যখন জনগণ দলবদ্ধ হয়ে আমিরুল মোমেনিনের কাছে গিয়ে উসমানের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ জানিয়ে তাদের পক্ষ থেকে উসমানের সাথে কথা
বলার জন্য অনুরোধ করেছিল তখন তিনি উসমানের কাছে গিয়ে বললেনঃ
আমার পেছনে অনেক লোক রয়েছে যারা আপনার ও তাদের মধ্যে দূত হিসাবে আমাকে প্রেরণ করেছে। কিন্তু আল্লাহর কসম, আপনার কাছে কী বলতে হবে তা আমি জানি না। আপনি হয়ত জানেন না যে, এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না এবং যে ব্যাপারে আপনি অবহিত নন। সে ব্যাপারে আপনাকে দিক নির্দেশনাও দিতে পারি না। আমরা যা জানি নিশ্চয়ই তা আপনি অবগত আছেন। আমরা আপনার কাছ থেকে এমন কোন কিছু জানতে আসি নি যা আপনাকে জিজ্ঞেস করতে পারি। আমরা গোপনে কিছু জানতেও পারি নি যা আপনাকে জানিয়ে দিতে পারি। আপনি যা দেখেছেন আমরাও তা-ই দেখেছি; আপনি যা শুনেছেন আমরাও তাই শুনেছি। আল্লাহর রাসুলের সাহাবি হিসাবে আপনি তার কাছে বসেছিলেন যেমনটি আমরাও বসেছিলাম। ইবনে আবি কুহাফাহ (আবু বকর) ও ইবনে আল-খাত্তাব (উমর) ন্যায়-নিষ্ঠভাবে কাজ করার জন্য আপনার চেয়ে বেশি দায়িত্বপূর্ণ ছিল না। কারণ গোত্র বন্ধনে আপনি তাদের চেয়ে আল্লাহর রাসুলের নিকটতর এবং আপনি বৈবাহিক সূত্রেও তাঁর আত্মীয় যা তাদের নেই।
কাজেই, নিজের বাতেনে আল্লাহকে ভয় করুন। আল্লাহর কসম, আপনাকে অন্ধ মনে করে কোন কিছু দেখানো হচ্ছে না এবং অজ্ঞ মনে করে কোন কিছুর প্রশধ্বংসা বা মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। ইমানের পথ সুস্পষ্ট এবং এর ঝান্ডা সুনির্ধারিত। আপনার জানা দরকার যে, আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে পরিচালনা করেন। সুতরাং তিনি রাসুলের স্বীকৃত সুন্নাহর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকেন এবং বিদ্য’ত ধ্বংস করেন। (রাসুলের) পথ সুস্পষ্ট এবং তার নিদর্শনাবলী রয়েছে। অপরপক্ষে, বিদা’তও সুস্পষ্ট এবং তারও নিদর্শন আছে। নিশ্চয়ই, আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি হলো জুলুমবাজ ইমাম যে নিজে বিপথগামী হয়েছে এবং অন্যদেরকেও বিপথগামী করেছে। সে সহিহ সুন্নাহ ধ্বংস করে এবং বাতিল বিদা’ত পুনরুজীবিত করে। আমি আল্লাহর রাসুলকে বলতে শুনেছিলাম, “বিচার দিনে জুলুমবাজ ইমামকে কোন প্রকার সমর্থক ছাড়াই আনা হবে। তার পক্ষে ক্ষমা প্রার্থনা করারও কেউ থাকবে না। তখন তাকে দোযখে নিক্ষেপ করা হবে এবং সে আটা-চাক্কির মতো ঘুরতে ঘুরতে দোযখে পড়বে। তারপর সে একটা গর্তে আটক থাকবে ।”
আমি আল্লাহর নামে শপথ করে আপনাকে বলছি, আপনার এমন ইমাম হওয়া উচিত হবে না যাকে জনগণ হত্যা করবে। কারণ এটা বলা হয়েছে যে, “এসব লোকের একজন ইমামকে হত্যা করা হবে। এরপর থেকে বিচার দিন পর্যন্ত হত্যা ও যুদ্ধের পথ তাদের জন্য খোলা হয়ে যাবে এবং সে তাদের ব্যাপারে তালগােল পাকিয়ে তাদের ওপর আপদ ছড়িয়ে দেবে। ফলে তারা সত্যকে মিথ্যা থেকে পৃথক করতে পারবে না। তারা তরঙ্গের মতো দুলতে থাকবে এবং চরমভাবে বিপথে পরিচালিত হবে।” মারওয়ানের বাহন হিসাবে আচরণ করবেন না, যাতে সে আপনার জ্যেষ্ঠতা উপেক্ষা করে যে দিকে ইচ্ছা! আপনাকে টেনে নিয়ে যেতে পারে ।
এরপর উসমান আমিরুল মোমেনিনকে বললেন, “জনগণের দুঃখ-দুৰ্দশা উপশম করার পূর্ব পর্যন্ত আমাকে সময় দিতে তাদেরকে বলুন।” আমিরুল মোমেনিন বললেন, “মদিনার জনগণের বিষয়ে সময়ের প্রশ্ন ওঠে না। দূরবতী এলাকার জনগণের বিষয়ে আপনার আদেশ সেখানে পৌছানাে পর্যন্ত আপনি সময় পেতে পারেন।”
১। উসমানের খেলাফতকালে সরকার ও তার কর্মচারীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বিভিন্ন এলাকার জনগণ মদিনায় জড়ো হয়েছিল। তারা রাসুলের (সঃ) জ্যেষ্ঠ সাহাবিদের কাছে নালিশ জানানোর উদ্দেশ্যেই মন্দিনায় একত্রিত হয়েছিল। তারা শান্তিপূর্ণভাবে আমিরুল মোমেনিনের কাছে এসে তাকে অনুরোধ করেছিল যেন তিনি উসমানের কাছে যান এবং মুসলিমদের অধিকার পদদলিত করে তাদেরকে বিপদগ্ৰস্থ ও ধ্বংস করা থেকে নিবৃত্ত হওয়ার জন্য উসমানকে উপদেশ প্রদান করেন। এতে তিনি উসমানের কাছে গিয়ে উপযুক্ত বক্তব্য রাখেন।
আমিরুল মোমেনিন তাঁর উপদেশাবলীর তিক্ততা রুচিকর করার জন্য কিছুটা প্রশধ্বংসাসূচক বক্তব্যের পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। সেই কারণে রাসুলের সাহাবি হওয়া, ব্যক্তিগত মর্যাদা, রাসুলের আত্মীয় হওয়া, অন্য দুজন খলিফা অপেক্ষা দায়িত্বপূর্ণ হওয়া—এসব উক্তি করেছেন। যেহেতু বক্তৃতা থেকে বুঝা যায়। উসমান অন্যায় ও বিদা’তে লিপ্ত ছিল সেহেতু আমিরুল মোমেনিনের এসব উক্তির কারণ হলো উসমানকে তার কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্বন্ধে সজাগ করে দেয়া—এটা নিছক প্রশধ্বংসাত্মক নয়। উপরন্তু এটা দৌত্য কর্মের একটা কৌশলও বটে। প্রথম থেকেই উসমান যা করেছিলেন তা তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই করেছিলেন। তার অজানা কিছু ছিল না এবং তাকে না। জানিয়ে কোন কিছুই করা হয় নি। সেই কারণে তাকে জবাবদিহি করতে হবে না— একথা বলা যায় না। তিনি এমন এক পথ অবলম্বন করেছিলেন যা সমগ্র ইসলামিক বিশ্বে হৈ চৈ সৃষ্টি করেছিলো। এসব কর্মকান্ড নিশ্চয়ই সুন্নাহ বিরোধী ছিল। কোন লোক যদি রাস্তার চড়াই-উতরাই না জানে এবং সে রাতের অন্ধকারে হোচট খায়। তবে তাকে ততটুকু দোষারোপ করা যায় না যতটুকু দোষারোপ করা যায় সেই ব্যক্তিকে যে রাস্তার চড়াই-উতরাই জানা সত্ত্বেও দিনের আলোতে হোচট খায়। সেক্ষেত্রে দিনের আলোতে হোচট খাওয়া লোকটিকে যদি কেউ বলে যে, আপনার চোখ দুটোর দৃষ্টিশক্তি খুবই ভালো, আপনি একজন সুস্থ-সবল যুবক তাহলে যেমন লোকটির ধ্বংসা