২৭৬। কেউ একজন দ্বিনের সংজ্ঞা বলার জন্য আমিরুল মোমেনিনকে অনুরোধ করলে তিনি বললেনঃ আগামীকাল আমার কাছে এসো যাতে আমি অন্যসকল লোকের উপস্থিতিতে তোমাকে বুঝিয়ে দিতে পারি। এতে আমি যা বলব তা তুমি ভুলে গেলেও অন্যদের মনে থাকতে পারে। কারণ উপদেশ হচ্ছে পলায়নরত শিকারের মতো। একজন তা হারালেও অন্য কেউ তা ধরতে সক্ষম হতে পারে । (উক্ত লোকটিকে যে উপদেশ দেয়া হয়েছিল তা ৩১ নং বাণীতে উল্লিখিত হয়েছে)
২৭৭। হে আদম সন্তানগণ, যেদিন এখনো আসে নি সেদিনের জন্য আজকের দিনে উদ্বিগ্ন হয়ে না। কারণ সে দিনটি যদি তোমার জীবনে আসে। তবে আল্লাহ সেদিনের জীবিকাও তোমার জন্য দান করবেন।
২৭৮। বন্ধুকে একটা সীমা অবধি ভালোবেসো, কারণ সে যেকোন সময় শত্রু হয়ে যেতে পারে। আবার শত্রুকে একটা সীমা অবধি ঘূণা করো, কারণ যে কোন সময় সে তোমার বন্ধু হয়ে যেতে পারে।
২৭৯। এ পৃথিবীতে দুপ্রকারের কমী আছে। এক প্রকার হলো তারা যারা শুধু দুনিয়ার জন্য কাজ করে আখেরাতের কথা বেমালুম ভুলে থাকে। সে যাদেরকে ফেলে যাবে তাদের দুঃখ-কষ্টের বিষয়ে সে সর্বদা ভীত থাকে। সুতরাং সে অন্যের সুখ শান্তির কাজে নিজের জীবন কাটায়; আরেক প্রকার হলো তারা যারা এ পৃথিবীতে পরকালের জন্য কাজ করে যায়। এসব লোক দুনিয়াতে বিনা প্রচেষ্টায় তাদের হিস্যা পেয়ে থাকে। ফলে তারা ইহকাল ও পরকাল উভয়টার সুবিধা ভোগ করতে পারে এবং উভয় ঘরের মালিক হয়ে পড়ে। এসব লোক আল্লাহর দরবারে সম্মানের অধিকারী হয়। যদি সে আল্লাহর কাছে কিছু চায়। তবে বিফল মনোরথ হয় না।
২৮০। বর্ণিত আছে যে, উমর ইবনে খাত্তাবের খেলাফতকালে কাবার উদৃত্ত অলঙ্কারের বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছিল এবং কেউ কেউ প্রস্তাব করেছিল “এসব অলঙ্কার দিয়ে কাবারী কী হবে? তার চাইতে সেগুলো দিয়ে একটা মুসলিম বাহিনী গঠন করলে ভালো হতো।” এ যুক্তি উমরের পছন্দ হলো । তবুও তিনি বিষয়টি সম্পর্কে আমিরুল মোমেনিনকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, “যখন কুরআন নাজেল হয়েছিল তখন চার প্রকারের সম্পদ ছিল। এক, মুসলিম ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি যা সে নির্দিষ্ট হারে উত্তরাধিকারীদেরকে বন্টন করে দিতো। দুই, কর (ফায়) যারা প্রাপ্য ছিল তাদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হতো। তিন, এক-পঞ্চমাংশ (খুমস) খাজনা যা বন্টনের পথ আল্লাহ নিজেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। চার, দান-খয়রাত (সন্দকা) যার বন্টন আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এ আদেশাবলী নাজেলের সময় কাবার অলঙ্কারগুলো সেখানে ছিল এবং আল্লাহ সেগুলোকে সেভাবেই রেখেছেন। আল্লাহ ভুল বশত বা অজানার কারণে সেগুলোকে সেখানে রাখেন নি। সুতরাং আল্লাহ ও তার রাসুল সেগুলোকে যেখানে রেখেছেন তুমিও তা সেখানে থাকতে দাও।” আমিরুল মোমেনিনের কথা শুনে উমর বললেন, “আপনি না থাকলে নিশ্চয়ই আমরা অবমানিত হতাম।” তিনি অলঙ্কারগুলো যেভাবে ছিল সেভাবে রেখে দিলেন।”
