উসমানের হত্যার প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ করে আমিরুল মোমেনিন বলেনঃ আমি যদি তাকে হত্যা করার আদেশ দিয়ে থাকি তা হলে আমিই হত্যাকারী। আর আমি যদি হত্যাকান্ডে অন্যদের বাধা দিয়ে থাকি তবে আমি তার সাহায্যকারী ছিলাম। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, যে ব্যক্তি তাকে সাহায্য করেছে। সে এখন আর বলতে পারে না যে, সে ওই ব্যক্তি অপেক্ষা উত্তম যে তাকে পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিল। আবার যে তাকে পরিত্যাগ করেছিল সেও বলতে পারে না যে, সে তার সাহায্যকারী অপেক্ষা উত্তম। আমি তার বিষয়াবলী তোমাদের কাছে খুলে বলছি। সে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে এবং সম্পদ আত্মসাৎ করেছে। এ কাজগুলো সে অত্যন্ত ন্যাক্কার জনক ভাবে করেছিল। তোমরা তার এসব কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু তাতে অনেক বাড়াবাড়ি করে ফেলেছো। সম্পদ আত্মসাৎকারী ও প্রতিবাদীদের মধ্যে যা ঘটেছে তার প্রকৃত সত্য আল্লাহই জানেন।
১ । উসমান ইবনে আফফান উমাইয়া বংশের প্রথম খলিফা। তিনি সত্তর বছর বয়সে ১ মুহররম, ২৪ হিজরি সনে খেলাফতে আরোহণ করেন। বার বছর মুসলিমদের শাসনকার্য পরিচালনার পর ৩৫ হিজরি সনের ১৮ জিলহজ তারিখে জনগণের হাতে নিহত হন। হাশশ কাওকাবে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
এ সত্য অস্বীকার করার কোন জো নেই যে, উসমানের দুর্বলতা এবং তার অফিসারগণের (যাদের প্রায় সকলেই ছিল উমাইয়া গোত্রের) কুকর্ম মূলত তার হত্যার কারণ। উসমানকে হত্যা করার জন্য মুসলিমগণের সর্বসম্মত ঐকমত্যের পিছনে আর কোন কারণ ছিল না। মুসলিমগণের মধ্যে তার ঘরের মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া আর কেউ তাকে রক্ষার্থে এগিয়ে আসে নি। তাকে হত্যার সিদ্ধান্তকালে মুসলিমগণ তার বয়স, তার জ্যেষ্ঠত্ব, তার মান-সন্ত্রম এমনকি রাসুলের বিশিষ্ট সাহাবা হওয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করেছিল। কিন্তু তার কর্মকান্ড পরিস্থিতিকে এমনভাবে ঘোলাটে করেছিল যে, তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে একটা লোকও তার পক্ষে মত প্রকাশ করে নি। রাসুলের উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সাহাবাগণের প্রতি যে হারে নির্যাতন আর বাড়াবাড়ি করা হয়েছিল তা বর্ণনাতীত এবং তাতেই আরব গোত্রগুলোর মধ্যে শোক ও ক্রোধের উত্তাল উর্মি বয়ে চলেছিল। প্রত্যেককেই ক্রুদ্ধ করা হয়েছিল এবং সকলেই ঘৃণাভরে তার ঔদ্ধত্য ও ভ্রান্ত ক্রিয়াকলাপ দেখে যাচ্ছিলো। আবু জর গিফারীকে নির্মমভাবে অপমান করা হয়েছিল এবং গিফার গোত্রকে বহিষ্কার করার ফলে তাদের বন্ধুগোত্রগুলো ক্ষিপ্ত হয়েছিল। আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদকে নির্দয়ভাবে প্রহার করায় হুজায়েল গোত্র ও তাদের