মদিনায় তার হাতে বায়াত গ্রহণের পর এ ভাষণ দেন।
আমি যা বলি তার দায় দায়িত্বের নিশ্চয়তা আমার এবং সে জন্য আমিই জবাবদিহি করবো। যার কাছে অতীতের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির (আল্লাহ্ কর্তৃক প্রদত্ত) অভিজ্ঞতা পরিস্কারভাবে প্রকাশ করা হয়ে থাকে, সন্দেহে পতিত হওয়া থেকে তাকওয়া তাকে বিরত রাখে। জেনে রাখো, রাসুলের (সঃ) আগমন কালে যেসব বিপদাপদ বিরাজমান ছিল সেসব আবার ফিরে এসেছে।
সেই আল্লাহর কসম, যিনি সত্যের সাথে রাসুলকে পাঠিয়েছেন, তোমরা মারাত্মকভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে, চালনি দিয়ে চালার মতো আলোড়িত হবে এবং রান্না করার পাত্রে চামচ দিয়ে মিশানোর মতো সম্পূর্ণরূপে মিশ্রিত হয়ে যাবে। কারণ তোমাদের নিচু শ্রেণির লোকেরা উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছে এবং উচ্চ শ্রেণির লোকেরা হতমান হয়ে পড়েছে, তোমাদের পিছনে-পড়া লোকেরা অগ্রগামী হয়েছে এবং অগ্রগামীকে পিছনে ফেলে রাখা হয়েছে। আল্লাহর কসম, আমি একটা শব্দও গোপন করি নি বা কোন মিথ্যা কথা বলি নি । এ ঘটনা এবং এ সময় সম্পর্কে আমাকে অবহিত করা হয়েছে। সাবধান, পাপ হলো অবাধ্য ঘোড়ার মতো। সেই ঘোড়ার ওপর ওদের আরোহীকে সওয়ার করিয়ে দেয়া হয়েছে এবং ওদের লাগামও ঢিলা করে দেয়া হয়েছে। সুতরাং সেই ঘোড়া আরোহীসহ দোযখে
ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মনে রেখো, তাকওয়া হলো অনুগত ঘোড়ার মতো। ওটার ওপর আরোহীকে সওয়ার করিয়ে দিয়ে লাগাম হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় যাতে আরোহীকে বেহেশতে নিয়ে যেতে পারে। পৃথিবীতে ন্যায় আছে, অন্যায়ও আছে এবং উভয়ের অনুসারীও আছে। যদি অন্যায় প্রাধান্য বিস্তার করে (অতীতে এমনই ছিল) এবং সত্য লাঞ্চিত হয় (যা প্রায়শই ঘটেছে) তাহলে মানুষ যথাযথ পথে অগ্রসর হতে পারে না। একবার পিছনে পড়ে গেলে, সামনে এগিয়ে আসতে পেরেছে এমন ঘটনা বিরল। যাদের চিন্তা-চেতনায় বেহেশত ও দোযখ দৃশ্যমান তাদের অন্য কোন লক্ষ্য থাকে না। যে ব্যক্তি
প্রচেষ্টা চালিয়ে যায় ও দ্রুত কর্মসাধন করে সে নাজাত পায় এবং যে ব্যক্তি সত্যের অনুসন্ধানকারী সে ধীর হলেও আল্লাহর অনুগ্রহের আশা পোষণ করতে পারে। আর যে ব্যক্তি কর্মসাধন করে না সে দোযখে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ডানে ও বামে বিভ্রান্তিকর পথ রয়েছে। শুধুমাত্র মধ্যবতী পথই যথার্থ যা রয়েছে চিরস্থায়ী গ্রন্থে ও রাসুলের তরিকায়। সে পথ থেকেই সুন্নাহ প্রসার লাভ করেছে এবং পরিণামে সে দিকেই প্রত্যাবর্তন। যে