিত করে নি। চতুর্দিক থেকে হায়নার কেশরের মতো এত অধিক জনতা এগিয়ে আসলো যে, হাসান ও হুসাইন পদদলিত হবার অবস্থায় পড়েছিল এবং আমার উভয় স্কন্ধের কাপড় ছিড়ে গিয়েছিল। ভেড়া ও ছাগলের পালের মতো তারা আমার চারদিকে জড়ো হয়েছিল। যখন আমি শাসনভার গ্রহণ করেছিলাম তখন একদল কেটে পড়লো, আরেক দল বিদ্রোহী হয়ে গেলো এবং অন্যরা এমন অন্যায়ভাবে ক্রিয়াকলাপ করতে লাগলো যেন তারা কখনো আল্লাহর এ বাণী শুনতে পায় নি—
এটা আখিরাতের সে আবাস যা আমরা তাদের জন্যই অবধারিত করি যারা পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য প্রকাশ এবং ফ্যাসাদ সৃষ্টি করতে চায় না । এবং উত্তম পরিণাম মৃত্তাকিদের জন্যই
(কুরআন – ২৮ ? ৮৩) |
হাঁ, আল্লাহর কসম, তারা আল্লাহর বাণী শুনেছিল এবং তার অর্থও বুঝেছিল। কিন্তু দুনিয়ার চাকচিক্য তাদের চোখে অধিক প্রিয় হয়ে পড়েছিল এবং দুনিয়ার জাক-জমক ও বিলাসিত তাদেরকে প্রলুব্ধ করে পথভ্রষ্ট করেছিল। মনে রেখো, যিনি শস্যকণা ভেঙ্গে চারা গজান ও জীবিত সত্তা সৃষ্টি করেন, তার কসম করে বলছি, যদি মানুষ আমার কাছে না। আসতো এবং সমর্থনকারীরা যুক্তি নিঃশেষ না করতো এবং জ্ঞানীদের সাথে এ মর্মে আল্লাহর কোন অঙ্গীকার না থাকতো যে, জালিমের অতিভোজন আর মজলুমের ক্ষুধায় তারা মৌন সম্মতিও দিতে পারবে না; তাহলে আমি খেলাফতের রাশি তার নিজের কাধে নিক্ষেপ করতাম এবং শেষ জনকে প্রথম জনের পেয়ালা দ্বারা পানি পান করাতাম । তখন তোমরা দেখতে পেতে যে, তোমাদের এ দুনিযা আমার মতে ছাগলের হাঁচির চেয়েও নিকৃষ্টতর। (কথিত আছে যে, আমিরুল মোমেনিন তার খোৎবায় এ পর্যন্ত বলার পর ইরাকের একজন লোক দাঁড়িয়ে গেল এবং আমিরুল মোমেনিনের হাতে একটা চিরকুট দিলেন। আমিরুল মোমেনিন তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এমন সময় ইবনে আব্বাস বললেন, “হে আমিরুল মোমেনিন, আপনার খোৎবা যেখানে বন্ধ করেছেন সেখান থেকে আবার আরম্ভ করুন।” উত্তরে তিনি বললেন, “হে ইবনে আব্বাস, এটা উটের বুদুদের (শিকশিকিয়্যাহ্) মতে যা প্রচুর পরিমাণে নিঃসৃত হয়। কিন্তু অল্পক্ষণেই মিটে যায়।” ইবনে আব্বাস বলেছিলেন যে, তিনি কোনদিন আমিরুল মোমেনিনের কোন কথায় এত দুঃখ পান নি যা পেয়েছিলেন সেদিন, কারণ অনুরোধ সত্ত্বেও আমিরুল মোমেনিন তাঁর খোৎবা শেষ করলেন না।)
১ । এ খোৎবাটি খোৎবায়ে শিকশিকিয়্যাহ নামে অভিহিত এবং এটাকে আমিরুল মোমেনিনের প্রসিদ্ধ
খোৎবার অন্যতম বলে গণ্য করা হয়। এটা আর-রাহবাহ নামক স্থানে প্রদান করা হয়। কোন কোন লোক এ খোৎবাটি আমিরুল মামোমেনিনের নয় বলে মনে করেন। তারা আশ-শরীফ আর-রাজীর স্বীকৃত সততার ওপর দোষারোপ করে এ খোৎবাটি তার বুনন বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু সত্যপ্রিয় পন্ডিতগণ এরূপ মন্তব্যের সকল প্রকার সত্যতা অস্বীকার করেছেন। কারণ খেলাফতের ব্যাপারে আলী ভিন্নমত পোষণ করতেন। একথা আদৌ গোপনীয় নয়। সুতরাং খোৎবার ইঙ্গিীতসমূহ বাস্তব অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ খোৎবায় যে সমস্ত ঘটনাবলী পরোক্ষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে তা বর্ষানুক্ৰমিক ইতিহাসে লিপিবদ্ধ ছিল যা প্রতিটি কথার সত্যতা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করে। যেখানে এসব কথা ইতিহাসে বর্ণিত আছে আবার আমিরুল মোমেনিনও বিশদভাবে বলেছেন। সেখানে এসব কথা অস্বীকার করার মতো ক্ষেত্র থাকতে পারে না। রাসুলের (সঃ) ইনতিকালের পরবতীর্ণ দুঃখজনক অবস্থা যদি তার স্মৃতিকে তিক্তভাবে নাড়া দিয়ে থাকে। তবে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এ খোৎবাটি কতিপয় ব্যক্তিত্বের সম্রামে আঘাত হেনেছে কিন্তু খোৎবাটি আমিরুল মোমিনের বক্তব্য নয় বললেই সভ্রম রক্ষা করা যাবে না। কারণ এ ধরণের সমালোচনা অন্যান্য ঐতিহাসিকগণও উল্লেখ করেছেন। আমর ইবনে বাহুর আল-যাহিজ (আবু উসমান)। আমিরুল মামোমেনিনের খোৎবার যে শব্দগুলি রেকর্ড করেছিলেন তা খোৎবায়ে শিকশিকিয়্যার সমালোচনা থেকে কম গুরুত্ব বহন করে না। যাহিজের রেকর্ড করা শব্দগুলি নিম্নরূপ :
ওই দুজন সরে গেল এবং তৃতীয়জন কাকের মতো উঠে দাঁড়ালো যার সাহস ছিল পেটে
আবদ্ধ । যদি তার উভয় ডানা কেটে ফেলা হতো এবং তার মাথা দ্বিখন্ডিত করা হতো। তবে
তা উত্তম হতো /
ফলত এ খোৎবার কথাগুলো আশ-শরীফ আর-রাজী বানিয়েছেন এমন ধারণা সত্যের অপলাপ মাত্র এবং
এহেন ধারণা স্বজনপ্রীতি ও দলপ্রীতির বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। এহেন ধারণা যদি কোন গবেষণালব্ধ হয়ে থাকে। তবে সে গবেষণা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করা কি উচিত নয়? একথা স্বীকার্য যে, ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে সত্যকে গোপন করা যায় না। কোন ব্যক্তি বা দলের অস্বীকৃতি ও অসন্তোষের কারণে এহেন চূড়ান্ত যুক্তিগ্রাহ্য সত্যের মুখে লাগাম পরিয়ে দেয়া যাবে না। এখন আমরা এমন কতিপয় পন্ডিত ও হাদিসবেত্তার বক্তব্য তুলে ধরবো যারা এ খোৎবাকে আমিরুল মোমেনিনের বক্তব্য বলে উল্লেখ করেছেন। তাদের কেউ কেউ শরীফ রাজীর অনেক পূর্বেকার, কেউ কেউ তার সমসাময়িক আবার কেউ কেউ তার পরবর্তীকালের । তারা হলেনঃ
