আকাশ, পৃথিবী ও আদম সৃষ্টি সম্পর্কে
প্রতিষ্ঠিত প্রশংসা আল্লাহর। তাঁর গুণরাজী কোন বর্ণনাকারী বর্ণনা করে শেষ করতে পারে না। তার নেয়ামতসমূহ গণনাকারীরা গুনে শেষ করতে পারে না। প্রচেষ্টাকারীগণ তাঁর নেয়ামতের হক আদায় করতে পারে না। আমাদের সমুদয় প্রচেষ্টা ও জ্ঞান দ্বারা তাঁর পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করা সম্ভব নয় এবং আমাদের সমগ্ৰ বোধশক্তি দ্বারা তার মাহাত্ম্য অনুভব করা সম্ভব নয়। তাঁর সিফাত বৰ্ণনার কোন পরিসীমা নির্ধারিত নেই এবং সেজন্য কোন লেখা বা বক্তব্য, কোন সময় বা স্থিতিকাল নির্দিষ্ট করা হয় নি। তিনি নিজ কুদরতে সৃষ্টিকে অস্তিত্বশীল করেছেন, আপন করুণায় বাতাসকে প্রবাহিত করেছেন এবং শিলাময় পাহাড় দ্বারা কম্পমান পৃথিবীকে সুদৃঢ় করেছেন।
আল্লাহর মা’রেফাতেই দ্বিনের ভিত্তি”। এ মা’রেফাতের পরিপূর্ণতা আসে তাকে সত্য বলে সাক্ষ্য দেয়ায়; সাক্ষ্যের পরিপূর্ণত হয় তাঁর ঐকল্যের বিশ্বাসে; বিশ্বাসের পরিপূর্ণত হয় তাঁকে পরম পবিত্ররূপে নিরীক্ষণ করার জন্য আমল করায়; আমলের পরিপূর্ণতা অর্জিত হয় তাঁর প্রতি কোন সিফাত (গুণ) আরোপ না করায়। কারণ কোন কিছুতে গুণ আরোপিত হলে এটাই প্রমাণিত হয় যে, আরোপিত বিষয় থেকে গুণ পৃথক এবং যার ওপর গুণ আরোপিত হয় সে নিজে সেই গুণ থেকে পৃথক। যারা আল্লাহতে সত্তা বহির্ভূত কোন সিফাত বা গুণ আরোপ করে তারা তাঁর সদৃশতার স্বীকৃতি দেয়; যারা তাঁর সদৃশতা স্বীকার করে তারা দ্বৈতবাদের স্বীকৃতি দেয়; যারা তাঁর দ্বৈতের স্বীকৃতি দেয় তারা তাঁকে খন্ডভাবে দেখে; যারা তাকে খন্ডভাবে দেখে তারা তাঁকে ভুল বুঝে; যারা তাঁকে ভুল বুঝে তারা তাঁকে চিনতে অক্ষম; যারা তাকে চিনতে অক্ষম তারা তার ত্রুটি স্বীকার করে; যারা তার ত্রুটি স্বীকার করে তারা তাকে সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ করে।
যদি কেউ বলে তিনি কি, সে জেনে রাখুক, তিনি সবকিছু ধারণ করে আছেন; এবং যদি কেউ বলে তিনি কিসের ওপর আছেন, সে জেনে নাও, তিনি নির্দিষ্ট কোন কিছুর ওপর নেই। যদি কেউ তাঁর অবস্থিতি নির্দিষ্ট কোন স্থানে মনে করে তবে সে কিছু কিছু স্থানকে আল্লাহবিহীন মনে করলো। তিনি ওই সত্তা যাঁর আগমন সৃষ্টি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে নি। তিনি অস্তিত্বশীল, কিন্তু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ত্বে আসেন নি। তিনি সব কিছুতেই আছেন, কিন্তু কোন প্রকার ভৌত নৈকট্য দ্বারা নয়। তিনি সব কিছু থেকে ভিন্ন, কিন্তু বস্তুগত দ্বান্দ্রিকতা ও বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে নয়। তিনি কর্ম সম্পাদন করেন। কিন্তু সঞ্চলন ও হাতিয়ারের মাধ্যমে নয়। তিনি তখনও দেখেন যখন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কেউ দেখার মতো থাকে না। তিনিই একমাত্র একক, কেন না। এমন কেউ নেই যার সাথে তিনি সঙ্গ রাখতে পারেন অথবা যার অনুপস্থিতি তিনি অনুভব করেন।
—————————————————————————-
নিখিল বিশ্ব সৃষ্টি
তিনি সৃষ্টির সূত্রপাত করলেন একান্তই মৌলিকভাবে— কোন প্রকার প্রতিরূপ ব্যতীত, কোন প্রকার পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ ব্যতীত, কোনরূপ বিচলন ব্যতীত এবং ফলাফলের জন্য কোনরূপ ব্যাকুলতা ব্যতীত। সব কিছুকে তিনি নির্দিষ্ট সময় দিলেন, তাদের বৈচিত্র্যে সামঞ্জস্য বিধান করলেন এবং তাদের বৈশিষ্ট্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন। সৃষ্টির পূর্বেই তিনি সব কিছুর প্রবণতা, জটিলতা, সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন।
এরপর পবিত্র সত্তা অনন্ত শূন্য সৃষ্টি করলেন এবং প্রসারিত করলেন নভোমন্ডল ও বায়ু স্তর। তিনি উচ্ছল তরঙ্গবিক্ষুব্ধ পানি প্রবাহিত করলেন। তরঙ্গগুলো এত ঝঞা-বিক্ষুব্ধ ছিল যে, একটা আরেকটার ওপর দিয়ে গড়িয়ে যেতো। তরঙ্গাঘাতের সাথে তিনি প্রবল বায়ুপ্রবাহ যুক্ত করলেন এবং প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের প্রকম্পন সৃষ্টি করলেন। পানির বাষ্পীয় অবস্থাকে তিনি বৃষ্টিরূপে পতিত হবার নির্দেশ দিলেন এবং বৃষ্টির প্রাবল্যের ওপর বায়ুকে নিয়ন্ত্রণাধিকার দিলেন। মেঘের নিচে বাতাস প্রবাহিত হতে লাগলো এবং পানি বাতাসের ওপর প্রচণ্ড বেগে প্রবাহিত হতে লাগলো।
এরপর সর্বশক্তিমান আল্লাহ বাতাস সৃষ্টি করে তাকে নিশ্চল করলেন, তার অবস্থান স্থায়ী করলেন, তার গতিতে প্রচন্ডতা দিলেন এবং তাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিলেন। তারপর তিনি বাতাসকে আদেশ করলেন গভীর পানিকে গতিশীল ও চঞ্চল এবং সমুদ্র তরঙ্গকে তীব্রতর করার জন্য। ফলে বাতাস দধি তৈরির মতো পানিকে মন্থন করতে লাগলো এবং এমন জোরে মহাশূন্যে প্রক্ষেপ করলে যে—সম্মুখ পশ্চাতে ও পশ্চাত সম্মুখে চলে গেলো। এতে ওপরের স্তরে বিপুল ফেনপুঞ্জ সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত স্থিরকে অস্থির করে রাখলো। সর্বশক্তিমান তখন ফেনপুঞ্জকে অনন্ত শূন্যে উত্তোলন করে তা থেকে সপ্ত আকাশ সৃষ্টি করলেন যার সর্বনিম্ন স্তর স্ফীত অথচ অনড় এবং ওপরের স্তর আচ্ছাদনের মতো বিদ্যমান— যেন এক সুউচ্চ বৃহৎ অট্টালিকা যাতে কোন স্তম্ভ নেই অথবা একত্রে জোড়া লাগাবার পেরেক নেই। তখন তিনি ওপরের স্তরকে তারকা ও উজ্জ্বল উল্কা দিয়ে সুশোভিত করলেন এবং আবর্তিত আকাশ, চলমান আচ্ছাদন ও ঘূর্ণায়মান নভোমন্ডলে তিনি দেদীপ্যমান সূর্য ও দীপ্তিময় চন্দ্রকে স্থাপন করলেন।
