ধমোপদেশ সম্পর্কে
হে আল্লাহর বান্দাগণ, তোমরা মহিমান্বিত আল্লাহর বাণী থেকে উপকৃত হবার পথ অনুসন্ধান কর। আল্লাহর সতর্কাদেশাবলী মান্য কর এবং তার উপদেশাবলী গ্রাহ্য করে চলো। কারণ তিনি সুস্পষ্টভাবে হেদায়েতের পথ নির্দেশ করে দিয়ে তোমাদের জন্য কোন ওজর উত্থাপনের সুযোগ রাখেন নি। যেসকল কর্মকাণ্ড তিনি পছন্দ করেন এবং যা তিনি ঘৃণা করেন তা বিস্তারিত ও স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে তোমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। কাজেই তোমরা অন্য সকল পথ পরিহার করে শুধুমাত্র তাঁর পছন্দনীয় পথেই চলো। আল্লাহর রাসুল বলতেন, “অপ্রিয় বস্তু সামগ্ৰী জান্নাতকে পরিবেষ্টন করে আছে, অপরপক্ষে কামনাবাসনা জাহান্নামকে ঘিরে আছে।”
জেনে রাখো, আল্লাহর আনুগত্য বাহ্যিকভাবে নিরানন্দময় এবং আল্লাহর অবাধ্যতা বাহ্যিকভাবে আনন্দদায়ক ও উপভোগ্য। তার ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়, যে কামনা-বাসনা থেকে নিজেকে সম্বরণ করতে পেরেছে এবং তার হৃদয়ের ক্ষুধার (আকাঙ্খার) মূলোৎপাটন করতে পেরেছে। কারণ হৃদয়ের দূরদশী লক্ষ্য রয়েছে এবং এটা কামনা-বাসনার মাধ্যমে অবাধ্যতার দিকে ধাবিত হয়।
তোমরা আরো জেনে রাখো, হে আল্লাহর বান্দাগণ, একজন মোমিনের উচিত সকাল-সন্ধ্যায় তার হৃদয়কে অবিশ্বাস করা । হৃদয়ের দোষ-ত্রুটির জন্য নিন্দাবাদ করা তার উচিত এবং আমলে সালেহায় প্রবৃত্ত হবার জন্য হৃদয়কে সর্বদা শাসনে রাখা উচিত। যারা তোমাদের পূর্বে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে তাদের মতো আচরণ করা তোমাদের উচিত এবং তোমাদের সামনে যেসব নজির রয়েছে সেরূপ আচরণ করা তোমাদের উচিত। তারা পথিকের মতো এ পৃথিবী ত্যাগ করে চলে গেছে এবং দূরত্ব যেমন ঢাকা পড়ে যায়। এরাও তেমন ঢাকা পড়ে গেছে।
পবিত্র কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে
জেনে রাখো, এ কুরআন এমন উপদেশদাতা যে কখনো প্রতারণা করে না, এমন নেতা যে কখনো বিপথগামী করে না এবং এমন বর্ণনাকারী যে কখনো মিথ্যা কথা বলে না। যে কুরআন নিয়ে বসে সে উঠে যেতে দুটো জিনিস পেয়ে থাকে— একটা হলো হেদায়েত এবং অপরটা হলো আধ্যাত্মিক অন্ধত্ব বিমোচন। আরো জেনে রাখো, কুরআন থেকে হেদায়েত প্ৰাপ্তির পর কারো কোন কিছুর প্রয়োজন হবে না, আবার কুরআনের হেদায়েত প্রাপ্তির পূর্বে কেউ অভাবমুক্ত হয় না। সুতরাং তোমাদের অসুস্থতার জন্য কুরআন থেকে চিকিৎসা অন্বেষণ কর এবং বিপদে ও দুঃখ-দুৰ্দশায় এর কাছে সাহায্য প্রার্থনা কর। কুরআনে কঠিনতম রোগের চিকিৎসা রয়েছে, যেমন— কুফরি, মোনাফেকি, বিদ্রোহ ও গোমরাহি। এর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা কর এবং এর প্রতি ভালোবাসা সঞ্চার করে আল্লাহর দিকে মুখ ফিরাও । এর মাধ্যমে মানুষকে কিছু জিজ্ঞেস করো না। মহিমান্বিত আল্লাহর প্রতি মুখ ফেরাবার জন্য কুরআনের মতো আর কিছু নেই।
জেনে রাখো, কুরআন হলো মধ্যস্থতাকারী এবং এর মধ্যস্থতা গৃহীত হবে। এটা পরীক্ষিত সত্য বক্তা। কারণ বিচার দিনে কুরআন যার জন্যই মধ্যস্থতা করবে তার জন্য এর মধ্যস্থতা গৃহীত হবে। বিচার দিনে কুরআন যার জন্য খারাপ বলবে তার অবস্থা দুঃখজনক হবে। বিচার দিনে একজন নকিব ঘোষণা করবে, সাবধান, কুরআন বপনকারী ব্যতীত সকল বপনকারী বিপদগ্ৰস্থ। সুতরাং কুরআন বপনকারী ও এর অনুসরণকারী হওয়া তোমাদের একান্ত উচিত। আল্লাহর দিকে পথ নির্দেশক হিসাবে কুরআনকে গ্রহণ করা। তোমাদের নিজেদের জন্যই এর উপদেশ অনুসন্ধান কর। এর বিরুদ্ধে তোমাদের কোন অভিমতে আস্থা স্থাপন করো না এবং কুরআনের ব্যাপারে তোমাদের কামনা-বাসনাকে ছলনা মনে করো ।