১. ইবনে আবিল হাদীদ লেখেছেন—তার শিক্ষক আবুল খায়ের মুসাদিক ইবনে শাবিব আল-ওয়াসিতি (মৃত্যু ৬০৫ হিঃ) তাকে বলেছেন যে, তিনি এ খোৎবাটি শায়েখ আবু মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ আল-বাগদাদির (মৃত্যু ৫৬৭ হিঃ) কাছে শুনেছেন। আল-ওয়াসিতি আরো বলেছেন যে, আল-বাগদাদি তাকে বলেছেন যদি তিনি ইবনে আব্বাসের দেখা পেতেন তাহলে জিজ্ঞেস করতেন যে, তার চাচাত ভাই তো কাউকে ছাড়ে নি— এরপরও এমন কী কথা রয়ে গেল। যাতে ইবনে আব্বাস দুঃখ পেয়েছেন? আল-ওয়াসিতি যখন জিজ্ঞেস করলেন যে, খোৎবাটি অন্য কারো বানানো উক্তি কিনা আল-বাগদাদি তখন বললেন, “আল্লাহর কসম, আমি বিশ্বাস করি খোৎবাটি আমিরুল মোমেনিনের উক্তি যেমন আমি বিশ্বাস করি তুমি মুসাদিক ইবনে শাবিব। শরীফ রাজীর জন্মের দুশ বছর পূর্বে লিখিত পুস্তকেও আমি এ খোৎবাটি দেখেছি যা বিখ্যাত পন্ডিতগণ সংকলন করেছিলেন এবং সে সময় শরীফ রাজীর বাবা আবু আহম্মদ আন-নকীবও জন্মগ্রহণ করে নি।”
২. ইবনে আবিল হাদীদ এরপর লেখেছেন—তার শিক্ষক আবুল কাসিম মুতাজিলা ইমাম আল-বলখির (মৃত্যু ৩১৭। হিঃ) সংকলনে এ খোৎবাটি দেখেছেন যখন মুক্তাদির বিল্লাহর রাজত্বকাল ছিল। শরীফ রাজী মুক্তাদির বিল্লাহর রাজত্বকালের অনেক পরে জন্ম গ্রহণ করেছেন।
৩. তিনি আরো লেখেছেন— আবু জাফর ইবনে কিবাহ বিরচিত “আল-ইনসাফ’ গ্রন্থে তিনি এ খোৎবাটি দেখেছেন। ইবনে কিবাহ ছিলেন, ইমামত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আল বলখির ছাত্র (হাদীদ***, ১ম খন্ডঃ १ ६ २०१-२०७) ।
৪. ইবনে মায়ছাম বাহরানী (মৃত্যু ৬৭৯ হিঃ) লেখেছেন—মুক্তাদির বিল্লাহর মন্ত্রী আবুল হাসান আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আল-ফুরাতের (মৃত্যু ৩১২ হিঃ) এক লেখায় তিনি এ খোৎবাটি দেখেছেন (বাহারানী,” ১ম খন্ড, পৃঃ ২৫২-২৫৩)।
৫. শায়েখ কুতুবুদ্দিন রাওয়ান্দির সংকলিত “মিনহাজ আল বারাআহ ফি শারহ নাহাজ আল-বালাঘা” গ্রন্থে এ খোৎবার নিম্নরূপ ধারাবাহিকতা উল্লেখ করা হয়েছে যা আল্লামা মুহাম্মদ বাকির মজলিসী তার “বিহার আল-আনওয়ার”- গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেনঃ শায়েখ আবু নসর হাসান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম খোৎবাটি আমাকে অবহিত করেছেন । তিনি হাজিব। আবুল ওয়াফা মুহাম্মদ ইবনে বাদী, হুসাইন ইবনে আহমদ ইবনে বাদী ও হুসাইন ইবনে আহমদ ইবনে আবদার রহমানের কাছে থেকে খোৎবাটি পেয়েছেন । তারা হাফিজ আবু বকর ইবনে মরদুইয়্যা ইস্পাহানী (মৃত্যু ৪১৬ হিঃ) থেকে, তিনি হাফিজ আবুল কাসিম সুলায়মান ইবনে আহমদ তাবারানী (মৃত্যু ৩৬০ হিঃ) থেকে, তিনি আহমদ ইবনে আলী আল-আব্বার থেকে, তিনি ইসহাক ইবনে সাঈদ আবু সালামা দামাঙ্কণী থেকে, তিনি খুলাইদ ইবনে দালাজ থেকে, তিনি আতা ইবনে আবি রাবাহ থেকে এবং তিনি ইবনে আব্বাস থেকে খোৎবাটি পেয়েছেন” (মজলিসী***, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১৬০)
৬. আল্লামা মজলিসী আরো উল্লেখ করেন যে, আবু আলী (মুহাম্মদ ইবনে আবদাল ওহাব) আল-জুব্বাই (মৃত্যু ৩০৩ হিঃ) এর সংকলনে এ খোৎবাটি ছিল।
৭. আল্লামা মজলিসী এ খোৎবার সত্যতা সম্পর্কে আরো লেখেছেনঃ কাজি আবদাল জব্বার ইবনে আহম্মদ আল-আসাদ আবাদী (মৃত্যু ৪১৫। হিঃ) তার রচিত গ্রস্ত আল-মুঘানি’-তে এ খোৎবার কতিপয় বক্তব্য ব্যাখ্যা করে বলেছেন। এতে আমিরুল মোমেনিন পূর্ববতীর্ণ খলিফাগণকে আঘাত করে কিছু বলেন নি । তিনি খোংবাটি আমিরুল মোমেনিনের বক্তব্য বলে অস্বীকার করেন নি । (মজলিসী***, ৮ম খন্ড, পৃঃ ১৬১ ) (৮) আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে বাবাওয়াহ (মৃত্যু ৩৮১ হিঃ) লেখেছেনঃ আমিরুল মোমেনিনের এ খোৎবাটি মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহীম ইবনে ইসহাক তালাকাশী আমাদের কাছে বৰ্ণনা করেছেন । তিনি আবদুল আজিজ ইবনে ইয়াহিয়া জালুদি (মৃত্যু ৩৩২ হিঃ) থেকে, তিনি আবদিল্লাহ আহমদ ইবনে আম্মার ইবনে খালিদ থেকে, তিনি ইয়াহিয়া ইবনে আবদাল হামিদ হিন্মানী (মৃত্যু ২২৮ হিঃ।) থেকে, তিনি ঈসা ইবনে রশিদ থেকে, তিনি আলী ইবনে হুজায়ফা থেকে, তিনি ইকরামা থেকে এবং তিনি ইবনে আব্বাস থেকে খোৎবাটি বর্ণনা করেছেন / ( رئو-oنو g? ؟?R/*ى7>[> ;88ر g?ه ,كن په لار ,؟R/*ىT[۹) (৯) ইবনে বাবাওয়াহ্ তার উক্ত গ্রন্থদ্বয়ে আমিরুল মোমেনিনের এ খোৎবার আরো একটি বরাত সূত্র উল্লেখ করেছেন যা নিম্নরূপ : মুহাম্মদ ইবনে আলী মাজিলাওয়াহ আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন । তিনি তার চাচা মুহাম্মদ ইবনে আবিল কাসিম থেকে, তিনি আহম্মদ ইবনে আবি আবদিল্লাহ আল-বারাকী থেকে, তিনি তার পিতা থেকে, তিনি ইবনে আবি উমায়ার থেকে, তিনি আবান ইবনে উসমান থেকে, তিনি আবান ইবনে তাঘালিব থেকে, তিনি ইকরামা থেকে এবং তিনি ইবনে আব্বাস থেকে এ খোৎবা প্রাপ্ত হয়েছেন।
(বাবাওয়াহ’, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৪৬. বাবাওয়াহ’, পৃঃ ৩৬১) (So) আবু আহমদ হাসান ইবনে আবদিল্লাহ্ ইবনে সাঈদ আসকারী (মৃত্যু ৩৮২ হিঃ) একজন বিখ্যাত সুন্নি পন্ডিত ছিলেন। তিনি আমিরুল মোমেনিনের এ খোৎবাটির টীকা ও ব্যাখ্যা লেখেছিলেন যা ইবনে বাবাওয়াহ্ তার উক্ত গ্রন্থদ্বয়ে উদ্ধৃত করেছেন। (১১) আবু ইসহাক ইব্রাহীম ইবনে মুহাম্মদ আছ-ছাকাকী’ তার রচিত “আল-ঘারাতে” গ্রন্থে এ খোৎবা