বন্ধুগোত্রগুলো রুষ্ট ছিল। স্মার ইবনে ইয়াসিরের পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে দেয়ায় বনি মাখজুম ও তাদের বন্ধু বনি জুহরাহ ক্রোধে বারুদ হয়েছিল। মুহাম্মদ ইবনে আবি বকরকে হত্যার ষড়যন্ত্র করায় বনি তায়েম ক্ষিপ্ত ছিল। এসব গোত্রের হৃদয়ে সর্বদা প্রতিশোধের ঝড় বইতে। অন্যান্য শহরের মুসলিমগণ উসমানের অফিসারদের হাতে নিগৃহীত হয়ে অসংখ্য অভিযোগ করেছিল। কিন্তু অভিযোগগুলোকে কখনো পাত্তা দেয়া হয় নি। অফিসারগণ সম্পদ আর জাকজমকের নেশায় যা ইচ্ছে তা করে বসতো। এমন কি যাকে খুশী যখন তখন অপমানিত, লাঞ্ছিত ও ধ্বংস করে দিত। রাষ্ট্রের কেন্দ্র থেকে কোন প্ৰকাৰ তদন্ত বা শাস্তির ভয় তাদের ছিল না। তাদের অত্যাচারের যাতাকল থেকে নিস্কৃতি পাবার জন্য মানুষ চিৎকার করে কেঁদেছিলো কিন্তু তাদের কান্না শোনার মতো কেউ ছিল না। মানুষের মাঝে ঘূণা আর অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এ রোষানল প্রশমিত করার মতো কেউ ছিল না। রাসুলের সাহাবাগণ যখন দেখলেন শান্তি বিনষ্ট হয়ে গেছে, প্রশাসনে মারত্মক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে এবং ইসলামের মূল বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে তখন তারা ক্ষোভে দুঃখে দারুণ বিরক্ত হয়ে পড়লেন। দীনহীন ও বুভুক্ষু লোকেরা যখন এক টুকরো রুটির জন্য হাহাকার করছিলো, উমাইয়া গোত্রের লোকেরা তখন সম্পদের স্তুপে গড়াগড়ি যাচ্ছিলো। খেলাফত পরিণত হয়েছিল উদরপূর্তি আর সম্পদ স্তুপীকরণের হাতিয়ারে। ফলে এসব অত্যাচারিত, নির্যাতিত, নিগৃহীত ও বুভুক্ষু জনগণ উসমানের হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করতে পিছে পড়ে থাকে নি। খলিফার বিভিন্ন পত্র ও বার্তায় দেখা যায় যে, কুফা, বসরা ও মিশর থেকে বহু মানুষ তাদের সমস্যা নিয়ে মদিনায় জড়ো হয়েছিল এবং মদিনাবাসীদের সহানুভূতি অর্জনে সমর্থ হয়েছিল। মদিনাবাসীদের এহেন আচরণ দেখে উসমান মুয়াবিয়াকে লেখেছিলঃ
মদিনার জনগণ মতবিরোধী হয়ে গেছে, আমার অনুগত থাকার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে এবং আনুগত্যের শপথ ভঙ্গ করেছে। কাজেই তুমি আমাকে দ্রুতগামী বলিষ্ঠ আশ্বারোহী সৈন্য পাঠাও।
এ পত্র পেয়ে মুয়াবিয়াহ যে কার্যক্রম গ্রহণ করেছে তা থেকে সাহাবাগণের অবস্থা অনেকটা অনুমেয়। ঐতিহাসিক তারাবী লিখেছেনঃ যখন মুয়াবিয়ার হাতে উসমানের পত্রখানা পৌছলো তখন সে বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা করে। দেখলো এবং রাসুলের সাহাবাগণের বিরোধিতা প্রকাশ্যে করা সঠিক পদক্ষেপ বলে বিবেচনা করেনি কারণ মদিনীয় সাহাবাগণের ঐকমত্য সম্পর্কে সে ভালোভাবে অবগত ছিল। এ সকল অবস্থার বিবেচনায় উসমানের হত্যাকে কতিপয় অতি উৎসাহী লোকের তাৎক্ষণিক অনুভূতির ফল মনে করে মুষ্টিমেয় বিদ্রোহীর উপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিলে সত্যকে অবগুষ্ঠিত করা হবে মাত্র। উসমানের বিরোধিতা করার মতো ক্ষেত্ৰসমূহ মদিনাতেই তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। যারা বাইরের থেকে এসেছিল তারা শুধু তাদের দুর্দশা লাঘবের দাবি নিয়েই মন্দিনায় জড়ো হয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল অবস্থার উন্নতি সাধন করা-রক্তপাত বা হত্যা নয়। যদি তাদের অভিযোগ শোনা হতো তাহলে হয়তো রক্তপাত ঘটতো না ।
প্রকৃতপক্ষে যা ঘটেছিল তা হলো-উসমানের বৈমাত্রেয় ভাই আবদুল্লাহ ইবনে সা’দ ইবনে আবি সারোহর (মিশরের গভর্নর) অত্যাচারে মিশরের জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে মদিনায় এসে শহরের অদূরে জাকুশুব নামক উপত্যকায় অবস্থান নিয়েছিল। তাদের স্মারকলিপিসহ তারা একজন নেতৃস্থানীয় লোককে উসমানের নিকট প্রেরণ করে সা’দের অত্যাচার বন্ধ করার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু উসমান মিশরবাসীর প্রেরিত লোকটিকে কোন জবাব না দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেয় এবং এসব বিষয় দেখার যোগ্য নয় বলে মনে করে। এ ঘটনার পর মিশরবাসীগণ চিৎকার করতে করতে মদিনা শহরে ঢুকে পড়েছিল এবং উসমানের অহংকার, ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও দুর্ব্যবহারের কথা মদিনাবাসীকে জানিয়ে প্রতিকার চাইতে লাগলো। অপরদিকে বসরা ও কুফার যেসব লোক অভিযোগ নিয়ে মদিনায় এসেছিল তারাও মিশরবাসীদের সাথে যোগ দিয়েছিল। এমনিতেই মদিনার জনগণ ক্ষুব্ধ ছিল । ফলে মদিনাবাসীদের সহায়তায় বহিরাগতগণ উসমানের ঘরের দিকে অগ্রসর হয়ে ঘর অবরোধ করে ফেলেছিল। অবশ্য এ অবরোধে খলিফার মসজিদে আসা যাওয়ায় কোন বাধা ছিল না। এ অবরোধের প্রথম শুক্রবারে উসমান তার খোৎবায় অবরোধকারীদের সাংঘাতিকভাবে তিরস্কার করে তাদের সন্ত্রাসী ও অপরাধী চক্র বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এতে জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে তার প্রতি নুড়ি-চিল নিক্ষেপ করেছিল যাতে তিনি মিম্বার থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। কয়েকদিন পর অবরোধকারীরা তার মসজিদে আসা যাওয়া নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল।
উদ্ধার করার জন্য উসমান আমিরুল মোমেনিনকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছিলেন। আমিরুল মোমেনিন বললেন, “যেখানে দেখা যাচ্ছে তাদের দাবি-দাওয়া ন্যায়সঙ্গত সেখানে কী শর্তে তাদেরকে সরে যেতে বলবো ।” উসমান বললেন, “এ বিষয়ে আমি আপনাকে সর্বময় ক্ষমতা অৰ্পণ করলাম। আপনি যে শর্তে নিষ্পত্তি করবেন। আমি তা-ই মেনে নিতে বাধ্য থাকবো ।” ফলে আমিরুল মোমেনিন মিশরিয়দের সাথে সাক্ষাত করে বিস্তারিত আলোচনা করলেন। আলোচনায় স্থির হলো—মিশরে স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধের লক্ষ্যে আবদুল্লাহ ইবনে সা’দের পরিবর্তে মুহাম্মদ ফিরে এসে তাদের দাবির কথা জানালেন। উসমান নিদ্বিধায় তাদের দাবি মেনে নিতে স্বীকৃত হলেন এবং বললেন, “এসব বাড়াবাড়ি ও ঝামেলা-ঝক্কি সামলে উঠতে দিন কয়েক সময় লাগবে।” আমিরুল মোমেনিন বললেন, “মদিনাবাসীদের দাবি-দাওয়া সংক্রান্ত বিষয়ে সময় চাওয়া অবান্তর হবে; তবে অন্যান্য এলাকার বিষয়ে খলিফার নির্দেশ পৌছানো পর্যন্ত সময় নেয়া যাবে।” উসমান বললেন, “মদিনার জন্যও অন্তত তিন দিন সময়ের প্রয়োজন।” যা হোক, মিশরিয়দের সাথে আলাপ-আলোচনা করে আমিরুল মোমেনিন সকল শর্তের দায়-দায়িত্ব নিজেই গ্রহণ করলেন এবং তার নির্দেশে তারা অবরোধ তুলে নিয়ে জাকুশুব উপত্যকায় ফিরে গেল। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক মুহাম্মদ ইবনে আবি বকরকে সঙ্গে নিয়ে মিশরের উদ্দেশ্যে চলে গেল। বিষয়টি এখানে নিম্পত্তি হয়ে গেল । অবরোধ তুলে নেয়ার দ্বিতীয় দিনে মারওয়ান ইবনে হাকাম উসমানকে বললো, “আপদ দূর হয়ে গেছে, ভালোই হলো। কিন্তু অন্যান্য শহর থেকে লোকজন আসা বন্ধ করার জন্য এখন আপনাকে একটা বিবৃতি দিতে হবে যে—কিছু অবান্তর কথা শুনে কতিপয় লোক মদিনায় জড়ো হয়েছিল। যখন তারা জানতে পারলো তারা যা শুনেছে তা সম্পূর্ণ ভুল তখন তারা সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে চলে গেছে।” উসমান প্রথমত এমন একটা ডাহা মিথ্যা কথা বলতে রাজি হন নি। কিন্তু মারওয়ানের প্ররোচনায় শেষ পর্যন্ত তিনি মসজিদ-ই-নববীতে বললেনঃ
মিশরিয়গণ তাদের খলিফা সম্পর্কে কতিপয় সংবাদ পেয়েছিল এবং যখন তারা সন্তোষজনকভাবে জানতে পারলো যে, এসব কথা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তখন তারা নিজ শহরে Թիճ1 Ե(61 (h/(շ | ”
উসমানের বক্তব্য শোনা মাত্র মসজিদে হৈ চৈ পড়ে গেল এবং মানুষ চিৎকার করে উসমানকে বলতে লাগলো, “তওবা করুন; আল্লাহকে ভয় করুন, একি ডাহা মিথ্যা আপনার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে।” জনগণের চাপের মুখে সেদিন উসমান তওবা করে কাবার দিকে মুখ ফিরিয়ে বিলাপ করে আল্লাহর দরবারে কান্না-কাটি করে ঘরে ফিরে গেলেন ।
এ ঘটনার পর আমিরুল মোমেনিন উসমানকে উপদেশ দিয়ে বললেন, “তোমার অতীত কুকর্মের জন্য সর্বসমক্ষে তওবা করা উচিত। তাতে এহেন বিদ্রোহ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। নচেৎ আগামীতে অন্য কোন এলাকার জনগণ বিদ্রোহী হয়ে এলে তোমাকে উদ্ধার করার জন্য তুমি আমার ঘাড়ে চেপে পড়বে।” ফলত উসমান মসজিদ-ই-নববীতে একটা খোৎবা প্রদান করে নিজের ভুল স্বীকার করে তওবা করলেন এবং ভবিষ্যতে সতর্ক থাকার প্রতিশ্রুতি দিলেন। তিনি জনগণের প্রতিনিধিকে তার সাথে দেখা করার পরামর্শ দিলেন এবং জনগণের দাবি পূরণ ও তাদের দুঃখ-দুর্দশা দূরীভূত করার অঙ্গীকার করলেন। এতে জনগণ সন্তুষ্ট হয়ে তাদের মনের খারাপ অনুভূতি মুছে ফেলে উসমানের এ কাজের প্রশংসা