——————————————————————-
ফেরেশতা দ্বারা সেই উন্মুক্ততা পরিপূর্ণ করলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সেজদাবনত, যারা কখনো রুকু করে না; কেউ কেউ রুকু অবস্থায়, যারা কখনো দাঁড়ায় না এবং কেউ কেউ সুবিন্যস্তভাবে অবস্থান করছে, যারা কখনো তাদের স্থান পরিত্যাগ করে না। অন্যরা সর্বক্ষণ আল্লাহর তসবিহু পাঠ করে এবং তারা ক্লান্ত হয় না। নয়নের নিদ্রা, বুদ্ধির বিভ্রান্তি, শরীরের অবসন্নতা অথবা বিস্মৃতির প্রভাব এদেরকে স্পর্শও করে না।
ফেরেশতাদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর বিশ্বস্ত অহিবাহক, যারা নবিদের কাছে আল্লাহর মুখপাত্র হিসাবে কাজ করে এবং তাঁর আদেশ নির্দেশকে সর্বত্র পৌছে দেয়। কেউ কেউ আল্লাহর সৃষ্টি রক্ষার কাজে নিযুক্ত। আবার কেউ কেউ বেহেশতের দরজায় প্রহরী হিসাবে নিযুক্ত। আরো অনেক আছে যাদের পদদ্বয় ভূ-মন্ডলের সর্বনিম্ন স্তরে স্থিরভাবে স্থাপিত এবং তাদের শিরোদেশ আকাশের সর্বোচ্চ স্তরে প্রসারিত এবং তাদের বাহু চতুর্দিকে সম্প্রসারিত। তাদের স্কন্ধ আরশের স্তম্ভের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ; তাদের চোখে আরাশের প্রতি নিবদ্ধ এবং তাদের পাখা আরাশের নিচে বিস্তৃত। তাদের নিজেদের মধ্যে এবং অন্য সকল কিছুর মধ্যে সম্মানিত পৰ্দা ও কুদরতের আবরণ সৃষ্টি করা হয়েছে। তারা তাদের মহান স্রষ্টাকে আকৃতির মাধ্যমে ধারণা করে না। তারা স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির কোন গুণারোপ করে না, তাঁকে কোন নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ করে না এবং উপমার মাধ্যমে তার প্রতি ইঙ্গিত করে না ।
আদম সৃষ্টি
আল্লাহ্ কঠিন, কোমল, মধুর ও তিক্ত মৃত্তিকা সংগ্রহ করলেন। তিনি এ মৃত্তিকাকে পানি দিয়ে কর্দমে পরিণত করলেন এবং পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত ফোটায় ফোঁটায় পানির পতন ঘটালেন এবং আঠাল না হওয়া পর্যন্ত আদ্রতা দ্বারা পিন্ড প্রস্তুত করলেন। এ পিন্ড থেকে তিনি আদল, জোড়াসমূহ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও বিভিন্ন অংশসহ একটা আকৃতি তৈরি করলেন। একটা নির্দিষ্ট সময় ও জ্ঞাত স্থায়িত্ব পর্যন্ত তিনি এটাকে শুকিয়ে কাঠিন্য প্রদান করলেন। এরপর এ আকৃতির মধ্যে তিনি তাঁর রূহ ফুৎকার করে দিলেন। ফলে এটা প্রান-চৈতন্য লাভ করে মানবাকৃতি ধারণ করলো এবং এতে মন সন্নিবেশ করা হলো, যা তাকে নিয়ন্ত্রণ করে; বুদ্ধিমত্তা দেয়া হলো, যা তার উপকারে আসে; অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেয়া হলো, যা তার কাজে লাগে; ইন্দ্রিয় দেয়া হলো, যা তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটায় এবং জ্ঞান দেয়া হলো, যা সত্য-অসত্য, স্বাদ-গন্ধ ও বর্ণ-প্রকারের পার্থক্য বুঝাতে শেখালো। আদম হলো বিভিন্ন বর্ণের, আসঞ্জক পদার্থের, বিভিন্ন পরস্পর বিরোধী উপকরণের এবং বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যেমন—উষ্ণতা, শীতলতা, কোমলতা, কাঠিন্য, খুশি-অখুশি ইত্যাদির সংমিশ্রনের কর্দম।
আল্লাহ তখন ফেরেশতাদের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণার্থে এবং তাদের প্রতি তাঁর নির্দেশের আনুগত্য পরিপূরণ করণার্থে আত্মসমর্পণের স্বীকৃতি স্বরূপ ও তাঁর মহিমার প্রতি সম্মান স্বরূপ সেজদাবনত হতে বললেন। তিনি বলেনঃ
আদমকে সেজদা কর এবং ইবলিস ব্যতীত সকলেই সেজদা করলো। (কুরআন- ২-৩৪, ৭-১১, ১৭-৬১, ১৮-৫০, ২০-১১৬) ঔদ্ধত্য দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল বলে আত্মম্ভরি ইবলিস আল্লাহর আদেশ পালনে বিরত থাকলো । সুতরাং সে আগুনের তৈরি বলে অহংবোধ করলো এবং মাটির তৈরি বলে আদমকে অবজ্ঞা করলো। ফলে আল্লাহ ইবলিসকে তাঁর রোষের পূর্ণ প্রতিফল প্রদানের এবং মানুষকে পরীক্ষা করার ও শয়তানের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করার জন্য যথেষ্ট সময় দিলেন।
আল্লাহ বলেনঃ তা হলে তুমি অবকাশ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত— নির্ধারিত সময়ের দিন পর্যন্ত (কুরআন ১৫-৩৭_৩৮, ৩৮-৮০_৮১) এরপর আল্লাহ্ আদমকে একটা ঘরে অধিষ্ঠান করলেন যেখানে তিনি মহানন্দে ও পূর্ণ নিরাপত্তায় বসবাস করতে লাগলেন। তিনি আদমকে ইবলিস ও তার শত্রুতা সম্পর্কে সাবধান করে দিলেন। কিন্তু ইবলিস আদমের বেহেশত-বাস ও ফেরেশতাদের সংসর্গের জন্য ঈর্ষান্বিত হলো। সুতরাং সে আদমের “ইয়াকিন’ শিথিল করলে এবং তার প্রতিশ্রুতি দুর্বল করলো। এতে আদমের আনন্দ ভয়ে পরিণত হলো এবং মর্যাদা লজ্জায় পরিণত হলো। তখন আল্লাহ আদমকে ‘তওবা’ করার সুযোগ দিলেন এবং তাঁর রহমতের বাক্য শেখালেন। তিনি আদমকে বেহেশতে প্রত্যাবর্তনের ওয়াদা দিলেন এবং তাকে কষ্টভোগ করা ও বংশ বিস্তারের স্থলে অবতরণ করালেন।