প্ৰাপ্তির নিজস্ব ধারাবাহিকতা বিবৃত করেছেন। তিনি ২৮৩ হিঃ সনে মারা যান। ২৫৫ হিঃ সনের ১৩ই শাওয়াল মঙ্গলবার তার গ্ৰন্থখানা লেখা সমাপ্ত হয়েছিল এবং এ বছরই আশ-শরীফ আর-রাজীর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মুরতাজা মুসাবী জন্মগ্রহণ করেছিল (জাজাইরী’, পৃঃ ৩৭) (১২) সৈয়দ রাজী উদ্দিন আবুল কাসেম আলী ইবনে মূসা ইবনে তাউস আল-হুসাইনী আল-হুল্লি (মৃত্যু ৬৬৪ হিঃ) “আল ঘারাত”- গ্রন্থের বরাত দিয়ে এ খোৎবার নিম্নরূপ ধারাবাহিকতা বর্ণনা করেছেনঃ মুহম্মদ ইবনে ইউছুফ এ খোংবাটি আমাদের কাছে বৰ্ণনা করেছেন । তিনি আলহাসান ইবনে আলী ইবনে আবদাল করিম আজ-জাফরানী থেকে, তিনি মুহাম্মদ থেকে, তিনি তার পিতা থেকে, তিনি তার নানা থেকে এবং তিনি ইবনে আব্বাস থেকে খোৎবাটি পেয়েছিলেন (তাউস’, リベos)
শায়েখ আত-তায়ফা মুহাম্মদ ইবনে আল-হাসান আত-তুসী (মৃত্যু ৪৬০ হিঃ) লেখেছেনঃ আল-হাফফার (আবুল ফাছ হিলাল ইবনে মুহাম্মদ ইবনে জাফর) আমাদের কাছে এ খোৎবাটি বলেছেন । তিনি আবুল কাসিম (ইসমাঈলী ইবনে আলী ইবনে আলী) আজ-জিবিলী থেকে, তিনি তার পিতা থেকে, তিনি তার ভ্রাতা জিবিল (ইবনে আলী আল-কুজাই) থেকে, তিনি মুহাম্মদ ইবনে সালামাহ আশ-শামী থেকে, তিনি জুরারিাহ ইবনে আয়ান থেকে, তিনি আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে আলী (আশাশায়েখ আস-সাদুক) এবং তিনি ইবনে আব্বাস থেকে খোৎবাটি পেয়েছিলেন। (তুসী’, পৃঃ ২৩৭) { শরীফ রাজীর শিক্ষক শায়েখ আল-মুফিদ (মৃত্যু ৪১৩ হিঃ) এ খোৎবার সনদ সম্পর্কে লেখেছেনঃ ইবনে আব্বাস থেকে প্রাপ্ত হয়ে অনেক রাবি বিভিন্ন ধারা পরম্পরায় এ খোৎবাটি
বিবৃত করেছেন (মুফিদ’, পৃঃ ১৩৫)। শরীফ রাজীর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আলম আল-হুদা আস-সাঈদ আল-মুরতাজা তার গ্রন্থে এ খোৎবাটি রেকর্ড
করেছিলেন (মুরতাজা”, পৃঃ ২০৩- ২০৪)। আবু মনসুর আত-তাবারসী লেখেছেনঃ অনেক ব্লাবি ইবনে আব্বাস থেকে বিভিন্ন ধারায় এ খোৎবা বর্ণনা করেছেন । ইবনে আব্বাস বলেছেন তিনি নিজেই রাহবাহ (কুফার একটা স্থান)। আমিরুল মোমেনিনের মুখ নিঃসৃত এ খোৎবা শুনেছেন । তিনি বলেন যে, খেলাফত ও পূর্ববর্তীর্ণ খলিফাগণ সম্পর্কে আলোচনা উঠলে আমিরুল মোমেনিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খোৎবাটি প্রদান করেন (তাবারসী”, পৃঃ ১০১) { আবুল মুজাফফর ইউছুফ ইবনে আবদিল্লাহ্ এবং সিবত ইবনে আল-জাওজী (মৃত্যু ৬৫৪ হিঃ।) লেখেছেনঃ খোৎবা বর্ণনা করেছেন । তিনি সহি সনদের মাধ্যমে ইবনে আব্বাস থেকে এ খোৎবা অবহিত হয়েছেন । ইবনে আব্বাস বলেছেন যে, খলিফা হিসাবে আমিরুল মোমেনিনের বায়াত নেয়ার পর তিনি মিম্বারে উপবিষ্ট হলে এক ব্যক্তি জানতে চাইলো, তিনি এতদিন নিশূচুপ ছিলেন কেন । তদুত্তরে আমিরুল মোমেনিন এ খোৎবা প্রদান করেন (জাওজী”, পৃঃ ৭৩) | শায়েখ আলা-আদৌলা আস-সিমনোনী লেখেছেনঃ সাইয়্যোদাল আরেফিন আমিরুল মোমেনিনের খোৎবাগুলোর মধ্যে শিকশিকিয়্যাহ একটা চমৎকার খোৎবা যাতে তাঁর হৃদয়া বেগ বিস্ফোরিত হয়েছে (সিমনানী***, পৃঃ ৩)। শিকশিকিয়্যাহ’ শব্দটি সম্পর্কে আবুল ফজল আহমদ ইবনে মুহাম্মদ আল-মায়দানী (মৃত্যু ৫১৮ হিঃ।) লেখেছেনঃ আমিরুল মোমেনিন আলী ইবনে আবি তালিবের একটা খোৎবা খোৎবা আশশিক্শিকিয়াহ’ নামে অভিহিত (মায়দানী”, ১ম খন্ড, পৃঃ ৩৬৯) ।
ইবনে আল-আহীর” (মৃত্যু ৬০৬ হিঃ) তার নিহায়া গ্রন্থে এ খোৎবার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পনেরোটি স্থানে বিভিন্ন দলিলাদি দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে, খোৎবাটি নিঃসন্দেহে আমিরুল মোমেনিনের বক্তব্য।
(২১) শায়েখ মুহাম্মদ তাহির পাটনী তার মাজমা বিহার আল-আনওয়ার’ গ্রন্থে এ খোৎবার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বহু প্রমাণাদির দ্বারা উপস্থাপন করেছেন যে, খোৎবাটি আমিরুল মোমেনিনের। প্রতিটি বাক্যের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি “আলী বলেন।” লেখে শুরু করেছেন। (২২) মাজদুদিন আল ফিরুজ আবাদী (মৃত্যু ৮.১৭ হিঃ) তার গ্রন্থে রেকর্ড করেছেনঃ আলীর এ খোৎবাটির নামকরণ খোৎবা আশ-শিক্শিকিয়াহ’ করা হয়েছে এ জন্য যে, খোৎবার এক পর্যায়ে আমিরুল মোমেনিন নিশ্বটুপ হয়ে গেলে ইবনে আব্বাস পুনরায় শুরু করার অনুরোধ করেন । তখন আমিরুল মোমেনিন বলেন, “হে ইবনে আব্বাস, এটা উটের মুখের ফেনার (শিকশিকাহ) মতো বেরিয়ে এসেছে আবার প্রশমিত হয়ে পড়েছে” (আবাদী’, ৩য় খন্ড, পৃঃ ২৫.১) { (২৩) আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা অনুষদের প্রফেসর মুহাম্মদ মুহীউদ্দিন আবদ-আল-হামিদ “নাহাজ আল-বালাঘা”-এর ওপর গবেষণামূলক টীকা লেখেছেন। উক্ত টীকার মুখবন্ধে তিনি মন্তব্য করেছেন যে, খোৎবাগুলোর প্রতিটি বাক্য আমিরুল মোমেনিনের বক্তব্য। এমনকি মর্যাদাহানিকর উক্তিগুলোও তারই বক্তব্য । ২। আবু বকরের খেলাফতে অধিষ্ঠিত হওয়াকে আমিরুল মোমেনিন চমৎকার রূপকলঙ্কারে ব্যক্ত করে বলেছেন যে, তিনি নিজে নিজেই ওটা (খেলাফত) পরিধান করে নিয়েছেন। এটা আরবি ভাষায় ব্যবহার্য একটা রূপক। যখন উসমানকে খেলাফত ছেড়ে দিতে বলা হয়েছিল (অবরোধ অবস্থায়)। তখন তিনি বলেছিলেন, “যে শার্ট আল্লাহ আমাকে পরিয়ে দিয়েছেন তা আমি কখনো খুলবো না।” নিঃসন্দেহে খেলাফত পরিয়ে দেয়ার বিষয়টি আমিরুল মোমেনিন আল্লাহতে আরোপ করেন নি। আবু বকর নিজেই তা পরেছেন কারণ তথাকথিত সর্বসম্মত ঐকমত্য অনুযায়ী আবু বকরের খেলাফত গ্রহণ আল্লাহর মনোনয়ন নয়—এটা তার নিজস্ব ব্যাপার। সে কারণেই আমিরুল মোমেনিন বলেছেন যে, আবু বকর খেলাফত পরিধান করে নিয়েছেন। আমিরুল মোমেনিন জানতেন, এ পোষাক তারই জন্য সেলাই করা হয়েছিল এবং খেলাফতের জন্য তাঁর অবস্থান ছিল যাতার মধ্যশলাকার ন্যায় যা না