করতে লাগলো। মসজিদ থেকে ঘরে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে মারওয়ান উসমানকে কিছু বলার জন্য এগিয়ে গেলে উসমানের স্ত্রী নাইলাহ্ বিনতে ফারাফিসাহ বাধা দিয়ে বললো, “আল্লাহর দোহাই, তুমি চুপ কর। তুমি এমন সব কথা বলবে যা ওনার মৃত্যু ডেকে আনবে।” মারওয়ান বিরক্ত হয়ে বললো, “এসব বিষয়ে আপনার মাথা ঘামানো উচিত নয়। আপনি এমন এক লোকের কন্যা যে কোন দিন অজু করতেও শেখে নি।” তাদের উভয়ের কথাবার্তা তিক্ততার দিকে যাচ্ছে দেখে উসমান উভয়কে থামিয়ে দিয়ে মারওয়ানকে তার কথা বলার অনুমতি দিলেন। মারওয়ান বললো, “মসজিদে আপনি এসব কী কথা বললেন আর কিসেরই বা তওবা করলেন? আমার মতে এ ধরনের তওবা অপেক্ষা পাপে লিপ্ত থাকা হাজার গুণ শ্ৰেয় । কারণ পাপ যত বেশিই হোক না কেন তাতে তওবার পথ সর্বদা খোলা আছে কিন্তু চাপের মুখে তওবা করা কোন তওবা-ই নয়। আপনি সরল বিশ্বাসে কথা বলেছেন। কিন্তু আপনার প্রকাশ্য ঘোষণার ফলাফল দেখুন— জনতা আপনার দুয়ারে হাজির হয়েছে, এখন তাদের দাবি-দাওয়া পূরণ করুন।” উসমান বললেন, “ঠিক আছে, আমি যা বলেছি— বলেছিই; এখন তুমি জনগণকে ঠেকাও ৷ তাদের সাথে কথা বলা আমার সাধ্যাতীত।” মারওয়ান এ সুযোগ হাত ছাড়া করলো না। সে বেরিয়ে এসে জনগণকে সম্বোধন করে বললো, “তোমরা কেন এখানে জড়ো হয়েছে? তোমরা কি লুটপাট করার জন্য আক্রমণ করতে চাও? মনে রেখো, তোমরা এত সহজে আমাদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিতে পারবে না। তোমরা আমাদেরকে পরাভূত করতে পারবে, এ ধারণা তোমাদের মন থেকে মুছে ফেল। কেউ বল প্রয়োগ করে আমাদেরকে অধীনস্থ করতে পারবে না। তোমাদের কৃষ্ণকায় চেহারা নিয়ে এখান থেকে চলে যাও। আল্লাহ তোমাদেরকে অপমানিত করুন এবং তাঁর অনুগ্রহ থেকে তোমরা বঞ্চিত হও।”
জনগণ এহেন পরিবর্তিত রূপ দেখে রোষে ফেটে পড়লো এবং সোজা আমিরুল মোমেনিনের কাছে গিয়ে হাজির হলো। আমিরুল মোমেনিন সব কথা শুনে অত্যন্ত বিরক্ত হলেন এবং তৎক্ষণাৎ উসমানের কাছে গিয়ে বললেন, “হায় আল্লাহ, তুমি মুসলিমদের সাথে একি দুর্ব্যবহার করলে! একজন বেইমান ও চরিত্রহীনের জন্য তুমি নিজেই ইমান পরিত্যাগ করলে! তোমার সব বোধশক্তি যেন হারিয়ে গেছে। অন্ততঃপক্ষে তুমি তোমার প্রতিশ্রুতির মর্যাদা রক্ষা করতে। এটা কেমন কথা যে, মারওয়ানের সকল কুকর্ম তুমি চোখ বুজে মেনে নিচ্ছি। মনে রেখো, সে তোমাকে এমন অন্ধকার কাপে নিক্ষেপ করবে। যেখান থেকে তুমি আর বেরিয়ে আসতে পারবে না। তুমি মারওয়ানের বাহনে পরিণত হয়েছ। কাজেই সে তোমাতে চড়ে যেমন খুশি তেমন করছে। তার ইচ্ছানুযায়ী তোমাকে ভুল পথে পরিচালিত করছে। ভবিষ্যতে আমি তোমার এসব কাজ কারবার সম্বন্ধে কোন কথাই বলবো না। এখন তুমি তোমার কাজ সামাল দাও”।