মোমিন ও মোনাফিক সম্পর্কে
আমল কর! আমল কর। তারপর পরিণতির দিকে লক্ষ্য কর; লক্ষ্য কর এবং দৃঢ় থাক; আমলে দৃঢ় থাক। তারপর ধৈর্যধারণ কর; ধৈর্য এবং তাকওয়া কর; তাকওয়া । তোমাদের একটা উদ্দেশ্য আছে। সেই উদ্দেশ্যের দিকে অগ্রসর হও । তোমাদের একটা নিদর্শন আছে। সেই নিদর্শন থেকে হেদায়েত গ্ৰহণ কর। ইসলামের একটা উদ্দেশ্য আছে। এর উদ্দেশ্যের দিকে অগ্রসর হও । আল্লাহর হক আদায় কর এবং যা তিনি আদেশ করেছেন তা পালন করে তার দিকে অগ্রসর হও । তোমাদের ওপর তার দাবি তিনি স্পষ্ট করে বিবৃত করেছেন। আমি তোমাদের সাক্ষী এবং বিচার দিনে তোমাদের পক্ষে ওজর উত্থাপন করে ওকালতি করবো ।
সাবধান!! যা পূর্ব-নির্ধারিত ছিল তা ঘটেছে এবং ভাগ্যলিপিতে যা ছিল তা স্কুরিত হয়েছে। আল্লাহর প্রতিজ্ঞা ও ওয়াদার ভিত্তিতে আমি তোমাদের সাথে কথা বলছি। মহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ, নিশ্চয়ই যারা বলে আল্লাহ আমাদের রব, তারপর তাতে স্থির থাকে, তাদের ওপর ফেরেশতা নাজেল হয় এবং বলে (রব হতে বলা হয়) “ভীত হয়ো না, আক্ষেপ করো না। এবং জগন্নাতের সুসংবাদ গ্ৰহণ করা যার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।” (কুরআন-৪১ ? ৩) তোমরা বলেছে, “আল্লাহ আমাদের রব।” এখন তাঁর কিতাবের প্রতি, তার নির্দেশিত পথের প্রতি এবং তার ইবাদতের প্রতি সুদৃঢ় থাকো। তারপর কখনো এপথ থেকে সরে যেয়ো না; এতে কোন বিদা’তের উদ্ভাবন করো না এবং এর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। কারণ এ পথ থেকে যারা সরে যায় তারা বিচার দিনে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবে।
সাবধান, তোমাদের আচার-আচরণকে ধ্বংস ও পরিবর্তন থেকে রক্ষা করার জন্য এক কথায় থেকো। সর্বদা জিহবাকে নিয়ন্ত্রণে রেখো। কারণ জিহবা দুৰ্দমনীয়। আল্লাহর কসম, আল্লাহকে ভয় করে কোন লোক উপকৃত হতে পারে না যে পর্যন্ত না সে জিহবাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। নিশ্চয়ই, মোমিনের জিহবা তার হৃদয়ের পিছনে; আর মোনাফিকের হৃদয় তার জিহবার পিছনে। কারণ মোমিন যখন কিছু বলতে চায় তখন সে তা মনে মনে চিন্তা-ভাবনা করে বলে। যদি তার মনে হয় কোন কিছু ভালো তখন সে তা প্রকাশ করে; আর যদি মনে করে খারাপ তখন তা গোপন রাখে— প্রকাশ করে না। অপরপক্ষে, মোনাফিকের মুখে যা আসে তা-ই বলে ফেলে। কোনটা তার পক্ষে ও কোনটা বিপক্ষে এটা সে চিন্তাও করে না |
আল্লাহর রাসুল (সঃ) বলেছেনঃ হৃদয় সুদৃঢ় না হওয়া পর্যন্ত কারো ইমান দৃঢ় হয় না এবং জিহ্বা সুদৃঢ় না হওয়া পর্যন্ত কারো হৃদয় দৃঢ় হয় না | সুতরাং তোমাদের মধ্যে কেউ যদি মুসলিমদের রক্ত ও সম্পদ দ্বারা হাত কলঙ্কিত না করে এবং তার জিহবা থেকে তাদেরকে নিরাপদ রেখে আল্লাহর সাক্ষাত লাভের ব্যবস্থা করতে পারে তবে সে যেন তা করে ।
সুন্নাহর অনুসরণ ও বিদা”ত পরিত্যাগ প্রসঙ্গে।
