ফেকাহবিদগণের মধ্যে আমর্যাদাকর মতদ্বৈধতা’ সম্পর্কে তাদের কোন একজনের কাছে যখন একটা সমস্যা উপস্থাপন করা হয় তখন সে অনুমান ভিত্তিক রায় প্রদান করে। একই সমস্যা যখন তাদের অন্য একজনের কাছে উপস্থাপন করা হয় তখন সে আগের জনের রায়ের বিপরীত সিদ্ধান্ত প্রদান করে। এ বিচারকদ্বয় যখন তাদের পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রধান বিচারকের কাছে যায় (যিনি প্রথমোক্তগণকে নিয়োগ করেছিলেন) তখন তিনি উভয়ের সিদ্ধান্তকেই সমর্থন ও অনুমোদন করেন। অথচ তাদের সকলের আল্লাহ এক, রাসুল এক ও পবিত্র গ্রন্থ এক । তাদের এহেন মতো পার্থক্যের কারণ কী? এটা কী এ জন্য যে, আল্লাহ তাদেরকে মতদ্বৈধতা করতে নির্দেশ দিয়েছেন আর তারা তা পালন করছে? অথবা তিনি মতদ্বৈধতা করতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু তারা তাঁর অবাধ্যতা করছে? অথবা আল্লাহ একটা অসম্পূর্ণ দ্বিন পাঠিয়েছেন এবং এখন তা সম্পূর্ণ করতে তাদের সহায়তা চান? অথবা এসব বিষয়ে তারা কি আল্লাহর অঅংশীদার যে, ভিন্ন ভিন্ন মতো তুলে ধরা তাদের কর্তব্য আর তা সমর্থন করা আল্লাহর কর্তব্য? অথবা এটা কি এমন যে, মহিমান্বিত আল্লাহ পরিপূর্ণ দ্বিান প্রেরণ করেছেন। কিন্তু রাসুল (সঃ) তা পরিপূর্ণভাবে মানুষের নিকট পৌছে দিতে পারেন নি? বস্তুত মহামহিম আল্লাহ বলেনঃ আমরা এ কিতাবে কোন কিছুই বাদ দেই নি (কুরআন-৬:৩৮) । আল্লাহ আরো বলেন যে, কুরআনে প্রত্যেক বিষয়ের বর্ণনা রয়েছে এবং কুরআনের এক অংশ অন্য অংশকে সত্যায়ন করে এবং কুরআনে কোন এখতেলাপ (অপসারণ) নেই। আল্লাহ্ বলেনঃ এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছ থেকে এ কিতাব এলে তারা নিশ্চয়ই এতে অনেক গরমিল দেখতে পেতো (কুরআন-৪ ? ৮২)।
নিশ্চয়ই কুরআনের বাহ্যিক দিক বিস্ময়কর এবং এর অভ্যন্তর দিক গভীর অর্থবোধক। কুরআনের
বিস্ময় কখনো হারিয়ে যাবে না। এবং এর রহস্য কখনো বিলুপ্ত হবে না। কুরআনের জটিল বিষয়গুলো
কুরআন (কুরআনিক জ্ঞান) ব্যতীত কেউ সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারবে না।
১। এটা একটা বিতর্কিত বিষয় যে, কোন বিষয়ে ধর্মীয় বিধানে স্পষ্ট কিছু বলা না থাকলে বাস্তব ক্ষেত্রে তা নিস্পত্তির উপায় সম্পর্কে কোন আদেশ নির্দেশ আছে কিনা। আবুল হাসান আশারী ও তার শিক্ষক আবু আলী যুব্বাই যে মতো পোষণ করেন তা হলো, এরূপ বিষয়ে আল্লাহ্ কোন নির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতির আদেশ দান করেন নি, তবে গবেষণা করে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে সে বিষয়ে রায় প্রদানের ক্ষমতা শাস্ত্রজ্ঞদের ওপর অর্পণ করা হয়েছে, যাতে করে যা তারা নিষিদ্ধ বলবেন তা নিষিদ্ধই মনে করতে হবে এবং যা তারা অনুমোদন করবেন তা জায়েজ মনে করতে