এসব কথা বলে আমিরুল মোমেনিন চলে এলেন এবং নাইলাহ সুযোগ পেয়ে উসমানকে বললো, “আমি কি তোমাকে মারওয়ানের কাছ থেকে দূরে থাকতে বলি নি? সে তোমাকে এমন ফাঁদে আটকিয়ে দিতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে যেটা থেকে তুমি বের হয়ে আসতে পারবে না। যে লোকটি সমাজে নিকৃষ্ট ও হীন প্রকৃতির তার পরামর্শ গ্রহণ করে তোমার কোন কল্যাণ হতে পারে না। এখনো সময় আছে আলীর শরনাপন্ন হও, তার পরামর্শ গ্রহণ কর। তা না হলে এ বিশৃংখল অবস্থা সামলানো তোমার অথবা মারওয়ানের ক্ষমতা বহির্ভুত।” উসমান এতে প্রভাবিত হলেন এবং আমিরুল মোমেনিনের কাছে একজন লোক পাঠালেন। কিন্তু আমিরুল মোমেনিন তার সাথে সাক্ষাত করতে রাজি হন নি। এসময় কোন অবরোধ ছিল না। কিন্তু চারিদিকে লোকজন ঘূণায় রি রি করছিলো। কোন মুখে উসমান বাইরে আসবে? অথচ বাইরে না এসে তার কোন উপায়ও ছিল না। ফলত গভীর রাতে তিনি চুপি চুপি আমিরুল মামোমেনিনের নিকট এসে কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে তার সহায়হীনতা ও একাকীত্বের কথা বলে রোদন করতে লাগলেন। আমিরুল মোমেনিন বললেন, “তুমি মসজিদ-ই-নববীতে জনগণের সম্মুখে দাঁড়িয়ে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করেছ। জনগণ তোমার কাছে গেলে তাদেরকে গালি-গালাজ করে তাড়িয়ে দিয়েছে। এটাই যখন তোমার প্রতিশ্রুতির অবস্থা তখন আমি কি করে তোমার ভবিষ্যৎ কথায় আস্থা রাখতে পারি। আমাকে তুমি বাদ দাও। তোমার কোন দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তোমার সামনে অনেক পথ খোলা আছে। তোমার ইচ্ছানুযায়ী যে কোন পথ অবলম্বন করতে পার।” আমিরুল মোমেনিনের এসব কথা শুনে উসমান ফিরে এলেন এবং তার বিরুদ্ধে গোলযোগের জন্য আমিরুল মোমেনিনকে দোষারোপ করতে লাগলেন। তিনি প্রচার করতে লাগলেন, “সকল গোলযোগ প্রশমিত করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আলী কিছুই
করছেন না ।
ওদিকে যারা মুহাম্মদ ইবনে আবি বকরকে নিয়ে মিশর অভিমুখে চলে গিয়েছিল তারা হিজাজ সীমান্ত অতিক্রম করে লোহিত সাগর উপকূলে আয়েলা নামক স্থানে পৌছে দেখতে পেল একজন লোক বহুদূরে এত দ্রুত উট হাঁকিয়ে যাচ্ছে যেন শত্রু তাকে তাড়া করছে। লোকটির চালচলন ও হাবভাব দেখে সকলের সন্দেহের উদ্রেক হয়। তারা তাকে কাছে ডেকে এনে পরিচয় জিজ্ঞেস করলো। উত্তরে সে বললো, সে উসমানের দাস। তারা জিজ্ঞেস করলো, কোথায় সে যাচ্ছিলো। সে বললো, মিশরে। তারা আবার জিজ্ঞেস করলো, কার কাছে যাচ্ছে। সে বললো, মিশরের শাসনকর্তার কাছে। তারা বললো, শাসনকর্তা তাদের সাথেই রয়েছে; তবু কার কাছে সে যাচ্ছিলো। সে বললো, আবদুল্লাহ ইবনে সা’দের কাছে। তারা জিজ্ঞেস করলো, কোন পত্র আছে কিনা। সে অস্বীকার করলো। তারা জিজ্ঞেস করলো, কি উদ্দেশ্যে সে যাচ্ছিলো। সে বললো, তা তার জানা নেই। তারা লোকটির কাপড়-চোপড় তল্লাশি করে কিছুই পেল না। তাদের মধ্যে কিনানাহ ইবনে বিশর তুজিবী বললো, “লোকটির পানির মশক দেখা।” অন্যরা হেসে উঠে বললো, “তাকে ছেড়ে দাও । পানিতে কি করে পত্র রাখবে।” কিনানাহ বললো, “তোমরা জান না, এরা কত ধূর্ত চাল চালতে পারে।” ফলে পানির মশক তল্লাশি করে তাতে একটা সীসার নল পাওয়া গেল এবং সেই নিলে একটা পত্র পাওয়া গেল। এ পত্রে খলিফার নির্দেশ লেখা ছিল- “যখন মুহাম্মদ ইবনে আবি বকর ও তার দল তোমার নিকট উপস্থিত হবে তখন তাদের মধ্যে অমুক অমুককে হত্যা করো, অমুক অমুককে গ্রেপ্তার করো এবং অমুক অমুককে জেলে রেখো। তুমি তোমার পদে অধিষ্ঠিত থেকো।” পত্র পড়ে। সকলে হতভম্ব হয়ে গেল এবং তাজব বনে গিয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকাতে লাগলো । তারা ভাবলো মিশরের দিকে এগিয়ে যাওয়া মানেই মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া। কাজেই তারা উসমানের দাসকে নিয়ে মদিনায় ফিরে এলো । মদিনায় এসেই তারা সাহাবাগণকে উসমানের পত্রখানা দেখালো। পত্র দেখে সকলেই বস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল এবং এমন কেউ বাকি রইল না যে উসমানকে গাল-মন্দ না করেছে। এরপর কয়েকজন সাহাবা মিশরিয়দের সঙ্গে নিয়ে উসমানের কাছে গেল। তারা জানতে চাইলো পত্রের গায়ে সীলটি কার । উসমান নিদ্বিধায় বললো। ওটা তার নিজের সীল। তারা জানতে চাইলো পত্ৰখানা কার হাতের লেখা । উসমান জবাব দিলো ওটা তার সচিবের হাতের লেখা। তারা জিজ্ঞেস করলো ধূত লোকটি কার দাস। তিনি বললেন, দাসটি তার নিজের। তারা জিজ্ঞেস করলো, লোকটিকে বহনকারী উটটি কার। তিনি জবাব দিলেন, উটটি সরকারের। তারা জিজ্ঞেস করলো, কে একে প্রেরণ করেছিল। তিনি উত্তর দিলেন তার জানা নেই। উপস্থিত জনগণ বললো, “আশ্চর্য সব কিছু আপনার; আর আপনি জানেন না কে তা প্রেরণ করেছে। আপনি যদি এতই অসহায় হয়ে থাকেন তবে খেলাফত ছেড়ে দিব্য বেরিয়ে যান, যাতে করে এমন একজন লোক আসতে পারেন যিনি মুসলিমদের বিষয়াদি পরিচালনা করতে পারবেন।” তিনি বললেন, ”খেলাফতের এ পোষাক যেখানে আল্লাহ আমাকে পরিয়েছেন সেখানে এটা খুলে ফেলা কোনক্রমেই আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অবশ্য, আমি তওবা করবো।” লোকেরা বললো, ”কেন আপনি তওবার কথা বলেন; এইতো সেদিন আপনি অবজ্ঞাভরে তওবা ভঙ্গ করেছেন, যে দিন আপনার দরজায় উপস্থিত জনগণকে আপনার প্রতিনিধি মারওয়ান গালাগালি দিয়ে অপমান করেছে। আপনি যা চেয়েছেন তা তো আপনার পত্রেই রয়েছে। আমরা আর কোন ধাপ্লাবাজিতে পড়তে চাই না। আপনি খেলাফত ছেড়ে দিন। আমাদের ভ্রাতৃগণ যদি আমাদের দাবি সমর্থন করে তবে আমরাও তাদেরকে সম্মান ও মর্যাদার আসনে বসাবো। আর যদি তারা যুদ্ধ করতে চায়। তবে আমরাও প্রস্তুত আছি। আমাদের হাত এখানো আচল হয়ে যায় নি, তরবারিও ভোতা হয়ে পড়ে নি। যদি সকল মুসলিমের প্রতি আপনার সম্মানবোধ থেকে থাকে এবং ন্যায়ের প্রতি যদি আপনার সামান্যতম মনোযোগ থেকে থাকে। তবে মারওয়ানকে আমাদের হাতে তুলে দিন। আমরা তাকে জিজ্ঞেস করে দেখি কার শক্তি ও সমর্থনে সে মুসলিমদের মূল্যবান জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে এমন পত্র লিখেছে।” উসমান তাদের দাবি প্রত্যাখ্যান করে মারওয়ানকে তাদের সম্মুখে হাজির করতে অস্বীকৃতি জানালেন। এতে জনতার মনে বদ্ধমূল ধারণা হলো যে, পত্রখানা উসমানের নির্দেশে লেখা হয়েছে।