হলে র্যতার
পাথর সঠিক অবস্থানে থাকতে পারে না; ফলে যাতাও কোন কাজে আসে না। তাই আমিরুল মোমেনিন বলেছিলেন– “আমি হলাম খেলাফতের কিলক । আমাকে খেলাফত থেকে সরিয়ে রাখার কারণে এর সকল নিয়ম-নীতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। সকল বিপদাপদ মাথায় নিয়ে আমিই ছিলাম। এসব নিয়ম-নীতির অতন্দ্র প্রহরী। আমিই এসব সংগঠিত করে শৃঙ্খলা বিধান ও সঠিক দিক নির্দেশনায় পরিচালনা করেছিলাম। জ্ঞানের প্রবাহ আমার বক্ষ থেকেই নিঃসরিত হয় এবং আমিই নিয়ম-নীতিকে জল সিঞ্চনে উজীবিত করেছি। আমার অবস্থান কল্পনাতীত উচ্চতর ছিল। কিন্তু দুনিয়াদারদের ক্ষমতা লিন্সা আমার জন্য হয়ে গেল উল্টে পড়া পাথরের সামিল এবং আমি নিঃসঙ্গতায় নিজকে আবদ্ধ করতে বাধ্য হলাম। চারদিকে অন্ধকারাচ্ছন্নতা আর তীব্র হতাশা বিরাজ করছিলো ; যুবকেরা বৃদ্ধ হয়ে গেল এবং বৃদ্ধর কবরে চলে গেল তবুও যেন ধৈর্যধারণকালে শেষ হচ্ছিলো না। আমার উত্তরাধিকার কিভাবে লুটপাট করে নিয়েছে। আমি তা নিজ চোখে দেখছিলাম এবং দেখছিলাম কিভাবে খেলাফত এক হাত থেকে অন্য হাতে বদল হচ্ছিলো। আমি ধৈর্যধারণ করে রইলাম। কারণ তাদের লুটপাট বন্ধ করতে হলে যে উপায়-উপকরণের প্রয়োজন তা আমার ছিল না।”
খলিফাতুর রাসুলের প্রয়োজনীয়তা ও এর নিয়োগ প্রণালী রাসুলের (সঃ) তিরোধানের পর এমন এক ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল যিনি ইসলামি উম্মাহর অনৈক্য এবং ইসলামি আইন-কানুনের পরিবর্তন ও প্রক্ষেপ রোধ করতে সমর্থ ছিলেন। কারণ এমন অনেকে ছিল যারা আপন কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য উন্মাহর ঐক্যে ফাটল ধরাতে ও আইন-কানুন পরিবর্তন করে তাতে নিজেদের ধ্যান-ধারণা প্রক্ষেপণে সদা ব্যগ্র ছিল। যদি এহেন ব্যক্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা হয়, তা হলে রাসুলের উত্তরাধিকারিত্বের কোন গুরুত্ব থাকে না এবং সেক্ষেত্রে রাসুলের দাফন বাদ দিয়ে সকিফাহ্-ই-সাঈদীর সম্মেলনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ নেহায়েত বাতুলতা মাত্র। আর যদি রাসুলোত্তরকালে একজন খলিফাতুর রাসুলের প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত হয়, তাহলে প্রশ্ন এসে পড়ে রাসুল (সঃ) কি এমন অবশ্যম্ভাবিতা অনুভব করতে পেরেছিলেন? যদি ধরা হয় তিনি এদিকে মনোযোগ দেন নি বা এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন নি তাহলে এটা একটা বিরাট প্রমাণ হয়ে দাঁড়ায় যে, স্বধর্ম ত্যাগ, উন্মাহর খন্ড-বিখন্ডতা (বিভক্তি) ও দুষ্ট প্রক্ষেপ রোধ করার উপায় সম্পর্কে রাসুলের মন শূন্য ছিল। অথচ বাস্তবে এমনটি ছিল না। এহেন অবস্থা সম্পর্কে তিনি বারংবার সতর্ক করেছেন। যদি ধরা হয়। তিনি এটা অনুভব করতে পেরেছিলেন। কিন্তু কোন কৌশলী-সুবিধার কারণে তা অমীমাংসিত রেখে গেছেন তাহলে গুপ্ত রাখার পরিবর্তে তিনি ওই সুবিধার প্রতি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিতেন। কারণ উদ্দেশ্যবিহীন নীরবতা নবুয়তের দায়িত্ব পালনে অবহেলার সামিল। যদি কোন বাধা থাকতো তবে তা প্রকাশ হয়ে পড়তো। যেহেতু রাসুল (সঃ) দ্বিনের কোন বিষয় অসম্পূর্ণ রেখে যান নি। সেহেতু তাঁর অবর্তমানে তাঁর প্রাণপ্রিয় ইসলামের এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় (খলিফাতুর রাসুল) অসম্পূর্ণ বা অমীমাংসিত রেখে যেতে পারেন না, এটাই সর্বসম্মত মত। হয়ত তিনি এমন কর্মপন্থা প্রস্তাব করে গেছেন যা কার্যকর হলে অন্যদের হস্তক্ষেপ থেকে দ্বিনি নিরাপদ থাকত ।
এখন প্রশ্ন হলো সেই কর্মপন্থাটি কী? যদি মনে করা হয় তা উন্মাহর ঐকমত্য, তাহলে তা সত্যিকারভাবে প্রতিফলিত হতে পারে না, কারণ এতে প্রত্যেক ব্যক্তির সম্মতি প্রয়োজন। কিন্তু মানব প্রকৃতির প্রতি লক্ষ্য করলে সহজেই অনুমিত হবে যে, কোন একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে সকল মানুষের সম্মতি সম্পূর্ণ অসম্ভব। এমন একটা বিষয়ের উদাহরণ দেয়া যাবে না যাতে কোন না কোন ব্যক্তি ভিন্নমত পোষণ করে নি। খেলাফতের মতো একটা মৌলিক বিষয় কিভাবে উম্মাহর সর্বসম্মত ঐক্য নামক অসম্ভব কর্মপন্থার উপর নির্ভর করতে পারে? অথচ ইসলামের ভবিষ্যত আর মুসলিমের কল্যাণ এ মৌলিক বিষয়টির মুখাপেক্ষী। সুতরাং মৌলিক বিষয়ের জন্য একটা অসম্ভব প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে বিবেক সাড়া দেয় না। এ প্রক্রিয়ার পক্ষে রাসুলের (সঃ) কোন হাদিস কেউ দেখাতে পারবে না। ইজিং যথার্থই লেখেছেনঃ জেনে রাখো, খেলাফত নির্বাচনের মাধ্যমে ঐকমত্যের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে না । কারা এর স্বপক্ষে কোন ন্যায়সঙ্গত যুক্তি অথবা হাদিস দেখাতে পারবে না । বস্তুত সর্বসম্মত ঐকমত্যের সমর্থকগণ যখন দেখলো নির্বাচনে সকলের সম্মতি একটা দুরূহ ব্যাপার তখন তারা সর্বঐকমত্যের বিকল্প হিসাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের ঐকমত্য গ্রহণ করলো এবং তাতে সংখ্যালঘিষ্ঠের মতামত