হবে। এসব শাস্ত্রজ্ঞদের একজনের অভিমত যদি অন্যজনের বিপরীত হয় তবে একই বিষয়ে যতগুলো রায় পাওয়া যাবে তার প্রত্যেকটি চূড়ান্ত ও সঠিক বলে মেনে নিতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, যদি একজন শাস্ত্রজ্ঞ রায় দেন যে, যবের সিরা হারাম এবং অন্যজন বলেন এটা হালাল তবে এটাকে হারাম ও হালাল উভয়ই মেনে নিতে হবে। অর্থাৎ যে এটাকে হারাম মনে করবে তার জন্য হারাম আর যে হালাল মনে করবে তার জন্য হালাল। শাহরাস্তানী** লেখেছেনঃ একদল চিন্তাবিদ মনে করেন যে, কোন বিষয়ে ইজতিহাদ (গবেষণা) করার অনুকূলে কোন স্বতঃসিদ্ধ মতবাদ নেই । কিন্তু মুজতাহিদ (গবেষক) কোন বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাই আল্লাহর আদেশ, কারণ মুজতাহিদের রায়ের ওপর আল্লাহর অভিপ্রায়ের অবধারণ নির্ভর করে। যদি এমনটি না হতো। তবে রায়ের মোটেই কোন প্রয়োজন থাকতো না । এ মতানুযায়ী প্রত্যেক মুজতাহিদ তার মতামতে সঠিক ও শুদ্ধ (পৃঃ ৯৮) । এক্ষেত্রে মুজতাহিদগণকে সকল ভুলের উর্ধে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ তখনই ভুল সংঘটিত হয়েছে বলে মনে করা যায় যখন বাস্তবতার বিপরীতে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। যেখানে রায়ের বাস্তব অস্তিত্ব নেই সেখানে ভুল হয়েছে মনে করা অর্থহীন। তাছাড়া মুজতাহিদকে তখনই ভুল-ভ্রান্তির উর্ধে মনে করা যাবে যখন ধরে নেয়া হবে যে, আল্লাহ্ তাদের সকল মতামত জ্ঞাত হয়ে অনেকগুলো চূড়ান্ত আদেশ দান করেছেন যার ফলে তাদের প্রত্যেকের অভিমত কোন না কোন আদেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। অথবা আল্লাহ এ মর্মে নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন যে, মুজতাহিদদের কোন সিদ্ধান্ত আল্লাহর নির্দেশ বহির্ভূত হয় না। অথবা দৈবক্রমে তাদের প্রত্যেকের অভিমত কোন না কোন ঐশী নির্দেশের সাথে মিলে যায়। ইমামিয়া দলের অবশ্য ভিন্ন মতবাদ আছে। তারা মনে করে ধমীয় বিধি-বিধান প্রণয়নের অধিকার আল্লাহ কাউকে অর্পণ করেন নি বা কোন বিষয়কে মুজতাহিদদের অভিমতের অধীন করে দেন নি বা তাদের মতদ্বৈধতা সমন্বয় করার জন্য বিভিন্ন বাস্তব আদেশ দান করেন নি। অবশ্য, যদি মুজতাহিদ একটা বাস্তব আদেশে উপনীত হতে না পারে তখন সে গবেষণা ও অনুসন্ধান করে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা মেনে আমল করা তার নিজের ও তার অনুসারীদের জন্য যথেষ্ট। মুজতাহিদের এমন সিদ্ধান্ত প্রকৃত আদেশের বিকল্প হিসেবে ধরে নেয়া যায়। এক্ষেত্রে প্রকৃত আদেশ হতে সরে যাবার জন্য সে ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে, কারণ সে মুক্তা আহরণের জন্য তার সাধ্যমতো গভীর সমুদ্রে ডুব দিয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় সে