পয়গম্বর মনোনয়ন
আল্লাহ্ আদমের বংশধর থেকে অনেক পয়গম্বর মনোনীত করলেন এবং তাঁর প্রত্যাদেশ ও বাণী বিশ্বস্ততার সাথে মানুষের কাছে পৌছানোর জন্য তাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন। কালক্রমে অনেক লোক আল্লাহকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পরিবর্তন করে ফেললো এবং আল্লাহর প্রতি কর্তব্য বিষয় ভুলে গিয়ে তাঁর সমকক্ষ দাঁড় করাতে লাগলো। শয়তান তাদেরকে আল্লাহর মা’রেফাত থেকে ফিরিয়ে নিল এবং তার ইবাদত থেকে বিচ্ছিন্ন করলো। তখনই আল্লাহ তাদের কাছে রাসুলগণকে প্রেরণ করলেন এবং একের পর এক নবি পাঠালেন যেন তাঁরা পূর্ব-প্রতিশ্রুতি পরিপূর্ণ করার দিকে মানুষকে আহবান করেন এবং ভুলে যাওয়া নেয়ামতসমূহ স্মরণ করিয়ে দেন; যেন তারা তবলিগের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর দিকে প্রণোদিত করেন, যেন তাদের কাছে প্রজ্ঞার গুপ্ত রহস্য উন্মোচন করে দেন এবং আল্লাহর কুদরতের
নিদর্শনসমূহ যেমন—সমুচ্চ আকাশ, বিছানো পৃথিবী, তাদের বাঁচিয়ে রাখার জীবনোপকরণ, মৃত্যু, বার্ধক্যের জরা ও ক্রমান্বয়ে আগত ঘটনা প্রবাহ—তাদেরকে দেখিয়ে দেন।
আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্টিকে কখনো পয়গম্বরবিহীন অথবা নাজেলকৃত বাণী অথবা বাধ্যতামূলক প্রত্যাদেশ অথবা সরল সহজ পথ ব্যতীত রাখেন নি। পয়গম্বরগণ এমনভাবে তাদের দায়িত্বে অটল ছিলেন যে, তাদের সহচরের সংখ্যাল্পতা বা তাদেরকে মিথ্যা প্রমাণকারীর দল অধিক হওয়া সত্ত্বেও তাদের মিশন থেকে কখনো তারা বিরত হন নি এবং কোন কিছুই তাদেরকে কর্তব্য থেকে বিরত রাখতে পারে নি। পয়গম্বরগণের প্রত্যেকেই তাঁর পূর্ববতী জনের কথা বলে গেছেন এবং পরবতী জনের আগমন বার্তা জ্ঞাপন করেছেন ।
নবি মুহাম্মদ (সঃ)
এভাবে সময় গড়িয়ে যুগের পর যুগ অতিক্রান্ত হলো। পিতারা মৃত্যুবরণ করলো এবং সন্তানেরা তাদের স্থানে এলো—সুদীর্ঘ সময় পার হবার পর আল্লাহ তাঁর অঙ্গীকার পূরণার্থে ও পয়গম্বর-ধারা সমাপ্তি পূর্বক মুহাম্মদকে (সঃ) নিবি ও রাসুল করে পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন। অন্যান্য পয়গম্বরদের কাছ থেকে মুহাম্মদ (সঃ) সম্পর্কে অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়েছিল। মুহাম্মদের (সঃ) জন্ম ছিল অতীব সম্মানজনক এবং চরিত্র বৈশিষ্ট্য ছিল সুখ্যাতিপূর্ণ। সে সময়ে পৃথিবীর মানুষ বিভিন্ন ধর্মে দলভুক্ত (মাজহাব) ছিল। তাদের মতো ও পথ ছিল বিবিধ; চিন্তাধারা ছিল বিক্ষিপ্ত এবং একে অপরের সাথে বিবাদমান ছিল। তারা সৃষ্টিকে আল্লাহর সাদৃশ্য করতো অথবা তার মহিমান্বিত নামসমূহ বিকৃত করতো অথবা তিনি ব্যতীত অন্য কিছুকে ক্রিয়া-কর্ম সম্পাদনকারী মনে করতো। মুহাম্মদের (সঃ) মাধ্যমে আল্লাহ তাদেরকে সুপথ দেখালেন এবং তার অক্লান্ত প্রচেষ্টা দ্বারা তিনি তাদেরকে অজ্ঞতা থেকে ফিরিয়ে আনলেন । এরপর আল্লাহ মুহাম্মদকে (সঃ) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য মনোনীত করে তার মহিমান্বিত নৈকট্য দান করলেন এবং এ পৃথিবীতে থাকার অনেক অনেক উর্ধের মর্যাদাশীল বিবেচনা করে তাকে এ পৃথিবী থেকে তুলে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। ফলে তিনি মহাসম্মানের সাথে তাঁকে নিজের সান্নিধ্যে নিয়ে গেলেন। মুহাম্মদ (সঃ) ও তাঁর বংশধরগণের ওপর আল্লাহর রহমত বৰ্ষিত হোক ।
পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ
মুহাম্মদ (সঃ) তোমাদের মাঝে ওই একই জিনিস রেখে গেছেন যা অন্য পয়গম্বরগণও তাদের উম্মতের কাছে রেখে গিয়েছিলেন। পয়গম্বরগণ মানুষকে অন্ধকারে রেখে যান নি। তাঁরা সুনির্দিষ্ট সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছিলেন এবং আল্লাহর স্থায়ী নিদর্শনাবলীর তত্ত্বাবধান করেছিলেন। মুহাম্মদ (সঃ) তোমাদের কাছে রেখে গেছেন তোমাদের প্রতিপালকের কিতাব যা নির্ধারিত হালাল ও হারাম বর্ণনাকরে; ফরজ ও মোস্তাহাবসমূহ বর্ণনা করে; মনসুখ ও নাসেখ। বর্ণনা করে; বাধ্যতামূলক ও ঐচ্ছিক বিষয়াদি, বিশেষ ও সাধারণ বিষয়াদি, উপদেশ ও উপমা, সীমিত ও অসীম, স্পষ্ট ও অস্পষ্ট বর্ণনা করে এবং শব্দ সংক্ষেপের (মুকাত্তাআত) ব্যাখ্যা ও গুপ্ত বিষয়ের স্পষ্ট বর্ণনা করে।
কুরআনে কিছু কিছু আয়াত আছে যে বিষয়ে জ্ঞানার্জন বাধ্যতামূলক আবার এমন কিছু আয়াত আছে যেগুলোর রহস্য বিষয়ে মানুষের অজ্ঞতা মার্জনীয়। রাসুলের সুন্নাহ কুরআনের বাধ্যতামূলক বিষয়াদি প্রকাশক। রাসুলের সুন্নাহর মাধ্যমে বাধ্যতামূলক বিষয়ের রাদ-বদলও প্রতিফলিত হয়েছে অথবা সুন্নাহতে এমন বিষয়াদি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে যা পবিত্র গ্রন্থে হয়ত অনুসরণ না করার অনুমতি রয়েছে। এছাড়াও কিছু কিছু আয়াত আছে যা একটা বিশেষ সময় পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু ওই সময়ের পর তদ্রুপ নেই। কুরআনের নিষেধাজ্ঞাসমূহও বিভিন্ন—কিছু এমন যাতে জাহান্নামের ভীতি প্রকট এবং কিছু এমন যাতে ক্ষমার প্রত্যাশা অধিক ব্যক্ত হয়েছে। কুরআনে এমন আয়াতও আছে যার একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রাংশও আল্লাহ্র নিকট বর্ধিত আকারে গ্রহণযোগ্য। হাজ সম্পর্কে আল্লাহ তাঁর পবিত্র গৃহে হজ করা তােমাদের জন্য ফরজ করেছেন এবং সে গৃহকে মানুষের জন্য কেবল হিসাবে নির্ধারিত করেছেন। প্রাণীকুল অথবা কবুতর তৃষাতুর অবস্থায় যেভাবে ঝরনার পানির দিকে ছুটে যায় মানুষও তেমনি যেন কাবার দিকে ধাবমান হয়। মহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর আজমতের সামনে বান্দাদের তাওয়াজু (বিনয়) প্রকাশের জন্য এবং তাঁর ইজ্জতের প্রতি তা সৃদিক (দৃঢ় বিশ্বাস) প্রকাশের জন্য সম্মানিত ঘরকে প্রতীক হিসাবে নির্ধারিত করেছেন। সৃষ্টির মধ্য থেকে তিনি এমন কিছু শ্রবণকারী মনোনীত করেছেন যারা তার ডাকে সাড়া প্রদান করে এবং তার বাণী বাস্তবে পরিণত করে। এসব লোকেরা পয়গম্বরগণের মর্যাদার পর্যায়ে অবস্থান করে এবং তারা ওই সমস্ত ফেরেশতাগণের প্রতিরূপ যারা আরাশের চতুর্দিকে তওয়াফ করে আল্লাহর ইবাদতের সার্বিক মর্যাদা ও তার প্রতিশ্রুত ক্ষমার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মহিমান্বিত আল্লাহ্ পবিত্র গৃহকে ইসলামের জন্য একটা প্রতীক করেছেন এবং আশ্রয় গ্রহণকারীদের জন্য সেটা নিরাপদ স্থান। তিনি কাবার হক আদায়কে ওয়াজেব করেছেন এবং সে দিকে সফরকে বাধ্যতামূলক করেছেন। আল্লাহ্ বলেনঃ … এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ করা সেসকল লোকের জন্য বাধ্যতামূলক যারা কাবা পর্যন্ত যাবার সামর্থ্য রাখে । কিন্তু কেহ অস্বীকার করলে, জেনে রাখুক, আল্লাহ বিশ্বজগতের মুখাপেক্ষী নন (কুরআন- ৩:৯৭) ।
১ । “আল্লাহর মা’রেফাতেই দ্বিনের ভিত্তি।” দ্বিনের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে আনুগত্য স্বীকার করা এবং সাধারণভাবে দ্বিনি বলতে বিধান বুঝায়। যে কোন অর্থই গ্রহণ করা হোক না কেন অন্তর যদি আল্লাহর মা’রেফাতের ধারণাবিহীন হয় তবে আনুগত্যের প্রশ্নই ওঠেনা। সেক্ষেত্রে বিধান অনুসরণের প্রশ্নও বাতুলতা মাত্র। কারণ যখন কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে না তখন লক্ষ্যে পৌছার জন্য অগ্রযাত্রারও কোন দিক নির্দেশনা থাকে না । কোন লক্ষ্য-বিষয়ের ধারণা না থাকলে তা পাবার প্রচেষ্টাও করা যায় না। তা সত্ত্বেও মানুষ যখন কোন উন্নত ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসে তখন তাঁর আনুগত্যের উপলব্ধি ও প্রেরণা মানুষের স্বভাব ও ব্যক্তিগত গুণাবলীকে প্রভাবিত করে মানুষের বা তেনকে উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করে।
“আল্লাহর মা’রেফাত” সম্পর্কীয় অত্যাবশ্যকীয় বিষয়সমূহ বৰ্ণনার পর আমিরুল মোমেনিন এর মূল উপাদান ও শর্তসমূহ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন যে, মানুষ যদিও মা’রেফাত জ্ঞানকে উচু স্তরের চিন্তা ভাবনা মনে করে এড়িয়ে যেতে চায়। তবুও এর প্রাথমিক ধাপ হলো অজানাকে জানার সহজাত আকাঙ্ক্ষা ও বিবেকের তাড়না অথবা মোমিনের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে অদৃশ্য সত্তা সম্পর্কে একটা ধারণা মনের মধ্যে গড়ে তোলে। বস্তৃত এ ধারণাটাই আল্লাহর মা’রেফাত অন্বেষণের পথিকৃত হিসাবে কাজ করে। কিন্তু যারা গাফেল অথবা পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে গবেষণায় নিমগ্ন হতে পারে না তাদের মনে ধারণার সৃষ্টি হলেও তারা মা’রেফাতের গভীর সমুদ্রে ডুব দিতে পারে না এবং তাদের কাছে মা’রেফাতের ধারণা বদ্ধমূল হতে পারে না। এক্ষেত্রে তারা আল্লাহ্‌র অস্তিত্ব
জ্ঞান থেকে বঞ্চিত থাকে এবং এ পর্যায়ে যেহেতু সাক্ষ্য বহনের স্তর তাদের কাছে অনভিগম্য, সেহেতু এ বিষয়ে তারা প্রশ্নযোগ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু যদি কেউ মা’রেফাত সম্পর্কে অর্জিত মানসচিত্র দ্বারা পরিচালিত হয়ে এগিয়ে যায় সে বুঝতে পারে এতে গভীর চিন্তা ও গবেষণা অত্যাবশ্যক। এভাবেই মানুষ আল্লাহর মা’রেফাত লাভের পরবতী স্তরে উপনীত হয়। এ স্তর হলো সৃষ্টির বৈচিত্র্যের মাঝে স্রষ্টার খোজ করা। কারণ প্রতিটি শিল্পকর্ম শিল্পীর অস্তিত্বের সর্বসম্মত ও দৃঢ় প্রমাণ এবং প্রতিটি ক্রিয়ায় কোন না কোন প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান। মানুষ যেদিকে দৃষ্টিপাত করুক না কেন সে এমন কোন কিছুর অস্তিত্ব বের করতে পারবে না। যা কেউ না কেউ তৈরি করে নি; এমন কোন পদচিহ্ন দেখাতে পারবে না যেখানে কেউ হাঁটে নি; এমন কোন নির্মাণ কাজ দেখাতে পারবে না। যার কোন নির্মাতা নেই। এরপরও মানুষ কিভাবে ভাবতে পারে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র খচিত বিস্তীর্ণ নীলাকাশ ও তৃণফুল সুশোভিত। এ সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টিকর্তা ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে? সুতরাং বস্তুনিচয় আর সৃষ্টির নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া দেখার পরও কি কেউ এ কথা বলতে পারে যে, এ বৈচিত্র্যময় বিশ্বচরাচরের সৃষ্টিকর্তা নেই? কারণ বস্তুসত্তা অনস্তিত্ব