দারুণভাবে উপেক্ষিত হলো । এসবক্ষেত্রে অনেক সময় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত এমন গতি পরিগ্রহ করে যাতে ন্যায়-অন্যায়, শুদ্ধ-অশুদ্ধ,
ব্যক্তির গুণাগুণ ও উপযুক্ততা বিচার করার কোন সুযোগ থাকে না। এতে প্রকৃত উপযুক্ত ব্যক্তি অগোচরে থেকে যায় এবং অনুপযুক্ত ব্যক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। যেখানে মানুষের যোগ্যতাকে সংখ্যাগরিষ্ঠের অযৌক্তিক প্রবাহ দ্বারা প্রদমিত করা হয় এবং প্রভাবশালীদের ব্যক্তিগত লক্ষ্য ন্যায়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সেখানে যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচন করা দুরাশা মাত্র। যদি ধরাও হয় যে, ভোটারগণ পক্ষপাতবিহীন দৃষ্টিকোণ থেকে নির্বাচন বিবেচনা করেছে এবং তাদের কারো কোন বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল না। তবুও সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত সঠিক বা তা বিপথে যেতে পারে না এমন মনে করার কোন কারণ নেই। বাস্তবে দেখা গেছে, পরীক্ষা নিরীক্ষার পর সংখ্যাগরিষ্ঠগণ নিজেদের মতামত ভুল হয়েছে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠগণের প্রতিটি সিদ্ধান্ত যদি সঠিক বলে মনে করা হয় তবে শেষোক্ত সিদ্ধান্ত যার দ্বারা অন্য একটি সিদ্ধান্তকে ভুল বলে স্বীকার করা হয়েছে—তা নিশ্চয়ই ভুল। এ অবস্থায় ইসলামের খলিফা। নির্বাচন যদি ভুল হয়ে থাকে তবে সে ভুলের জন্য দায়ী কে? এবং ইসলামি প্রশাসনিক ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য কাকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে? একইভাবে খলিফা নির্বাচনোত্তর বিক্ষোভ ও সন্ত্রাসে যে রক্তপাত ও হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে তার দায়-দায়িত্ব কার? যে সমস্ত লোক সর্বদা রাসুলের (সঃ) সম্মুখে বসে। থাকতো তারা যেখানে পরস্পর বাগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়েছে, সেখানে অন্য লোক বাদ পড়ার কথা চিন্তা করা যায় কিভাবে?
যদি ধরা হয় যে, ভবিষ্যত অমঙ্গল এড়ানোর জন্য রাসুল (সঃ) খলিফা নির্বাচন দায়িত্ববান লোকদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন যেন তারা তাদের পছন্দ মতো একজনকে নির্বাচিত করে নেয়, তা হলেও একই দ্বন্দু ও সাংঘর্ষিক অবস্থা বিরাজমান থেকে যায়। কারণ সব লোক ব্যক্তিগত স্বার্থ ও লক্ষ্যের উর্ধে ওঠে একই বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করে কোন কিছু মেনে নিতে পারে না। বস্তুত এক্ষেত্রে দ্বন্দু ও সংঘর্ষের সম্ভাবনা বেশি ছিল, কারণ সকলে না হলেও অধিকাংশ লোক খলিফা পদে প্রার্থ হয়ে বিপক্ষকে পরাজিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতো। এ চেষ্টার অবশ্যম্ভাবী ফল হতো পারস্পরিক হানাহানি ও সার্বিক অমঙ্গল । সর্বঐকমত্য প্রক্রিয়ায় বিশেষ ব্যক্তির স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব ছিল না বলেই “সংখ্যাগরিষ্ঠ” পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছিল। এতে একজন যোগ্য ব্যক্তি বেছে নেয়ার পরিবর্তে সংখ্যাগরিষ্ঠগণ তাদের মধ্যকার কারো ব্যক্তিগত সুবিধা অর্জনে যন্ত্রের মতে কাজ করেছিল। আবার, এসব কর্তৃত্বকারী লোকদের যোগ্যতার মাপকাঠি কী ছিল? তাদের যোগ্যতা তা-ই ছিল যা সচরাচর প্রচলিত অর্থাৎ কজন অন্ধ সমর্থক জোগাড় করে জোরালো বক্তব্য দ্বারা সভায় উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারলেই কর্তৃত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বলে সবাই গণ্য করে। কিন্তু প্রথম খলিফা নির্বাচনের রীতিটি দ্বিতীয় খলিফা উমরের বেলায় নজির হিসাবে গ্রহণ করা হয়নি। অথচ সর্বসম্মতভাবে কোন নীতি গৃহীত হলে তা স্থায়ী নীতি হিসাবে ভবিষ্যতের জন্য পালনীয় হয়ে থাকে।
সকিফাহ-ই-সাঈদাহর তথাকথিত সর্বসম্মত নির্বাচনের অবস্থা এরূপ ছিল যে, এক ব্যক্তির (উমর) কর্মতৎপরতাকে সর্বসম্মত নির্বাচন এবং এক ব্যক্তির কার্যাবলীকে আলোচনা সভা নামে চালিযে দেয়া হয়েছে। আবু বকর ভালভাবেই জানতেন যে, নির্বাচন মানে দু একজন লোকের ভোট নয়— সাধারণ জনগণের ভোট । তাই তিনি সুকৌশলে সর্বসম্মত নির্বাচন বা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট বা নির্বাচনী সভার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণকে উপেক্ষা করে উমরকে মনোনয়ন করেছিলেন । আয়শাও মনে করতেন জনগণের ভোটের উপর খেলাফতের বিষয়টি ছেড়ে দিলে অকল্যাণ ও সমস্যার সৃষ্টি হবে। তাই উমরের মৃত্যুকালে তিনি বাণী পাঠালেন—
ইসলামি উম্মাহকে নেতাবিহীন অবস্থায় রেখে যাবেন না । একজন খলিফা মনোনয়ন করুন অন্যথায় আমি অমঙ্গল ও সমস্যার আশঙ্কা করছি ।
নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের দ্বারা যখন নির্বাচন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো তখন “জোর যার মুলুক তার” নিয়মনীতিতে পরিণত হলো। যে অন্যদেরকে বশে আনতে পেরেছে, তাদের আনুগত্য আদায় করে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণাধীন করতে পেরেছে, সে-ই রাসুলের প্রকৃত উত্তরাধিকারী ও খলিফারূপে গৃহীত হয়েছে। এসব রীতি প্রভাবশালীদের স্ব-রচিত। এসব রীতি-নীতি রাসুলের (সঃ) বাণীর বিপরীত যা তিনি তাবুকের যুদ্ধে হিজরাহর রাতে পারিবারিক ভোজে সুরা আল-বারায়াহ্ (সুরা তওবা) জ্ঞাত করতে গিয়ে এবং গাদির-ই-খুমের ভাষণে বলেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, যেখানে প্রথম তিন জন খলিফার প্রত্যেকেই একে অপরের পছন্দ দ্বারা মনোনীত হয়েছেন, সেখানে রাসুলের এহেন পছন্দের কথা স্বীকার করার কোন যুক্তি থাকতে পারে না। বিশেষত মতবিরোধ রোধ করার জন্য এটাই ছিল একমাত্র উপায়। রাসুল (সঃ) বিষয়টি কারো হাতে ছেড়ে না দিয়ে নিজেই সমাধান করে গেছেন। এটা অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য সঠিক প্রক্রিয়া এবং রাসুলের (সঃ) সুনির্দিষ্ট বাণী দ্বারা সমর্থনপুষ্টও বটে।
৩ । ইয়ামামাহর হাইয়্যান ইবনে সামিন আল-হানাফি ছিলেন হানিফা গোত্রের প্রধান। তিনি দুর্গাধিপতি এবং সেনাবাহিনীর প্রধানও ছিলেন। জাবির ছিলেন তার অনুজ এবং আল-আশা (প্রকৃত নাম সাইমুন ইবনে কায়েস ইবনে জন্দল) তার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। হাইয়্যানের বদান্যতায় আমিরুল মোমেনিন সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলেন। এ খোৎবায় তিনি তার বর্তমান জীবন যাপনকে পূর্ববতী অবস্থার সাথে তুলনা করেছেন। বস্তুত আমিরুল মোমেনিন বর্তমান সমস্যা সংকুল অবস্থার সাথে রাসুলের (সঃ) তত্ত্বাবধানে শান্তিময় অবস্থার তুলনা করেছেন। বর্তমানে যারা ক্ষমতা দখল করে আছে রাসুলের জীবদ্দশায় তাদের কোন গুরুত্বই ছিল না। তখন আলীর ব্যক্তিত্বের কারণে তাদের প্রতি কারো তেমন মনোযোগ ছিল না। রাসুলের (সঃ) তিরোধানের পর সময় বদলে গেছে। তাই এক সময়ের অগুরুত্বপূর্ণ লোকগুলোই মুসলিম বিশ্বের প্রভু হয়ে বসেছে।
আবু লুলুআহ কর্তৃক আহত হবার পর উমর যখন বুঝতে পারলেন যে, তিনি আর বাঁচবেন না তখন তিনি খেলাফত বিষয়ে একটা পরামর্শক কমিটি গঠন করলেন। এ কমিটিতে তিনি আলী ইবনে আবি তালিব, উসমান ইবনে আফফান, আবদুর রহমান ইবনে আউফ, জুবায়ের ইবনে আওয়ান, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ও তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহকে সদস্য মনোনীত করলেন। তিনি পরামর্শক কমিটিকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করলেন যেন তার মৃত্যুর তিন দিন পর তাদের মধ্য থেকে একজনকে খলিফা হিসাবে নিয়োগে করেন এবং এ তিন দিন সুহাইব যেন খলিফার কাজ চালিয়ে নেন। এসব নির্দেশাবলী পাওয়ার পর কমিটির কয়েকজন সদস্য তাকে অনুরোধ নিতে পারে। উমর প্রত্যেক সদস্য সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত মতামত ব্যক্ত করে বললেন, “সাদ রূঢ় মেজাজের ও উগ্র মস্তিস্কের লোক; আবদুর রহমান উম্মাহর ফেরাউন; জুবায়ের স্বার্থে তুষ্ট হলে সত্যিকার ইমানদার কিন্তু স্বার্থ সিদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটলে কট্টর বেইমান হয়ে পড়ে; তালহা অহংকারী ও উদ্ধত প্রকৃতির—তাকে খলিফা নিয়োগে করলে সে খেলাফতের আংটি তার স্ত্রীর আঙ্গুলো পরিয়ে দেবে; উসমান তার জ্ঞাতি গোষ্ঠির বাইরে আর কিছুই দেখতে পায় না এবং আলী যদিও খেলাফতের প্রতি বেশি অনুরক্ত তবুও (আমার মতে)। শুধুমাত্র তিনিই খেলাফতকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারবেন।” আলীর যোগ্যতা সম্পর্কে এরূপ স্পষ্ট ধারণা থাকা সত্ত্বেও উমর পরামর্শক কমিটি গঠন করেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল খেলাফত যেন তার ইচ্ছার অনুকূলে যেতে পারে (অর্থাৎ আলীকে বঞ্চিত করা) এবং সেভাবেই তিনি পরামর্শক কমিটির সদস্য মনোনয়ন ও কমিটির কার্যপ্ৰণালী নির্ধারণ করেছেন। একজন সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরও এ কথা বুঝতে কষ্ট হবে না যে, পরামর্শক কমিটির গঠন ও তার কার্যপ্রণালীর মধ্যেই উসমানের জয়ের সকল উপাদান নিহিত আছে। কমিটির সদস্যদের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, আবদুর রহমান ইবনে আউফ উসমানের ভগ্নীপতি; সাদ ইবনে ওয়াক্কাস আবদুর রহমানের আত্মীয় ও জ্ঞাতি এবং সে সর্বদা আলীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতো। তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ। উসমানের প্রতি অনুরক্ত ছিল এবং সে আলীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতো। কারণ তালহা ছিল তায়মি গোত্রের। আবু বকরের খেলাফত দখলের ফলে তায়মি ও হাশেমি গোত্রের মধ্যে সম্পর্ক ভাল ছিল না। এমতাবস্থায় জুবায়ের আলীর পক্ষে ভোট দিলেও উসমানের জয়ের জন্য তার একটা ভোট কোন বাধা হয়ে দাড়ায় না। কেউ কেউ লেখেছেন। পরামর্শক কমিটির বৈঠকের দিন তালহা মদিনায় উপস্থিত ছিল না। তার অনুপস্থিতি এমনকি তাকে যদি আলীর পক্ষেও ধরা হয় তবুও উসমানের জয় অনিবার্য। কারণ উমর তার বিচক্ষণতা দিয়ে যে কার্যপ্রণালী করে দিয়েছেন তা উসমানের জয় সুনিশ্চিত করে দিয়েছে। কার্যপ্রণালীটি নিম্নরূপঃ যদি দুজন সদস্য একজন প্রার্থীর পক্ষে যায় এবং অপর দুজন সদস্য অন্য প্রার্থীর পক্ষে যায়। তবে আবদুল্লাহ ইবনে উমর মধ্যস্তৃতা করবে। আবদুল্লাহ যে পক্ষকে নির্দেশ দেবে সে পক্ষ খলিফা নিয়োগ করবে। আবদুল্লাহ ইবনে উমরের রায় যদি তারা মেনে না নেয়। তবে আবদুর রহমান ইবনে আউফ, যার পক্ষে থাকবে। আবদুল্লাহ সে পক্ষ সমর্থনা করবে; অপরপক্ষ এ রায় অমান্য করলে তাদের মাথা কেটে হত্যা করা হবে । (তাবারী’, ১ম খন্ড, পৃঃ ২৭৭৯