হারাম মনে করবে। নিশ্চয়ই, মানুষের উদ্ভাবিত বিদা’ত হালাল করা যাবে না। যা হারাম বলে ঘোষিত হয়েছে। বরং হালাল হলো তা যা আল্লাহ হালাল করেছেন এবং হারাম হলো তা যা আল্লাহ হারাম করেছেন। হালাল বিষয়গুলো তোমাদের দ্বারা পরীক্ষিত হয়েছে এবং তোমাদের পূর্ববতীগণ এসব বিষয় তোমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। তারা তোমাদেরকে বিবিধ উপমা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন এবং সুস্পষ্ট বিষয়ের দিকে তোমাদেরকে আহবান করেছেন। শুধুমাত্র বিধিরগণ এসব শুনতে পায় নি এবং অন্ধগণ দেখতে পায় নি। আল্লাহ যাকে পরীক্ষা ও উপমা থেকে উপকারিতা প্ৰদান করেন না সে উপদেশ থেকেও উপকার পায় না। সে সর্বদা ক্ষতির সম্মুখীন হবে, তাতে সে মন্দকে অনুমোদন করবে এবং ভালোকে অননুমোদন
করবে। মানুষ দুশ্রেণির—শরিয়তের অনুসারী এবং বিদা’তের অনুসারী যাদেরকে আল্লাহ সুন্নাহ বা কোন ওজরের আলোকে সনদ প্ৰদান করেন নি ।
কুরআন থেকে হেদায়েত সম্পর্কে মহিমান্বিত আল্লাহ এ কুরআনের দিক নির্দেশনা কারো সাথে পরামর্শ করে ঠিক করেন নি। কাজেই এটা আল্লাহর সুদৃঢ় রশি ও তাঁর বিশ্বস্ত পথ। এতে রয়েছে হৃদয়ের প্রস্ফুটন ও জ্ঞানের ঝরনাধারা। হৃদয়ের জন্য কুরআন ব্যতীত অন্য কোন দু্যতি নেই যদিও যারা এটা স্মরণ করতো তারা পরলোকগত এবং যারা এটা ভুলে গেছে বা ভুলে যাবার ভান করছে তারা বেঁচে আছে। যদি তোমরা ভালো কিছু দেখ। তবে তাকে সমর্থন করো এবং মন্দ কিছু দেখলে তা এড়িয়ে চলো। কারণ আল্লাহর রাসুল বলতেন, “হে আদম সন্তানগণ, ভালো কাজ কর এবং পাপ এড়িয়ে চল; এতে তোমরা সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত থাকবে।”
জেনে রাখো, অন্যায়-অবিচার তিন প্রকারের—(১) যে অন্যায়-অবিচারের কোন ক্ষমা নেই; (২) যে অন্যায়-অবিচার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হওয়া থেকে নিস্তার নেই; (৩) যে অন্যায়-অবিচার বিনা জিজ্ঞাসায় ক্ষমা করা হবে। আল্লাহর দ্বৈততা বা শিরক করার অন্যায় কখনো ক্ষমা করা হবে না। আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহ তাঁর শরিক করার অপরাধ ক্ষমা করেন না” (কুরআন-৪ ঃ ৪৮ ও ১১৬)। মানুষ মানুষের প্রতি যে অপরাধ করে তা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করা ছাড়া কাউকে ছাড়া হবে না এবং মানুষ নিজের প্রতি যেসব ক্ষুদ্ৰ পাপ করে তা জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই ক্ষমা করা হবে। যে সকল অপরাধ সম্পর্কে মানুষ জিজ্ঞাসিত হবে তার শাস্তি বড়ই কঠোর। এ শাস্তি ছুরিকাঘাত বা বেত্ৰাঘাত নয়। এটা এতই কঠোর যে বেত্ৰাঘাত বা ছুরিকাঘাত এর কাছে নিতান্ত তুচ্ছ। সুতরাং তোমরা আল্লাহর দ্বিনের পরিবর্তন এড়িয়ে চলো এবং সত্য ও ন্যায় বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হও যদিও এটা তোমাদের পছন্দনীয় নয় এবং অন্যায়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়া তোমাদের অধিক পছন্দনীয়। নিশ্চয়ই, মহিমান্বিত আল্লাহ, জীবিত বা মৃত কাউকেই সত্য বিষয়ে অনৈক্যের জন্য কোন কল্যাণ প্ৰদান করেন না ।
হে জনমন্ডলী, সেব্যক্তি সৌভাগ্যশালী যে নিজের দোষ-ত্রুটির কথা সর্বদা চিন্তা করে — অন্যের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়ানো থেকে নিজেকে বিরত রাখে। সেব্যক্তিও আশীৰ্বাদপুষ্ট যে নিজের ঘরে আবদ্ধ থাকে, নিজের খাবার খায়, আল্লাহর আনুগত্যে নিজকে নিমগ্ন রাখে এবং নিজের পাপের জন্য ক্ৰন্দন করে। এসব লোক নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং মানুষ তার থেকে নিরাপদ থাকে।