থেকে আসতে পারে না বা অসত্তা (nothingness) অস্তিত্বের কারণ হতে পারে না। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনের যুক্তিবিন্যাস হলোঃ আল্লাহ সম্বন্ধে কি কোন সন্দেহ আছে যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মৌলিক সৃষ্টিকর্তা” (১৪:১০)
কিন্তু মা’রেফাতের এ স্তরটিও অপর্যাপ্ত হয়ে পড়ে যখন আল্লাহর অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন তাগুতের প্রতি বিশ্বাস দ্বারা কলঙ্কিত করা হয় ।
মা’রেফাতের পথে তৃতীয় স্তর হলো আল্লাহর ঐক্য ও একত্বে গভীর বিশ্বাসসহ তাঁর অস্তিত্বের স্বীকৃতি অর্থাৎ
তৌহিদে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। তৌহিদে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারলে আল্লাহর অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন পরিপূর্ণ হয় না, কারণ তাগুতে বিশ্বাস করলে আল্লাহতে বহুত্ব আরোপ করা হয়। অথচ মা’রেফাত অর্জনের জন্য আল্লাহকে একক হিসাবে গ্রহণ করা অপরিহার্য। একাধিক আল্লাহর ধারণা করলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে যে, এ বিশ্বচরাচর কি তাদের একজন সৃষ্টি করেছে, নাকি তারা সকলে সম্মিলিতভাবে করেছে? যদি তাদের কেউ একজন সৃষ্টি করতো তাহলে অপরজন নিজকে প্রভেদ করে দেখানোর জন্য অন্য রকম সৃষ্টি করতো। আবার যদি তারা সকলে
সমষ্টিগতভাবে সৃষ্টি করতো তা হলে দুটো অবস্থার সৃষ্টি হতো- হয় তারা একে অপরের সহায়তা ব্যতীত কর্ম সম্পাদন করতে পারতো না, না হয়। কারোই অপরের সহায়তার প্রয়োজন হতো না। প্রথম অবস্থাটি অক্ষমতা প্রকাশক যাতে দেখা যায়। একজন অপরজনের উপর নির্ভরশীল এবং অপর অবস্থাটিতে দেখা যায় তারা প্রত্যেকে
নিয়মিত আলাদা আলাদা ক্রিয়া সম্পাদক। ধরা যাক, সকল স্রষ্টা তাদের সৃষ্টিকর্ম নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে সম্পাদন করছেন। সেক্ষেত্রে অবস্থাটা এমন হতো যে, প্রতিটি সৃষ্টি শুধুমাত্র তার নিজস্ব স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক বজায়
রাখতো—সমগ্র সৃষ্টি একই স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করতো না। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা তা নয়। প্রতিটি সৃষ্টজীব
স্রষ্টার সাথে একই সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে এবং বিশ্বচরাচরের সবকিছু একই নিয়মে চলছে। মোট কথা, আল্লাহর একত্বের স্বীকৃতি না দিয়ে কোন উপায় নেই, কারণ একাধিক সৃষ্টিকর্তার ধারণা গ্রহণ করলে কোন কিছুর অস্তিত্বের সম্ভাব্যতা থাকে না এবং নিঃসন্দেহে পৃথিবী ও নভোমন্ডলসহ সৃষ্টির সবকিছু ধ্বংস হয়ে যেতো। মহিমান্বিত আল্লাহ নিম্নরূপ যুক্তি প্রদর্শন করেনঃ
যদি আল্লাহ্ ব্যতীত আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মধ্যে বহু ইলাহ থাকতো, তবে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যেতো …(কুরআন- ২১ ? ২২) । মা’রেফাতের চতুর্থ স্তর হলো আল্লাহকে সকল দোষ-ত্রুটি ও বিচূতি মুক্ত, দেহ ও আকার নিরপেক্ষ,
বস্তুমোহ নিরপেক্ষ, কোন প্রকার উপমা ও সাদৃশ্য মুক্ত, স্থান ও কালের সীমাবদ্ধতা মুক্ত, গতি ও নিশ্চলতা মুক্ত এবং অক্ষমতা ও অজ্ঞতা মুক্ত মনে করতে হবে। কারণ পরম পবিত্র সত্তায় কোন দোষ-ত্রুটি থাকতে পারে না বা কেউ তার সদৃশ হতে পারে না। এসব অবস্থা স্রষ্টার মহান মর্যাদা থেকে একটা সত্তাকে সৃষ্টির পর্যায়ে নামিয়ে আনে। এ কারণেই আল্লাহ তার একত্বসহ সকল ত্রুটি-বিচূতি থেকে পরম পবিত্রতা ধারণ করেছেন। আল্লাহ বলেনঃ
… তিনিই আল্লাহ, একক। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন । তিনি কাউকে জন্ম দেন নি এবং তাঁকেও কেউ জন্ম দেয় নি । এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই। (কুরআন- ১.১২ ? ১-৪) তিনি দৃষ্টির অধিগম্য নন। কিন্তু দৃষ্টিশক্তি তাঁর অধিগত এবং তিনিই সূক্ষ্মদর্শী সম্যক পরিজ্ঞাতা (কুরআন- ৬:১০৩) সুতরাং আল্লাহর কোন সদৃশ উদ্ভাবন করো না । আল্লাহ্ (সর্ব বিষয়ে) পরিজ্ঞাত এবং তোমরা কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা / (কুরআন -৪২ ? ১১) মা’রেফাতের পঞ্চম স্তর হলো আল্লাহর প্রতি বাইরের কোন গুণারোপ করা যাবে না পাছে তাঁর একত্বে দ্বৈততা এসে যায় এবং একের মধ্যে তিন ও তিনের মধ্যে একের গোলক ধাধায় একত্রে গৃঢ়ার্থ গির হারিয়ে যায়। কারণ তাঁর সত্তা আকার ও সত্তাসারের সংমিশ্রণ নয়। সে কারণে আল্লাহতে গুণ এমনভাবে জড়ানো যেমন ফুলে ঘাণ অথবা তারকারাজীতে দীপ্তি। বরং তিনিই সকল গুণের ঝরনাধারা এবং তার যথার্থ গুণাবলী প্রকাশের জন্য কোন মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না। তাকে সর্বজ্ঞ বলা হয় কারণ তাঁর জ্ঞানের চিহ্নসমূহ স্পষ্টত প্রতীয়মান। তাঁকে সর্বশক্তিমান বলা হয়। কারণ প্রতিটি অণু পরমাণু তাঁর সর্বশক্তিমান হওয়া ও সক্রিয়তার নির্দেশক। যদি আল্লাহর প্রতি এ গুণারোপ করা হয় যে তার শ্রবণ ও দর্শন করার ক্ষমতা আছে। তবে এটা যথার্থ যে, দর্শন ও শ্রবণ ব্যতীত সমগ্র সৃষ্টির সুসঙ্গত প্রশাসন রক্ষা করা সম্ভব নয়। কিন্তু এসব গুণাবলী সৃষ্টজীবে যেভাবে