২৭৮০; আন্থীর, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৬৭) এখানে আবদুল্লাহ্ ইবনে উমরের রায়ে অসম্মতির কোন অর্থ হয় না। কারণ আবদুর রহমান ইবনে আউফ যার পক্ষে থাকবে তাকে সমর্থন দেয়ার জন্য আবদুল্লাহকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উমর তার পুত্র আবদুল্লাহ ও সুহাইবকে নির্দেশ দিয়েছিলেন— যদি মানুষ মতভেদ করে তোমরা সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষাবলম্বন করো, কিন্তু যদি তিনজন একদিকে এবং অপর তিনজন অপরদিকে থাকে। তবে আবদুর রহমান ইবনে আউফ যে দিকে
থাকবে তোমরা সেদিকে থেকে । (তাবারী* ১ম খন্ড, পৃঃ ২৭২৫; অ্যাহীর, ৩য় খন্ড, ? ര)
এ নির্দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলতে আবদুর রহমান ইবনে আউফকেই বুঝানো হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ অন্য কারো পক্ষে হবার কোন সম্ভাবনা ছিল না। কারণ আবদুর রহমানের আদেশের অপেক্ষায় পঞ্চাশটি রক্ত-পিপাসু। তরবারি বিরোধী পক্ষের জন্য প্রস্তুত ছিল। অবস্থাদৃষ্ট আমিরুল মোমেনিন আগেই তার চাচা আব্বাসকে বলেছিলেন যে, উসমান খলিফা হতে যাচ্ছে, কারণ উমর সে পথই পরিস্কার করে দিয়ে গেছে। যাহোক উমরের মৃত্যুর পর আয়শার ঘরে নির্বাচনী সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সভা চলাকালে আবু তালহা আল-আনসারীর নেতৃত্বে পঞ্চাশ জন লোক উন্মুক্ত তরবারি হাতে দরজায় দাঁড়িয়েছিল। তালহা সভার কার্য শুরু করলেন এবং উপস্থিত সকলকে সাক্ষী রেখে নিজের ভোট উসমানের পক্ষে প্রদান করলেন । এতে জুবায়রের আত্মসম্মানবোধে আঘাত লেগেছে। কারণ তার মা সাফিয়াহ ছিলেন আবদুল মুত্তালিবের কন্যা ও আমিরুল মোমেনিনের ফুফু। সুতরাং তিনি আলীর পক্ষে ভোট দিলেন। এরপর সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস তার ভোট আবদুর রহমানের পক্ষে প্রদান করলো। এতে তিনজনের প্রত্যেকেই এক ভোট করে পেয়ে সমান হলো। সুচতুর আবদুর রহমান এ অবস্থায় একটি ফাঁদ পেতে বললো, “আলী ও উসমান তাদের দুজন থেকে একজনকে খলিফা মনোনয়ন করার ক্ষমতা যদি আমাকে অপ্রবন করে তবে আমি আমার প্রার্থতি প্রত্যাহার করে নেব । অথবা তাদের দুজনের একজন প্রার্থতা প্রত্যাহার করে খলিফা মনোনয়নের ক্ষমতা অর্জন করতে পারে।” আবদুর রহমানের এ ফাদ আলীকে সব দিক থেকে জড়িয়ে ফেললো। কারণ এ প্রস্তাবে হয় তাকে নিজের অধিকার ছেড়ে দিয়ে খলিফা মনোনীত করতে হবে, না হয় আবদুর রহমান ক্ষমতাপ্ৰাপ্ত হয়ে তার ইচ্ছামতো যা করে তা-ই মেনে নিতে হবে। নিজের ন্যায্য অধিকার ছেড়ে দিয়ে উসমান অথবা আবদুর রহমানকে খলিফা মনোনীত করা আলীর পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব ছিল না। প্রথম থেকেই তিনি বঞ্চিত হয়েও তার অধিকারের দাবি কখনো ছেড়ে দেন নি। কাজেই এবারও তিনি নিজের অধিকার আঁকড়ে ধরে রাখলেন। তা না হলে তার মনোনীত খলিফা কর্তৃক ইসলামি উম্মাহর ক্ষতির জন্য তিনিই দায়ী হতেন। সুতরাং আবদুর রহমান নিজেই তার প্রার্থতা প্রত্যাহার করে মনোনয়নের ক্ষমতা গ্রহণ করলো এবং আমিরুল মোমেনিনকে বললো, “আপনি যদি কুরআন, সুন্নাহ ও পূর্ববতী দু খলিফার রীতি-নীতি ও কর্মকান্ড মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দেন তাহলে আমি আপনার বায়াত নেব।” প্রত্যুত্তরে আলী বললেন, “আমি কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আমার বিচার বিবেচনা অনুযায়ী কাজ করবো।” তিনি তিনবার জিজ্ঞাসিত হলেন এবং তিনবারই একই উত্তর দিলেন। এরপর আবদুর রহমান উসমানের দিকে ফিরে বললো, “আপনি কি শর্তগুলো মেনে চলতে পারবেন?” উসমান সন্তুষ্ট চিত্তে তা মেনে নিলেন এবং আবদুর রহমান তার বায়াত গ্রহণ করলো। এভাবে আমিরুল মোমেনিনের অধিকার ও দাবি পদদলিত হলে তিনি বললেনঃ এটা প্ৰথম দিন নয় যে, তোমরা আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করেছো। আমাকে শুধু ধৈর্য ধারণই করতে হবে ; তোমরা যা কিছু বল আল্লাহ তার বিরুদ্ধে সাহায্যকারী। আল্লাহর কসম, তুমি এ আশা ব্যতীত উসমানকে খলিফা বানাও নিজে সে তোমাকে খেলাফত ফিরিয়ে দেবে। ইবনে আবিল হাদীদ লেখেছেন যে, উসমানকে খলিফা নিয়োগ করে সভার কার্য সমাপ্ত করার পর আলী উসমান ও আবদুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আল্লাহ্ তোমাদের দুজনের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করুন।” আলীর একথা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছিল। উসমান ও আবদুর রহমান একে অপরের এরূপ শক্রতে পরিণত হয়েছিল যে, জীবদ্দশায় তারা একে অপরের সাথে কথা পর্যন্ত বলে নি। এমনকি উসমানের মৃত্যুশয্যায় আবদুর রহমান তাকে দেখতেও যায় নি। ঘটনা প্রবাহ থেকে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে শূরা (পরামর্শক কমিটি) বলতে বিষয়টি প্রথমত ছয় জন, তারপর তিনজন এবং সর্বশেষে একজনের হাতে ন্যস্ত করাকে বুঝিয়েছে কি? তদুপরি পূর্বের দু খলিফার কর্মকান্ড অনুসরণ করার শর্ত কি উমর আরোপ করেছিল? নাকি আলী ও খেলাফতের মধ্যে একটা অন্তরায় সৃষ্টি করার জন্য আবদুর রহমান এ শর্ত জুড়ে দিয়েছিল? আবু বকর তার স্থলে উমরকে মনোনীত করার সময় তো তার পদাঙ্ক অনুসরণের শর্ত উমরকে দেয় নি? তাহলে আলীর ক্ষেত্রে এহেন শর্ত আরোপের উদ্দেশ্য কী?