শান্ত পরিবেশ আবার অশান্ত হয়ে উঠলো। যেসব বহিরাগত জাখুশুব উপত্যকায় অবস্থান করছিলো তারা স্রোতের মতো ছুটে এসে মদিনার রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে পড়লো এবং উসমানের ঘরে প্রবেশের পথ চতুর্দিক থেকে অবরোধ করে ফেললো। এ অবরোধ চলাকালে রাসুলের সাহাবা নিয়ার ইবনে ইয়াদ উসমানের সাথে কথা বলার ইচ্ছা পোষণ করে তার ঘরের সামনে গিয়েছিল। উসমান উপর থেকে উকি দিলে নিয়ার বললো, “ওহে। উসমান, আল্লাহর দোহাই খেলাফত ছেড়ে দিয়ে মুসলিমদেরকে রক্তপাত থেকে রক্ষা করুন।” এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে উসমানের লোক তীর নিক্ষেপ করে নিয়ারকে হত্যা করলো। এতে জনতা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে গেল এবং নিয়ারের হত্যাকারীকে তাদের হাতে সোপর্দ করার জন্য চিৎকার করতে লাগলো। উসমান সোজা জবাব দিলেন যে, তার নিজের সমর্থককে তিনি তাদের হাতে তুলে দিতে পারবেন না। উসমানের এহেন একগুয়েমি আগুনে পাখার বাতাসের মতো কাজ করলো এবং প্রচন্ড উত্তেজনায় জনতা তার দরজায় আগুন লাগিয়ে দিল এবং ভেতরে প্রবেশ করার জন্য এগিয়ে যেতে লাগলো। এ অবস্থায় মারওয়ান ইবনে হাকাম, সাইদ ইবনে আস ও মুঘিরাহ ইবনে আখনাস তাদের কিছু সৈন্য নিয়ে অবরোধকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং উসমানের দরজায় হত্যা ও রক্তপাত শুরু হয়ে গেল। একদিকে জনতা ঘরে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে, অপরদিকে উসমানের সৈন্যরা তাদের পিছনে হটিয়ে দিচ্ছে। উসমানের ঘর সংলগ্ন ঘরটি ছিল আমর ইবনে হাজম আল-আনসারীর। আমার তার ঘরের দরজা খুলে দিয়ে সেদিক দিয়ে অগ্রসর হবার জন্য অবরোধকারীদেরকে বললো। তারা সে পথে উসমানের ঘরের ছাদে উঠে গেল এবং উন্মুক্ত তরবারি হাতে ছাদ থেকে ভেতরে প্রবেশ করলো। কয়েক মুহুর্ত বিশৃংখল যুদ্ধের পর উসমানের তথাকথিত শুভাকাঙ্ক্ষীগণ তাকে ফেলে দৌড়ে রাস্তায় পালিয়ে গেল এবং কেউ কেউ উন্মে হাবিবা বিনতে আবি সুফিয়ানের ঘরে আত্মগোপন করলো। উসমানের পাশে যারা ছিল তাদের সকলকে উসমানের সাথে হত্যা করা হয়েছে। (সা’দী**’, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৫০-৫৮; তাবারী’, ১ম খন্ড, পৃঃ ২৯৯৮-৩০২৫; আছীর, ৩য় খন্ড, পৃঃ ১৬৭-১৮০; হাদীদ’, ২য় খন্ড, পৃঃ ১৪৪-১৬১) এসব ঘটনা প্রবাহ থেকে আমিরুল মোমেনিনের অবস্থান সহজেই অনুমেয়। তিনি হত্যাকীদেরকে সমর্থনও দেন নি আবার উসমানের প্রতিরক্ষার জন্য দন্ডায়মানও হন নি। কারণ তিনি যখন দেখলেন উসমানের কথা ও কাজ এক নয়, তখন তিনি নিজকে সম্পূর্ণ পৃথক করে রাখলেন।