জনগণকে জিহাদে উদ্বুদ্ধকরণ
নিশ্চয়ই, জিহাদ বেহেশতের দ্বারসমূহের একটা যা আল্লাহ তাঁর বিশেষ বন্ধুদের জন্য খুলে রেখেছেন। জিহাদ হচ্ছে তাকওয়ার পোষাক এবং আল্লাহর নিরাপত্তামূলক বর্ম ও বিশ্বস্ত ঢাল। কেউ জিহাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকলে আল্লাহ তাকে অসম্মানের পোষাকে আবৃত করেন এবং বালামুসিবতের কাপড় পরিয়ে দেন। তখন নিদারুণ অপমান ও ঘূণা তার সঙ্গী হয়ে পড়ে এবং তার হৃদয়কে (অজ্ঞতার) পর্দাবৃত করে দেয়া হয়। জিহাদের প্রতি বিমুখতার কারণে তার কাছ থেকে মহাসত্য অপসারণ করা হয়। ফলে সে কলঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং সে ন্যায়-বিচার থেকে বঞ্চিত হয়।
সাবধান, এসব লোকের বিরুদ্ধে দিনে-রাতে, গোপনে-প্রকাশ্যে সংগ্রাম করার জন্য আমি তোমাদের দৃঢ়কণ্ঠে আহবান করেছিলাম। তোমরা আক্রান্ত হবার পূর্বেই আক্রমণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলাম। কারণ আল্লাহর কসম, যারা নিজেদের ঘরের মধ্যে আক্রান্ত হয়েছে তারা দারুণভাবে অমর্যাদাকর অবস্থায় পড়েছে। তোমরা নিজের দায়িত্ব অন্যের দিকে ঠেলে দিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত একে অপরকে অপদস্থ করছো। তোমাদের নগরীসমূহ শত্রুরা দখল করে নিয়েছে। বনি ঘামিদের’ অশ্বারোহীগণ আল-আনবারে পৌঁছে গেছে এবং তারা হাসান ইবনে হাসান বকরীকে হত্যা করেছে। তোমাদের অশ্বারোহীদের তারা দূর্গ থেকে বিতাড়িত করেছে। আমি জানতে পেরেছি তারা মুসলিম রমণী ও ইসলামের নিরাপত্তাধীন রমণীদের ইজ্জত হরণ করেছে এবং হাত, পা, গলা ও কান থেকে অলঙ্কারাদি ছিনিয়ে নিয়েছে। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউনা (২ ঃ ১৫৬)– কুরআনের এ আয়াত উচ্চারণ করা ছাড়া রমণীকুল কোন কিছুই করতে পারে নি। নিজেদের কোন প্রকার ক্ষয়ক্ষতি বা প্রাণহানি ব্যতিরেকে তারা ধন-সম্পদ নিয়ে চলে গেছে। এ ঘটনার কারণে কোন মুসলিম যদি শোকে মরে যায় তাহলে তাকে দোষ দেয়া যাবে না; বরং আমার কাছে তার মৃত্যু ওজর হয়ে থাকবে। কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! আল্লাহর কসম, অন্যায় সাধনের জন্য তাদের একতা আর ন্যায়ের পথে তোমাদের অনৈক্য দেখে আমার হৃদয় ব্যথাতুর হয়ে পড়ে। শোক আর দুর্দশা তোমাদেরকে ঘিরে ধরেছে,
তোমরা এমন নিশানা হয়ে গেছ যেখানে তীর নিক্ষেপ করা যায়, তোমরা নিহত হচ্ছে অথচ হত্যা করনা । তোমরা আক্রান্ত হচ্ছে অথচ আক্রমণ করনা। আল্লাহকে অমান্য করা হচ্ছে অথচ তোমরা তাতে রাজি হয়ে রয়েছে। যখন আমি গড়ীশশকাল তাদের বিরুদ্ধে জিহাদে এগিয়ে যেতে বলি তখন তোমরা বল
এখন আবহাওয়া গরম উত্তাপ প্রশমিত হওয়া পর্যন্ত সময় দিন। যখন আমি শীতকালে যাত্রা করতে বলি তখন তোমরা বল এখন খুব ঠান্ডা-শীত যাওয়া পর্যন্ত সময় দিন। এভাবে শীত-গ্ৰীষ্ম এড়ানোর চেষ্টা ওজর মাত্র। আল্লাহর কসম, ঠাণ্ডা আর গরম থেকে তোমরা যেভাবে পালিয়ে যাচ্ছে,
তরবারি (যুদ্ধ) থেকে তোমরা আরো অধিক পালিয়ে যাবে। ওহে, তোমরা মনুষ্যরূপ, আসলে মানুষ নও, তোমাদের বুদ্ধিমত্তা শিশুর মতো এবং তোমাদের
জ্ঞানের পরিধি পর্দার অন্তরালে আবদ্ধ নারীর মতো (যারা বহিরজগতের কোন খোজ রাখে না)।
তোমাদের সঙ্গে আমার দেখা না হলে বা তোমাদেরকে আমি না চিনলে কতই না ভালো হতো। আল্লাহর কসম তোমদের সাথে পরিচিতি আমার কাছে লজ্জা আর অনুশোচনার কারণ হয়ে রইলো। আল্লাহ তোমাদের সাথে যুদ্ধ করুন! তোমরা আমার হৃদয়কে দুঃখ ভারাক্রান্ত করেছো এবং আমার বক্ষে রোষের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছো। তোমরা আমাকে একের পর এক দুঃখের শরাব পান করিয়েছো। তোমরা আমার অবাধ্য হয়ে আমার সকল উপদেশ অমান্য করেছো এবং এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করেছো যাতে কুরাইশগন বলাবলি করছে যে, আবি তালিবের পুত্র বীর বটে কিন্তু যুদ্ধ কৌশল জানেনা। তাদের উপর আল্লাহর আশীর্বাদ ! যুদ্ধক্ষেত্রে আমার চেয়ে অধিক ক্ষিপ্র আর অভিজ্ঞ তাদের কেউ আছে কি ? জিহাদের ময়দানে আমার চেয়ে পুরাতন কোন ব্যক্তি আছে কি ? বিশ বছর বয়স না হতেই আমি অস্ত্র ধারণ করেছি।
আজ ষাটত্তোর বয়সেও একই রকম শৌর্য নিয়ে আছি ; কিন্তু যাকে মান্য করা হয়না তার অভিমতের মুল্য কি ?