করা হয় না, আমিরুল মোমেনিনের উক্তিও তেমনি প্রশধ্বংসাত্মক নয়—প্ৰকারান্তরে বিদ্ৰপাত্মক । সচরাচর রাসুলের (সঃ) জামাতা হিসাবে উসমানের বিশেষ মর্যাদা তুলে ধরা হয়। রাসুল (সঃ) তাঁর কন্যা রুকাইয়া ও উম্মে কুলসুমকে একের পর এক উসমানের নিকট বিয়ে দিয়েছিলেন। সেজন্য কোন কোন অতি উৎসাহী লেখক উসমানকে ‘জুন্নেরাইন’ (দুই নূরের মালিক) উপাধিতেও ভূষিত করেছে। প্রকৃতপক্ষে উসমানের এ দুটি বিয়ের ফলে তিনি কোন বিশিষ্টতা লাভ করেছিলেন। কিনা তা ইতিহাসের আলোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা দরকার। ইতিহাসে দেখা যায় রুকাইয়া ও উম্মে কুলসুমের প্রথম স্বামী উসমান নন। নবুয়ত প্রকাশের পূর্বে আবু লাহাবের পুত্ৰ উৎবাহর সাথে রুকাইয়ার ও উতায়বাহর সাথে উন্মে কুলসুমের বিয়ে হয়েছিল। ইতিহাসে বা রাসুলের জীবনে এ কন্যা দু’টির এমন কোন গুরুত্ব নেই, যেজন্য এদের বিয়ে করার কারণে কেউ বিশেষ কোন মর্যাদার অধিকারী হতে পারে। নবুয়ত প্রকাশের পূর্বে যেহেতু মোশরেকের সাথে কন্যা বিয়ে দেয়া অবৈধ ছিল না। সেহেতু নবুয়ত প্রকাশের পর উসমানের সাথে এদের বিয়ে দেয়া তার ইসলাম গ্রহণের প্রমাণ বহন করে। অবশ্য এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, উসমান কালিমা শাহাদত উচ্চারণ করে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তদুপরি রুকাইয়া ও উন্মে কুলসুম রাসুলের (সঃ) ঔরসজাত কন্যা নয় বলেও ইতিহাসে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। কেউ কেউ লেখেছেন। এরা খাদিজার ভগ্নি হালাহর কন্যা আবার কেউ কেউ লেখেছেন। এরা খাদিজার প্রাক্তন
স্বামীর ঔরসজাত কন্যা। কুকী“” (পূঃ ৬৯) লেখেছেন ঃ আল্লাহর রাসুল (সঃ) খাদিজাকে বিয়ে করার কিছু দিন পর খাদিজার ভগ্নি হালাহ্ দুটি কন্যা সন্তান রেখে মারা যায় । তাদের একজনের নাম জয়নব ও অন্য জনের নাম রুকাইয়া এবং এরা উভয়েই রাসুল (সঃ) ও খাদিজা কর্তৃক তাঁদের গৃহে লালিত-পালিত হয় । প্রাক-ইসলামী যুগে প্রথা ছিল যে, কেউ কোন সন্তান লালন-পালন করলে তার নামেই সেই সন্তানের পরিচিতি হবে / হযরত খাদিজার সন্তান সম্বন্ধে হিশাম” (৪র্থ খন্ড, পৃঃ ২৯৩) লেখেছেনঃ রাসুলের (সঃ) সাথে বিয়ে হবার আগে আবি হালাহ ইবনে মালিক নামক এক ব্যক্তির সাথে খাদিজার বিয়ে হয়েছিল এবং তার ঔরসে খাদিজা দুটি সন্তান প্রসব করেছিলেন । তাদের একজনের নাম হিন্দ ইবনে আবি হালাহ ও অপরজন জয়নব বিনতে আবি হালাহ / আবি হালাহর সাথে বিয়ে হবার আগেও উতােয়ইক ইবনে আবিদ ইবনে আবদিল্লাহ ইবনে আমর ইবনে মাখজুম নামক আরেক ব্যক্তির সাথে খাদিজার বিয়ে হয়েছিল এবং তার ঔরসে তিনি আবদুল্লাহ নামক একটা পুত্ৰ সন্তান ও একটা কন্যা সন্তান প্রসব করেছিলেন ।
এতে দেখা যায় যে, রাসুলের (সঃ) সাথে বিয়ে হবার আগেও হজরত খাদিজার দুটি কন্যা সন্তান ছিল।