আছে (যেমন কর্ণ দ্বারা শুনা বা চক্ষু দ্বারা দেখা) আল্লাহর ক্ষেত্রে অনুরূপ মনে করা যাবে না। তদুপরি এমনটিও ধারণা করা যাবে না যে, তিনি জ্ঞানার্জনের পর জানতে সক্ষম হয়েছেন বা তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে শক্তি সঞ্চালনের পর তিনি শক্তিমান হয়েছেন। আল্লাহর সত্তা থেকে গুণকে আলাদা চিন্তা করলে দ্বিত্ব প্রকাশ করা হয়, আর যখনই দ্বিত্ব প্রকাশ পাবে তখনই একত্ব অন্তর্ধান হবে। এ কারণে আমিরুল মোমেনিন আল্লাহর সত্তা থেকে গুণ আলাদা, এমন ধারণা বাতিল করে দিয়েছেন। তিনি একত্বকে এর প্রকৃত গুঢ়ার্থে ব্যক্ত করেছেন এবং বহুত্বের কলঙ্ক দ্বারা একত্বকে কলঙ্কিত করেন নি। এ কথায় এটা বুঝায় না যে, আল্লাহর প্রতি কোন বিশেষণ প্রয়োগ করা যাবে না। নাস্তিক্যের অতল অন্ধকারে যারা ডুবে আছে তারাই আল্লাহ্‌র বিশেষণহীনতার ধারণা পোষণ করে। অথচ সৃষ্টিচরাচর আল্লাহর গুণরাজীতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ; সৃষ্টির প্রতিটি অণু সাক্ষ্য দেয়—তিনি সর্বজ্ঞ, তিনি সর্বশক্তিমান, তিনি সর্বশ্রোতা, তিনি সর্বদ্রষ্টা এবং তিনি সযত্নে সৃষ্টিকে প্রতিপালন করেন ও অনুকম্পা দ্বারা ক্রমবৃদ্ধি করেন। বিষয়টি হলো এই যে, কোন কিছু করার জন্য অন্যের পরামর্শ তার প্রয়োজন হয় না; কারণ নিজ সত্তায় তিনি গুণ পরিবেষ্টিত এবং তার গুণরাজীই তাঁর সত্তার জ্ঞাতার্থে ইমাম জাফর আস-সাদিক অন্যান্য ধর্মে বর্ণিত আল্লাহর একত্বের বিষয়টি তুলনা করে বলেনঃ আমাদের মহিমান্বিত ও পরম দয়ালু আল্লাহ নিজ সত্তায় জ্ঞানায়িত ছিলেন যখন জানার মতো কিছুই ছিল না, নিজ সত্তায় দৃষ্টিমান ছিলেন যখন দেখার মতো কোন কিছুই ছিল না, নিজ সত্তায় শ্রীতিমান ছিলেন যখন শোনার মতো কোন কিছু ছিল না, নিজ সত্তায় শক্তিমান ছিলেন যখন তাঁর শক্তির অধীন কোন কিছুই ছিল না । যখন তিনি বস্তুনিচয় সৃষ্টি করলেন এবং জ্ঞানেন্দ্ৰিয় অস্তিত্বশীল হলো তখন তাঁর জ্ঞান জ্ঞেয়র সাথে, শ্রীতি শ্রাব্যের সাথে, দৃষ্টি দৃশ্যমানের সাথে এবং শক্তি বস্তুর সাথে সম্বন্ধযুক্ত হলো (সাদুক, পৃঃ ১৩৯) ।
আহলুল বাইতের ইমামদের এ বিশ্বাস সর্বসম্মত। কিন্তু ইমামগণ ব্যতীত বিভিন্ন দল আল্লাহর জাত ও সিফাতের মধ্যে পার্থক্যের ধারণা সৃষ্টি করে ভিন্ন ধারা গ্রহণ করেছে। আবুল হাসান আল-আশারীর মতে আল্লাহ্ জ্ঞানের মাধ্যমে জানেন; ক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তিশালী, উক্তির মাধ্যমে কথা বলেন; শ্রুতির মাধ্যমে শোনেন এবং দৃষ্টির মাধ্যমে দেখেন (শাহরাস্তানী, ১ম খন্ড, পৃঃ ৪২)। আশারীর উপরোক্ত ধারণানুযায়ী যদি জাত আর সিফাতকে আলাদা ধরা হয় তবে দুটি বিকল্প দাঁড়ায়— হয়। সিফাত আদি থেকেই আল্লাহতে রয়েছে, না হয় তা পরবতীতে সংঘটিত হয়েছে। প্রথম ক্ষেত্র মেনে নিলে একথাই স্বীকার করা হবে যে, আল্লাহর অনাদি-অনন্ত অস্তিত্বকাল থেকেই গুণরাজীর সমসংখ্যক বস্তুনিচয় বিরাজমান ছিল যা তার অনন্ততার অঅংশীদার হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু “মানুষ তাকে যা কিছুর সমতুল্য মনে করুক না কেন তিনি এসবের উর্ধে” (কুরআন)। দ্বিতীয় ক্ষেত্র মেনে নিলে আল্লাহকে শুধুমাত্র পরিবর্তনের শর্তাধীনই করা হয় না। বরং এটাও বুঝানো হয় যে, গুণরাজী অর্জনের পূর্বে তিনি বিজ্ঞানপ্রাপ্ত ছিলেন না; শক্তিশালী অথবা শ্রোতা অথবা দ্রষ্টা ছিলেন না। এহেন ধারণাসমূহ ইসলামের মূল দর্শনের বিপরীত। বাংলা অনুবাদকের মন্তব্য
আমিরুল মোমেনিন আলী ইবনে আবি তালিবের এ খোৎবাটি অত্যন্ত তাত্ত্বিক। এতে তিনি আল্লাহতত্ত্ব, মহাবিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্ব, মানব সৃষ্টিতত্ত্ব, নবিতত্ত্ব, ফেরেশতা তত্ত্ব অতি চমৎকার আলঙ্কারিক ভাষায় সংক্ষিপ্তাকারে ব্যক্তি করেছেন। এ বিষয়গুলো দর্শনশাস্ত্রের মৌলিক বিষয় বলে চিহ্নিত। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই দার্শনিকগণ এ বিষয়গুলোর ওপর নানা প্রকার মতো ও তত্ত্ব প্রদান করে আসছেন। আধুনিক বিশ্বের মহান দার্শনিকগণও তাদের চিন্তা, ধ্যান-ধারণা ও অভিমত এ বিষয়গুলোর ওপর ব্যক্ত করে যাচ্ছেন। কিন্তু এক দার্শনিকের প্রদত্ত তত্ত্ব অন্যজন হয় পরিমার্জিত করেন, না হয়। বাতিল করে দেন। কেউ এখনো এ বিষয়গুলোতে সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন নি। এটা মনে হচ্ছে একটা Endless Belt. আজ থেকে প্রায় ১৪০০ বছর পূর্বে আমিরুল মোমেনিন স্রষ্টা-জগৎ-জীবনের যে তত্ত্বগত দার্শনিক যুক্তি প্রদর্শন করে গেছেন তা সারা বিশ্বের দার্শনিকের তাত্ত্বিক দর্শনের প্রধান উদ্দেশ্য বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। শুধু এ খোৎবাতেই নয়, তাঁর অধিকাংশ খোৎবায় তিনি এমনভাবে আল্লাহতত্ত্ব প্রকাশ করেছেন যা দার্শনিকগণের উপজীব্য।