১। সিফফিনের যুদ্ধের পর মুয়াবিয়া চতুর্দিকে হত্যকান্ড ও রক্তপাত ঘটাতে থাকে। আমিরুল মোমেনিনের শাসনাধীন শহরগুলোতে অনধিকার প্রবেশ করে সে আক্রমণ করতে থাকে। হাইত, আনবার ও মাদাইন আক্রমণ করার জন্য আমিরুল মোমেনিন সুফিয়ান ইবনে আউফ ঘামিদীর নেতৃত্বে ছয় হাজার সৈন্যের একটা বাহিনী প্রেরণ করেছিলেন। সুফিয়ান প্রথমে মাদাইন গমন করে শহরটি পরিত্যক্ত দেখে আনবারের দিকে অগ্রসর হন । আনবারে পাঁচশত সৈন্যের একটা রক্ষীবাহিনী রেখে সুফিয়ান চলে যান। কিন্তু মুয়াবিয়ার দুর্ধর্ষ বাহিনীর গতিরোধ করা এত ছোট বাহিনীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবুও তাদের সাধ্যমতো তারা চেষ্টা করেছে। কিন্তু শত্রুর আক্রমণ এত তীব্র ছিল যে, রক্ষী বাহিনীর প্রধান হাসান ইবনে হাসান বকরী ও অন্য ত্রিশজন নিহত হন। মুয়াবিয়ার বাহিনী আনবার লুণ্ঠন করে শহরটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। আমিরুল মোমেনিন এসব সংবাদ পেয়ে মিম্বারে উঠে জনগণকে জিহাদে অনুপ্রাণিত করার মানসে এ খোৎবা প্রদান করেন ।
কিন্তু তার আহবানে কেউ সাড়া না দেয়ায় তিনি বিরক্তি প্রকাশ করে মিম্বার থেকে নেমে পদব্রজে শত্রুর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন এবং নুখায়লা নামক স্থান পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন। এ অবস্থা দেখে জনগণের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হলো এবং তারা আমিরুল মোমেনিনকে অনুসরণ করে নুখায়লায় উপস্থিত হলো। জনগণ
আমিরুল মোমেনিনকে ঘিরে ধরলো এবং তাকে ফিরে যাবার জন্য অনুরোধ করতে লাগলো। অবশেষে তারা শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদে যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চাপ প্রয়োগ করলে আমিরুল মোমেনিন ফিরে আসতে রাজি হলেন। তখন সাঈদ ইবনে কায়েস আট হাজার সৈন্যের একটা বাহিনী নিয়ে আনবারের দিকে অগ্রসর হলেন।
কিন্তু সুফিয়ান আনবার ত্যাগ করে চলে গেছে বলে সাঈদ শত্রুর মোকাবেলা না করেই ফিরে এসেছে। হাদীদ-১৫২ বর্ণনা করেছেন- সাঈদ কুফায় ফিরে আসাতে আমিরুল মোমেনিন এত মর্মাহত হয়েছেন যে, কয়েকদিন তিনি মসজিদেও যান নি এবং মসজিদ সংলগ্ন ঘরের বারান্দায় বসে এ খোৎবা লিখে তার চাকর সা’দকে দিয়েছিলেন যেন সে জনগণকে পড়ে শুনিয়ে দেয়। অপরপক্ষে মুবাররাদ১১২ বর্ণনা করেছেন যে, আমিরুল মোমেনিন যখন পদব্রজে নুখায়লাহ পৌছেন তখন তিনি একটা উচুস্থানে দাঁড়িয়ে এ ভাষণ দিয়েছিলেন (১ম খন্ড, পৃঃ ১০৪ ১০৭) । ইবনে মায়াছামিও এটা যুক্তিযুক্ত মনে করেন।