মুক্তার বদলে ঝিনুক পেয়েছে। সে মানুষকে একথা বলে না। যে, সে যা পেয়েছে তাই মুক্তা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে বা সে ঝিনুককে মুক্তা বলে বিক্রি করে না। এটা ভিন্ন কথা যে, আল্লাহ তার প্রচেষ্টার প্রতিদান প্রদান করতে পারেন, কারণ কোন প্রচেষ্টাই বৃথা যায় না। বিশুদ্ধতা মতবাদ যদি মেনে নেয়া হয় তাহলে প্রত্যেক রায় ও অভিমত শুদ্ধ বলে গ্রহণ করতে হবে । হুসায়েন মাবুদী তার ফাওয়াতিহ গ্রন্থে লেখেছেনঃ এ বিষয়ে আশারীর অভিমত সঠিক । তার অভিমত অনুযায়ী পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্তের সব ক’টিই সঠিক। সাবধান, শাস্ত্রজ্ঞদের সম্পর্কে কোন খারাপ ধারণা পোষণ করো না এবং তাদের প্রতি কখনো কুবাক্য প্রয়োগ করো না ।
যখন পরস্পরবিরোধী মতবাদ ও বিপথগামী অভিমতকে শুদ্ধ বলে গ্রহণ করা হয় তখন কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির কর্মকান্ডকে সিদ্ধান্তের ভুল বলে ব্যাখ্যা দেয়া অদ্ভুত ব্যাপার। কারণ মুজতাহিদের সিদ্ধান্তের ভুল কল্পনাই করা যায় না। যদি বিশুদ্ধতা মতবাদ মেনে নেয়া হয় তাহলে মুয়াবিয়া ও আয়শার কর্মকান্ডগুলো সঠিক বলে ধরে নিতে হয়। যদি তাদের কর্মকান্ড ভুল বলে মনে করা হয় তাহলে মেনে নিতে হবে যে, ইজতিহাদও ভুল হতে পারে। কাজেই বিশুদ্ধতা মতবাদও ভুল। যা হোক, বিশুদ্ধতা মতবাদ প্রচারিত হয়েছিল ভুলকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য এবং এ মতবাদকে আল্লাহর আদেশের সাথে জড়িয়ে দেয়া হয়েছে যেন উদ্দেশ্য হাসিলে কোন বাধা না আসে বা কোন কুকর্মের বিরুদ্ধে কেউ কোন কথা না বলতে পারে।
এ খোৎবায় আমিরুল মোমেনিন সে সব লোকের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন যারা আল্লাহর পথ থেকে সরে পড়ে,
আলোতে চোখ বুজে কল্পনার অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ায়, ইমানকে অভিমত ও সিদ্ধান্তের শিকারে পরিণত করে,
নতুন রায় ঘোষণা করে, নিজেদের কল্পনার ওপর ভিত্তি করে আদেশ জারি করে এবং বিপথগামী ফলাফল সৃষ্টি
করে। তারপর তারা বিশুদ্ধতা মতবাদের ভিত্তিতে সকল বিপরীত ও বিপথগামী আদেশকে আল্লাহ থেকে প্রাপ্ত বলে চালিয়ে দেয়। এ মতবাদকে মিথ্যা প্রমাণ করে আমিরুল মোমেনিন বলেনঃ
যেখানে আল্লাহ এক, রাসুল এক ও কুরআন এক সেখানে অনুসরণীয় ধর্মও এক হতে হবে। যখন ধর্ম এক তখন তাতে একটা বিষয়ে বিভিন্ন আদেশ থাকবে কেমন করে? একটা আদেশে বিভিন্নতা থাকতে পারে শুধুমাত্র তখন, যখন আদেশদাতা তার আদেশ ভুলে যায় অথবা বিস্মরণশীল হয় অথবা জ্ঞানহীনতা তাকে আঁকড়ে ধরে অথবা তিনি ইচ্ছা করে গোলক ধাধায় জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু আল্লাহ ও রাসুল। এসব কিছুর উর্ধে। সুতরাং বিভিন্নতা ও বিপথগামিতা তাদের