আল্লাহতত্ত্বঃ সক্রেটিস প্রাকৃতিক নিয়মানুবর্তিতা এবং জগৎসমূহের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা ও রূপবৈচিত্র্যের পেছনে এক প্রজ্ঞাবান ঐশী সত্তার সন্ধান পেয়েছেন। জগতের প্রতীয়মান উদ্দেশ্য থেকে তিনি পরম জ্ঞানবান ঈশ্বরের হবো।” ঈশ্বর বলতে তিনি এক সর্বব্যাপক পরিণামদশী আধ্যাত্মিক সত্তাকে বুঝেছেন, কোন জড়ীয় সত্তাকে নয় (ইসলাম, পৃঃ ১৮১)। সক্রেটিসের Know thyself, তত্ত্ব পরবর্তীতে ইসলামের মান আরাফা নাফসাহু, ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু” (যে নিজকে চিনেছে সে তার প্রভুকে চিনেছে) তত্ত্বে রূপান্তরিত হয়ে এক গভীর অন্তর্ব্যাপী সূক্ষ্ম পরিণামদশী ভাবধারার জন্ম দিয়েছে। প্লেটো স্রষ্টাকে অনন্ত বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি হোমারিয় দেবতা তত্ত্ব বাতিল করে দিয়ে বলেছেন, “নক্ষত্রপুঞ্জ ও দেবতাগণ একই ঈশ্বরের সৃষ্টি।” এরিষ্টটল ঈশ্বর বলতে বুঝেছেন আচালিত চালক, জড়াতীত চেতনা বা উপাদানহীন পরম সত্তাকে। তাঁর মতে ঈশ্বর নিরপেক্ষ ফরম বা রূপ। আর রূপ মানেই সার্বিক বা অতিবতী উপাদানহীন রূপ। ক্টোয়িক দার্শনিকগণ জগৎ সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণের মূলে ঈশ্বরকে দেখেছেন এবং তাকে সর্বদশী, সর্বশক্তিমান ও প্রেমময় বলে বর্ণনা করেন। তাদের মতে জগৎ এক পরম কল্যাণগুণনিদান সত্তা, তথা এক মহান উদ্দেশ্যের অভিব্যক্তি। মানবাত্মা যেমন ব্যক্তির সারা দেহ জুড়ে বিদ্যমান, তেমনি স্টোয়িকদের ঈশ্বরও জগতের সর্বত্র বিদ্যমান (ইসলাম”, পৃঃ ১৮২)। এ মতবাদই মুসলিম দার্শনিকদের “ওয়াহদাতুল ওজুদ’ (সত্তার ঐক্য বা সর্বেশ্বরবাদ) তত্ত্বের রূপ পরিগ্রহ করেছে।
মধ্যযুগের দার্শনিক অগাস্টিন যুক্তিবুদ্ধির চেয়ে অনাবিল বিশ্বাসের ওপর বেশি জোর দেন। তাঁর মতে, ঈশ্বর ছাড়া অন্য কোন চূড়ান্ত বাস্তব সত্তা নেই। ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মাত্রই মানুষ চির অভিশাপে নিপতিত হয়। তাঁর মতে, শুধু ঈশ্বরকে জানাই যথেষ্ট নয়, ঈশ্বর প্রাপ্তির জন্য ঐশী প্রেম ও ভক্তি অপরিহার্য। প্লোটিনাসের মতে, ঈশ্বর দেহ ও মনের, রূপ ও উপাদানের, তথা সকল অস্তিত্বের উৎস। তবে তিনি নিজে বহুত্বের উর্ধে। তিনি পরম একক সত্তা এবং সবকিছুই তাঁর মহা একত্বের অন্তর্ভুক্ত। ঈশ্বর থেকেই সব কিছুর উৎপত্তি ও বিকিরণ। আমরা ঈশ্বরে সৌন্দর্য, মহত্ত্ব, চিন্তা, বাসনা, ইচ্ছা, অভীপ্সা ইত্যাদি কোন গুণই আরোপ করতে পারি না; কারণ এসব গুণ সীমিতশক্তি ও অপূর্ণতার আকর। ঈশ্বর যে আসলে কী তা আমরা বলতে পারি না। আমরা তাকে অচিন্তনীয় সত্তা বলতে পারি। তিনি চিন্তনীয় নিন। যা চিন্তনীয় তার সঙ্গে বিষয় ও বিষয়ীর দ্বৈততা বিজড়িত। সুতরাং ঈশ্বরে কোন গুণ আরোপ করা যায় না। কারণ সসীম গুণ আরোপের মানেই অসীম সত্তাকে সীমিত করে ফেলা। এভাবে ভাববাদী দার্শনিক হেগেল ঈশ্বরকে পরম ধারণা বা সার্বিক প্রজ্ঞা বলে অভিহিত করেন। তিনি বলতেন— ঈশ্বর জগতে নিমজিত নন, আবার জগৎ ঈশ্বরে নিমজিত নয়। জগৎকে বাদ দিয়ে ঈশ্বর আর ঈশ্বর থাকেন না। একইভাবে বার্কলে, ব্র্যাডলি, রয়েস, জেমস প্রভৃতি ভাববাদী দার্শনিকগণ আল্লাহকে পরম সত্তা, প্রান্তিক একত্ব, অনুত্তর পরমসত্তা, অসীম পরমসত্তা ইত্যাদি রূপে ব্যাখ্যা করে আল্লাহর একত্রে প্রকাশ করেছেন
(ইসলাম, পৃঃ ১৮৪-১৮৫)। মুসলিম ভাববাদী ও প্রেমবাদী দার্শনিকগণের ধ্যান ধারণায় একই কথা অর্থাৎ “আমি তুমি নই, আবার তোমা থেকে জুদা (আলাদা) নাই।” তত্ত্বের সমাবেশ ঘটেছে। খৃষ্টপূর্ব ৫৪৮ অব্দে থেলিস নামক এক গ্রিক পন্ডিত-প্রকৃতির মধ্যে পরম ঐক্যনীতি বা পরম একত্বের সন্ধান লাভ করেন। তিনি বলেন যে, বিশ্বজগতে কোন কিছুর কারণ হিসাবে কোন কিছুকে ধরা হলে দেখা যায় তা প্রকৃত কারণ নয়, তার পশ্চাতে অন্য একটি কারণ রয়েছে। এভাবে কারণ পরম্পরা শৃঙ্খলের ন্যায় প্রসারিত হতে থাকে। তিনি বলেন, এভাবে কারণ অনুসন্ধান করে যতই মূলের দিকে যাওয়া যায় ততই কারণের পিরামিডের চূড়া সরু হয়ে আসে। এতে তিনি মনে করেন যে, কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যাবে একটা মাত্র কারণ থেকে সকল বস্তুর উৎপত্তি হয়েছে, যাকে তিনি মূল কারণ” বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর এ সূত্র ধরে এনাক সিমেনিস, পিথাগোরাস এবং পরবতীতে ডেমোক্রিটাস, হিউম, লক ও বার্কলে ‘অবিভাজ্য পরমাণু’-র মধ্যে পরম ঐক্যের সন্ধান পান (সরকার”৭২, পৃঃ৪৮-৪৯)। এ ধারণা থেকেই মুসলিম দার্শনিকগণ আল্লাহ্ সম্পর্কে Cause of all causes তত্ত্বের উন্নতি সাধন করেন। বিংশ শতাব্দীর দার্শনিক বাট্র্যান্ড রাসেল অভিজ্ঞতাবাদী ও বাস্তববাদী হওয়া সত্ত্বেও জড়বাদ ও আধ্যাত্মবাদের মাঝামাঝি “নিরপেক্ষ একত্ববাদ’-এর প্রচারক ছিলেন। তিনি প্রেমকে জীবনদর্শনের মূল নৈতিক প্রেরণা হিসাবে মেনে নিয়ে এক কল্যাণমুখী বিশ্বমানবতাবাদের বাণী বাহক ছিলেন। (भऊँीन’, ११ १)। মুসলিম দর্শনে আল্লাহতত্ত্ব কুরআন থেকেই উদ্ভূত। সাহাবাদের মধ্যে আমিরুল মোমেনিন ব্যতীত আর কেউ সৃষ্টিতত্ত্ব, আল্লাহ্ তত্ত্ব ইত্যাদি গৃঢ় রহস্যাবৃত বিষয়গুলো নিয়ে দার্শনিক দৃষ্টি ভঙ্গী সম্বলিত বর্ণনা প্রদান করেন নি। কুরআনের রহস্যাবৃত আয়াতগুলোতে এসব বিষয়ের ইঙ্গিত রয়েছে। রাসুল (সঃ) এ বিষয়গুলো সবিশেষ অবহিত ছিলেন। তাঁর জ্ঞান নগরীর দ্বার আলী ইবনে আবি তালিবকে তিনি নিশ্চয়ই এসব তাত্ত্বিক বিষয়গুলো