৫। তৃতীয় খলিফার রাজত্বকাল সম্পর্কে আমিরুল মোমেনিন বলেন যে, উসমান ক্ষমতায় আসার পর পরই উমাইয়া গোত্র সুবিধা পেয়ে গেল এবং বায়তুল মাল লুটপাট শুরু করে দিল। খরায় শুকিয়ে যাওয়া অঞ্চলের গরুর পাল সবুজ ঘাস দেখলে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে উমাইয়া গোত্রও সেভাবে আল্লাহর সম্পদের (বায়তুল মাল) ওপর পড়লো এবং গোগ্রাসে তা নিঃশেষ করতে লাগল। অবশেষে উসমানের প্রশ্রয় ও স্বজনপ্রীতি এমন এক পর্যায়ে গেল। যখন মানুষ তার ঘর অবরোধ করে তরবারি দ্বারা তাকে আঘাত করলো এবং সে যা গলাধঃকরণ করেছিল তা বমি করায়ে ছাড়লো। উসমানের সময়ে কু-শাসন এমনভাবে বিরাজ করেছিলো যে, উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবাগণের অকদর ও দারিদ্র দেখে কোন মুসলিম স্থির থাকতে পারতো না। অথচ সমুদয় বায়তুল মাল উমাইয়া গোত্রের নিয়ন্ত্রণে ছিল; সরকারী পদসমূহ তাদের অনভিজ্ঞ যুবক শ্রেণির দখলে ছিল, মুসলিমদের বিশেষ সম্পদ (রাষ্ট্রয়াত্ সম্পদ) তাদের মালিকানায় ছিল; চারণভূমি তাদের পশুপালের জন্য নির্ধারিত ছিল। গৃহ নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু শুধুমাত্র তাদের দ্বারা এবং ফলের বাগান ছিল। কিন্তু তা শুধু তাদের জন্য। যদি কোন সহৃদয় ব্যক্তি এসব বাড়াবাড়ির কথা বলতো তবে তার পাজর ভেঙ্গে দেয়া হতো। এহেন আত্মসাতের জন্য কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করলে তাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হতো। দরিদ্র ও দুস্থদের জাকাত এবং সর্বসাধারণের বায়তুল মালের কি অবস্থা উসমান করেছিল তার নমুনা নিমের গুটিকতেক উদাহরণ থেকে অনুমান করা যাবেঃ (১) হাকাম ইবনে আবুল আসকে রাসুল (সঃ) মদিনা থেকে বহিস্কার করেছিলেন। রাসুলের সুন্নাহ ও পূর্ববতী খলিফাদ্বয়ের নীতি ভঙ্গ করে উসমান তাকেই মদিনায় এনে বায়তুল মাল থেকে তিন লক্ষ দিরহাম দিয়েছিলেন (বালাজুরী’, পৃঃ ২৭, ২৮, ১২৫)। (২) পবিত্র কুরআনে মোনাফেক বলে ঘোষিত অলিদ ইবনে উকবাহকে বায়তুল মাল থেকে এক লক্ষ
দিরহাম দেয়া হয়েছে (রাব্বিহ”, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৯৪)। (৩) উসমান তার কন্যা উন্মে। আবানকে মারওয়ান ইবনে হাকামের নিকট বিয়ে দিয়ে বায়তুল মাল থেকে
তাকে এক লক্ষ দিরহাম দিয়েছিলেন (হাদীদ ***, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৯৮-১৯৯)। (৪) উসমান তার কন্যা আয়শাকে হারিছ ইবনে হাকামের নিকট বিয়ে দিয়ে তাকে বায়তুল মাল থেকে
এক লক্ষ দিরহাম দিয়েছিলেন (প্রাগুপ্ত)। (৫) তিনি আবদুল্লাহ্ ইবনে খালিদকে চার লক্ষ দিরহাম দিয়েছিলেন (কুতায়বাহ্”, b8) (৬) আফ্রিকা থেকে খুমসা হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ থেকে পাঁচ লক্ষ দিরহাম মারওয়ান ইবনে হাকামকে
দিয়েছিলেন (প্রাগুপ্ত)। (৭) সাধারণ বদ্যান্যতার কারণ দেখিয়ে রাসুলের প্রাণপ্রিয় কন্যার রাষ্ট্রায়ত্ব ‘ফদক’। মারওয়ান ইবনে হাকামকে দান করেছিলেন (প্রাগুপ্ত)।
(৮) মদিনার মাহজুব নামক বাণিজ্য এলাকা জনগণের ট্রাস্ট হিসাবে রাসুল (সঃ) ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু উসমান তা তার জামাতা হারিছ ইবনে হাকামকে দান করেছিলেন (প্রাগুপ্ত)। (৯) মদিনার চারপাশের তৃণভূমিতে উমাইয়া গোত্র ছাড়া অন্য কারো উটকে চরতে দেয়া হতো না (হাদীদ’, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৯৯)। (১০) উসমানের মৃত্যুর পর তার ঘরে পঞ্চাশ হাজার দিনার (স্বর্ণ মুদ্রা) ও দশ লক্ষ দিরহাম (রৌপ্য মুদ্রা) পাওয়া গিয়েছিল। তার নাখারাজ জমির কোন সীমা ছিল না। ওয়াদি-আল কুরা ও হুনায়েনে তার মালিকানাধীন ভূ-সম্পত্তির মূল্য ছিল এক লক্ষ দিনার। তার উট ও ঘোড়ার কোন হিসাব ছিল না। (মাসুদী***, ১ম খন্ড, পৃঃ ৪৩৫)। (১১) প্রধান নগরীগুলো উসমানের আত্মীয়-স্বজনদের শাসনাধীন ছিল। কুফার শাসনকর্তা ছিল অলিন্দ ইবনে উকবা। কিন্তু মন্দাসক্ত অবস্থায় সে ইমামতি করতে গিয়ে ফজরের সালাত দু রাকাতের পরিবর্তে চার রাকাত পড়ায় জনগণ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এতে খলিফা তাকে সরিয়ে অন্যতম চিহ্নিত মোনাফেক। সাঈদ ইবনে আসকে কুফার শাসনকর্তা নিয়োগ করেছিলেন। এভাবে মিশরে
আমিরকে শাসনকর্তা নিয়োগে করে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে প্রশাসনে অরাজকতা সৃষ্টি করেছিলেন(প্রাগুপ্ত)।