পিতৃহীন এ কন্যাদ্বয় যেহেতু রাসুলের (সঃ) ও খাদিজার ঘরে লালিত-পালিত সেহেতু এদেরকে সকলেই রাসুলের
কন্যা বলে জানতো এবং যাদের কাছে এদের বিয়ে দেয়া হয়েছিল তাদেরকে রাসুলের জামাতা মনে করতো।
রাসুলের (সঃ) জামাতা হিসাবে উসমানকে বিশেষ মর্যাদা দেয়ার আগে বুখারী ও অন্যান্য হাদিসবেত্তা এবং
ঐতিহাসিকদের বর্ণিত একটি হাদিসের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা দরকার। হাদিসটি নিম্নরূপঃ আনাস ইবনে মালিক বর্ণনা করেন, “রাসুলের কন্যা উন্মে কুলসুমের দাফন অনুষ্ঠানে আমরা উপস্থিত ছিলাম / রাসুল (সঃ) কবরের পাশেই বসেছিলেন । আমি দেখলাম তাঁর চোখ দিয়ে। আশ্রম গাড়িয়ে পড়ছিলো । হঠাৎ তিনি বললেন, “তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে যে গতরাতে পাপ করে নি? আবু তালহা (জায়েদ ইবনে শহল আল-আনসারী) বললো, “আমি আছি । * তখন রাসুল (সাঃ) বললেন, “তা হলে তুমি কবরে নামো ।” ফলে সে কবরে
নেমেছিলো ।”
টীকাকারগণের প্রায় সকলেই “পাপ করা” শব্দটি দ্বারা রাসুল (সঃ) যৌন ক্রিয়া বুঝিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছে। একথা বলে রাসুল (সঃ) উসমানের ব্যক্তিগত জীবন উন্মোচন করতে এবং তাকে কবরে নামা হতে বারিত করতে চেয়েছেন। অবশ্য কারো ব্যক্তিগত জীবন প্রকাশ্যে বলে কাউকে হেয় করা রাসুলের নীতি বিরুদ্ধ ছিল এবং অনেকের অনেক দোষ-ত্রুটি জানা সত্ত্বেও তিনি তা উপেক্ষা করতেন। কিন্তু এক্ষেত্রে উসমানের আচরণ এত নোংরা ছিল যে, উহা জনসমক্ষে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করেছিলেন। যেহেতু উসমান তার স্ত্রী উম্মে কুলসুমের মৃত্যুর প্রতি কোন প্রকার সম্মান প্রদর্শন করে নি, শোক প্রকাশ করে নি এবং রাসুলের সাথে তার আত্মীয়তার রশি ছিন্ন হবার জন্য দুঃখ প্রকাশ না করে রাসুলের কন্যার মৃত লাশ ঘরে রেখে অন্য স্ত্রীর সাথে সহবাস করেছিল। সেহেতু তার এহেন নোংরা স্বভাব প্রকাশ করে দেয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এবং কবরে নামা থেকে বঞ্চিত করে জামাতা হবার অধিকার ও সম্মান থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়েছিল (বুখারী”২, ২য় খন্ড, পৃঃ ১০০-১০১ ও ১১৪; হাম্বল”, ৩য় খন্ড, পৃঃ ১২৬, ২২৮, ২২৯ ও ২৭০; নায়সাবুরী”, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৪৭; শাফেয়ী***, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৫৩; সাদ”, ৮ম খন্ড, পৃঃ ২৬; সুহায়লী***, ২য় খন্ড, পৃঃ ১০৭; হাজর***, ৪র্থ খন্ড, পৃ. ৪৮৯; আসকালানী’, ৩য় খন্ড পৃঃ ১২২; হানাফী’, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৮৫; আইট্র’, ৩য় খন্ড, পৃঃ ২৭৬ মনুজুর”, ৯ম খন্ড, পৃঃ ২৮০-২৮১; জাবিন্দী’, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃঃ ২২০)।