প্রতি আরোপ করা যায় না। এসব বিভিন্নতা বরং তাদের চিন্তা ও অভিমতের ফল যারা নিজেদের কল্পনাপ্রসূত কর্মপদ্ধতি দ্বারা দ্বনের সহজ পথে জটিলতার সৃষ্টি করে। এসব বিপথ হয় আল্লাহ্ নিষিদ্ধ করেছেন, না হয় এগুলো সৃষ্টির জন্য তিনি আদেশ দিয়েছেন। যদি তিনি এগুলোর অনুকূলে কোন আদেশ দিয়ে থাকেন তবে তা কোথায়, কোনখানে আছে? এগুলো নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কে কুরআন বলেঃ বল, আল্লাহ কি তাঁর সম্বন্ধে মিথ্যারোপ করতে তোমাদের অনুমতি দিয়েছেন? (১০ ? ৫৯)
আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী না হলে সবকিছুই বানোয়াট উদ্ভাবন বই কিছু নয় এবং এহেন বানোয়াট উদ্ভাবন নিষিদ্ধ। যারা বানোয়াটিকারী পরকালে তাদের কোন কৃতকার্যতা ও কল্যাণ নেই। আল্লাহ বলেনঃ “তোমাদের জিহ্বা মিথ্যারোপ করে বলে আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করার জন্য “এটা হালাল এবং ওটা হারাম”- বলো না। আল্লাহ সম্বন্ধে যারা মিথ্যা উদ্ভাবন করে তারা সফলকাম হয় না।” | (والالا 3 والا- كا كدلك) আল্লাহ্ যদি দ্বিনকে অসম্পূর্ণ রাখতেন এবং সে অসম্পূর্ণতার কারণ যদি এটা হতো যে, ধর্মীয় বিধান সম্পূর্ণ করতে তিনি মানুষের সহায়তা এবং বিধান প্রণয়নে তাঁর সাথে মানুষের অংশগ্রহণ আশা করেছিলেন, তাহলে এহেন বিশ্বাস বহু-আল্লাহবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। আর যদি আল্লাহ্ পূর্ণাকারে দ্বিনের বিধান প্রেরণ করে থাকেন তা হলে রাসুল তা সঠিকভাবে মানুষের কাছে পৌছে দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, যেজন্য অন্যদের কল্পনা ও মতামত প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে। এমন ধারণায় রাসুলের দুর্বলতা বুঝায় এবং রাসুল হিসেবে তাঁর মনোনয়নের প্রতি এটা কলঙ্কারোপ (নাউজুবিল্লাহ)। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি কুরআনে কোন কিছুই বাদ দেন নি এবং প্রতিটি বিষয় তাতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখন যদি কোন আদেশ কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক করে বক্র করা হয় তবে তা হবে ধর্মের বিধি বহির্ভূত। এহেন বক্রতার ভিত্তি জ্ঞান বা কুরআন ও সুন্নাহ্ হতে পারে না। এটা কারো ব্যক্তিগত অভিমত বা বিচার-বিবেচনা হতে পারে, যা ধর্ম ও ইমানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে গ্রহণ করা যায় না ।
(৫) কুরআন ধর্মের উৎস ও ভিত্তি এবং শরিয়তের আইনের ঝরনাধারা। যদি শরিয়তের বিধানে মতদ্বৈধতা থাকতো তাহলে কুরআনেও তা থাকতো। কুরআনে মতদ্বৈধতা থাকলে তা আল্লাহর বাণী
বলে গ্রহণ করা যেতো না। যেহেতু কুরআন আল্লাহর বাণী বলে সর্ব স্বীকৃত সেহেতু শরিয়তের বিধানে কোন মতদ্বৈধতা থাকতে পারে না।