শিক্ষা দিয়েছিলেন। আলী তাঁর সময়ে এসব তত্ত্ব অতি সংক্ষিপ্তাকারে ব্যক্ত করেছে। এরপর আলীর শিষ্যগণ তাত্ত্বিক বিষয়গুলোর আলোচনায় ব্যাপৃত হতে লাগলো। কুরআনের বেশ কিছু সংখ্যক আয়াতের আধ্যাত্মিক ও ভাববাদী মর্মার্থ নিয়েই তাসাউফের সূচনা হয় এবং তাতে সুফি দর্শনের ধ্যান-ধারণা কতিপয় সাধকের মাধ্যমে তাদের ভক্তগণের তালিমের মধ্য দিয়ে ঐকে বেঁকে চলছিলো। অষ্টম শতকের শেষ দিকে জুনুনুন মিসরি ও জুনায়েদ বাগদাদি নামক দুজন সুফি সাধক এসব বিক্ষিপ্ত ভাবধারাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে সুবিন্যস্ত করেন (রশীদ’৭১, পৃঃ ১০৬-১১১)। নবম শতকের প্রথম দিকে বায়েজিদ বাস্তমি ও মনসুর হাল্লাজ সুফি দর্শনের উৎকর্ষ সাধন করেন। বায়েজিদের ফানাতত্ত্ব (বিনাশন) ও হাল্লাজের আনালহকতত্ত্ব আল্লাহ্ তত্ত্ব সম্পর্কে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরপর শায়খুল আকবর ইবনুল আরাবী ওয়াহদাতুল ওজুদ তত্ত্ব ও লগসতত্ত্ব দ্বারা আল্লাহতত্ত্ব ও প্রজ্ঞাতত্ত্বের ব্যাপক যুক্তিতর্ক সম্বলিত আলোচনা তুলে ধরে মুসলিম চিন্তাবিদদের মাঝে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করেন। তাঁর পূর্বে কোন মুসলিম চিন্তাবিদ লগসতত্ত্ব প্রকাশ করে নি। ইবনুল আরাবীর মতে, সমগ্র অস্তিত্বশীল সত্তাসমূহের মূলসত্তা একটি—যা ধর্মীয় ভাষায় আল্লাহ। আল্লাহ্ একমাত্র পরম সত্তা। তাঁর মতবাদ সৰ্বেশ্বরবাদ বলে খ্যাত। তিনি বলেন, এ বিশ্ব জগৎ আল্লাহ-সত্তাময়, আল্লাহর নাম ও গুণের প্রকাশ এবং আল্লাহ ও বিশ্বজগৎ অভিন্ন (সরকার”, পৃঃ ৪৬-১২০), রশীদ”, পৃঃ ২৪২-২৪৮; আলম” “, পৃঃ ৫০১-৫১৯; ইসলাম’, পৃঃ ১৮৯-১৯০)।
এরপর জালালুদিন রূমি প্রেমতত্ত্বের মাধ্যমে সৃফি দর্শনের উৎকর্ষ সাধন করে বলেন, আল্লাহ সৃষ্টিতে লীন কি সৃষ্টি বহির্ভুত কি এ দুয়ের মধ্যাবস্থা–এসব কিছুই নয়। এসব তত্ত্ব দিয়ে আল্লাহর পূর্ণ স্বরূপ জনা যায় না। এসব বিষয়ে বিচার-বুদ্ধি ও বিতর্কমূলক জ্ঞানের প্রয়োজন হয়। ফলে আল্লাহর পূর্ণ স্বরূপ খন্ডভাবে প্রতিভাত হয়। তাই তিনি জ্ঞানের পথ পরিত্যাগ করে প্রেমের পথ ধরে পরম সত্তার সন্ধান লাভ করেছেন। তিনি বলেন প্রেম ছাড়া আল্লাহকে সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করা অসম্ভব। তাকে পরম প্রেমসত্তারূপেই দেখা যায় (সরকার৯৭২, পৃঃ ৩৫৫)। মুসলিম দার্শনিকগণের মধ্যে যারা আল্লাহতত্ত্ব ও সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বিভিন্নভাবে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন তাদের মধ্যে আল-কিন্দি, আল-ফারাবী, ইবনে মাশকাওয়াহ, ইবনে সিনা, ইবনে আল– হায়ছাম, ইবনে হাজাম, ইবনে বাজা, ইবনে রুশদ, ইমাম গাজালী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। মধ্যযুগে এ উপমহাদেশে খাজা মুঈন উদ্দিন হাসান চিশতি প্রেমতত্ত্বের চূড়ান্ত পর্যায়ে তার ‘বাকা’ (One with Allah) তত্ত্ব প্রচার করেন। তার পরবতী সাধক কুতুবুদিন বখতিয়ার কাকি, ফরিদ উদ্দিন গঞ্জে শকর, নিজামুদ্দিন মাহবুবে এলাহি একই তত্ত্ব প্রচার করেন। খাজা মুঈন উদ্দিন হাসান চিশতি এসব তত্ত্ব সর্ব সাধাবণ্যে প্রকাশ না করে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের নিকট প্রকাশ করার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি বলেনঃ খাল গুইয়ান্দাম মুঈন ইন রমজ বর মিম্বার মাগো, আকিন হাজারান ওয়ায়েজ ওয়া মিম্বার বেচুখত । অর্থ ? আমি মুঈন পৃথিবীকে বলে দিলাম, মিম্বারে ওঠে এসব রহস্য প্রকাশ করোনা, কারণ এ আগুনেই হাজার হাজার বক্তা ও মিম্বার পুড়ে ছাই হয়ে গেছে (চিশতি’, দেওয়ান-১৫)। বিংশ শতাব্দীর মুসলিম দার্শনিক আল্লামা মোহাম্মদ ইকবাল আল্লাহকে বর্ণনা করেছেন অনন্ত আধ্যাত্মিক পরম অহং (ego) বলে। এ জগত তাঁর আংশিক অভিব্যক্তি মাত্র। তাঁর মতে আল্লাহ্ একাধারে পরমসত্তা ও পরম স্রষ্টা। আল্লাহ নিজেই পরিপূর্ণ অহং ও পরম আত্মসত্তা স্বরূপ (ইসলাম, পৃঃ ১৮৬)। বাংলাদেশের দার্শনিক মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর ভাষ্যে আল্লামা ইকবালের আল্লাহ্তত্ত্বের চমৎকার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, মানুষ সসীম জ্ঞানের মধ্য দিয়ে অসীমে আত্মসম্প্রসারণের জন্য বড়ই ব্যাকুল। একই বিদ্যুৎপ্রবাহ যেভাবে নগরীর লক্ষ প্রদীপের ভেতর দিয়ে আপনাকে ব্যক্ত করে তেমনি একই মহাপ্রেরণা সমগ্র মানব সমষ্টির ভেতর দিয়ে এক দূর লক্ষ্যের পানে ছুটে চলছে। এই একই চেতনা সত্তা দেশ কালের প্রেক্ষিতে পরিগ্রহ করেছে বহু রূপ ও বিচিত্র প্রকাশ ভঙ্গিমা। একেই নবি-পয়গম্বর ও ভাবুক-সাধকেরা সনাক্ত করেছে। সব কিছুর আদি উৎস ও চূড়ান্ত লক্ষ্য বলে। (ইসলাম”, পৃঃ ১৮৬)। যা হোক, আল্লাহতত্ত্ব নিয়ে দার্শনিকগণের তত্ত্বকথার পর্যালোচনা করা এখানকার বিষয়বস্তু নয় এবং এখানে তা সম্ভবও নয়। এখানে বিষয়টি এজন্য উপস্থাপন করা হয়েছে যে, নাহাজ আল-বালাঘার বিভিন্ন খোৎবায় আমিরুল মোমেনিন আলী ইবনে আবি তালিব যেভাবে আল্লাহতত্ত্ব ব্যক্ত করেছেন তারই সারকথা বিভিন্ন আঙ্গিকে দার্শনিকগণ ব্যক্ত করেছেন ।