ব্যক্তি অন্য পথ অবলম্বন করে সে ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং যে মিথ্যা আরোপ করে সে হাতাশাগ্রস্থ । যে ব্যক্তি মুখে ন্যায়ের বিরোধিতা করে সে ধ্বংস হয়ে যায়। নিজেকে না জানাই একজন লোকের যথেষ্ট অজ্ঞতা। যার তাকওয়ার ভিত্তি শক্তিশালী’ সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় না এবং তাকওয়ার ভিত্তিতে করা চাষাবাদ কখনো পানিবিহীন থাকে না । তোমরা নিজেদেরকে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে ফেল এবং সংস্কার করা। অতীতের জন্য তওবা কর। নিজেকে তিরস্কার করে কেবলমাত্র আল্লাহর প্রশংসা কর।
১। তাকওয়া মানে হৃদয় ও মন আল্লাহর মহিমা ও মহত্ত্বে আপুত হওয়া, যার ফলে আল্লাহর ভয়ে মানুষের হৃদয় পরিপূর্ণ থাকে এবং এ অবস্থার অনিবার্য ফল হলো ইবাদতে নিমগ্নতা বৃদ্ধি পাওয়া। আল্লাহর ভয়ে হৃদয় পরিপূর্ণ থাকবে অথচ কাজে কর্মে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে না, এটা একেবারেই অসম্ভব। যেহেতু ইবাদত ও আনুগত্য হৃদয়কে সংস্কার করে ও চেতনাকে পরিশুদ্ধ করে সেহেতু ইবাদত বৃদ্ধি পেলে হৃদয়ের পবিত্রতাও বৃদ্ধি পায়। সে জন্যই পবিত্র কুরআনে তাকওয়া” দ্বারা কখনো ভয়, কখনো ইবাদত ও ধ্যান এবং কখনো হৃদয় ও চেতনার পবিত্রতা বুঝানো হয়েছে। যেমন
(১) আনা ফাত্তাকুন (সুতরাং আমাকে ভয় কর-১৬ঃ ২—এখানে তাকওয়া অর্থ ভয় করা)।
(২) ইত্তাকুল্লাহা হাক্কা তুকান্তিহি (আল্লাহর ইবাদত কর কারণ তিনিই ইবাদতের যোগ্য-৩ ঃ ১০২—— এখানে তাকওয়া অর্থ ইবাদত ও আরাধনা)। (৩) ওয়া ইয়াখশান্নাহা ওয়া ইত্তাকহি ফাউলায়েক হুমুল ফায়েজুন (২৪ ঃ ৫২— এখানে তাকওয়া দ্বারা চেতনার পবিত্রতা ও হৃদয়ের পরিচ্ছন্নতা বুঝানো হয়েছে)। হাদিস অনুযায়ী তাকওয়ার তিনটি স্তর রয়েছে। প্রথমত আদেশ পালন করতে হবে এবং নিষেধাজ্ঞা থেকে নিজকে দূরে রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত সুপারিশকৃত বিষয় অনুসরণ করতে হবে এবং অপছন্দকৃত বিষয় বাদ দিতে হবে। তৃতীয়ত সন্দেহযুক্ত বিষয় অনুমোদিত হলেও বাদ দিতে হবে। প্রথম স্তর সাধারণ মানুষের, দ্বিতীয় স্তর মহৎ ব্যক্তির এবং তৃতীয় স্তর উচ্চ-মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির জন্য।
আমিরুল মোমেনিন বলেন যে, তাকওয়া ভিত্তিক কর্ম স্থায়ী হয়। যে কর্মে তাকওয়ার জল সিঞ্চন করা হয় তা ফুলে ফলে সুশোভিত হয়, কারণ কেবলমাত্র আনুগত্যের অনুভূতি থাকলেই প্রকৃত ইবাদত হয়। অনুরূপভাবে জ্ঞানও দৃঢ় প্রত্যয় ভিত্তিক না হলে ইমান ভিতহীন ইমারতের মতে যার কোন স্থায়িত্ব নেই।