১ । প্রথম তিন খলিফার মধ্যে উমর ইবনে খাত্তাব কঠিন সমস্যা সমাধান করতে না পারলে আমিরুল মোমেনিনের পরামর্শ চাইতেন এবং তাঁর অগাধ জ্ঞান থেকে উপকৃত হতেন। কিন্তু আবু বকর তার খেলাফতের স্বল্প সময়ের কারণে এবং উসমান তার কৃপ্রবৃত্তিসম্পন্ন চেলা-চামুন্ডার কারণে আমিরুল মামোমেনিনের উপদেশ গ্রহণ করে কদাচিত উপকৃত হয়েছে।
আমিরুল মোমেনিন সম্পর্কে উমর নিজেই বলতেন, “আলী হলেন আমদের মধ্যে সব চাইতে জ্ঞানী—
বিশেষ করে জুয়িসপ্রত্নডেন্স ও বিচারকার্যে” (বুখারী***, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃঃ ২৩; হাম্বল***, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ১১৩;
নায়সাবুরী’, পৃঃ ৩০৫; সাদ’, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১০২; বার”, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ১১০২)। আমিরুল মোমেনিনের জ্ঞানের উচ্চমাৰ্গ সম্পর্কে উমর বা অন্য কারো সাক্ষ গ্রহণের প্রয়োজন হয় না। কারণ উমর ও অন্যান্য অনেকেই এতদসংক্রান্ত বিষয়ে রাসুলের (সঃ) অনেক বাণী বৰ্ণনা করেছেন। রাসুল (সঃ) বলেছেন, – আমার উন্মাহর মধ্যে আলী জুরিস প্রসিডেন্স ও ন্যায়বিচারে সব চাইতে জ্ঞান সম্পন্ন (ওয়াকী’, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৭৮, শাকী’, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২০৩: বার’, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১৬
১৭. শাফী, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ১১০২. শাফকী, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১০৮ মাজাহ) । এ বিষয়ে আহমাদ ইবনে হাম্বল আবু হাজিম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, কোন ব্যক্তি মুয়াবিয়ার কাছে গিয়ে ধর্ম বিষয়ে তাকে ক’টি প্রশ্ন করেছিল। উত্তরে মুয়াবিয়া বললো, “এসব প্রশ্ন আলীকে জিজ্ঞেস করো। তিনি এসব বিষয়ে অধিক জ্ঞানের অধিকারী।” লোকটি বললো, “আমি আলী অপেক্ষা আপনার কাছ থেকে উত্তর পেতে অধিক আগ্রহী।” মুয়াবিয়া তাকে ধমক দিয়ে বললো, তোমার কাছ থেকে যত কথা শোনলাম তার মধ্যে একথাটা নিকৃষ্টতম। তোমার এহেন উক্তিতে এমন এক ব্যক্তির প্রতি তুমি অবজ্ঞার মনোভাব দেখালে যাকে আল্লাহর রাসুল নিজে শিক্ষাদান করেছেন যেমন করে পাখী তার শাবকের মুখে একটার পর একটা খাদ্য দানা পুরে দেয়। আল্লাহর রাসুল বলেছেনঃ মুসার কাছে হারুণ যেমন ছিল আমার কাছে আলীও তেমন: শুধু ব্যবধান হলো, এটা সুনিশ্চিত যে, আমার পরে আর কোন নবি থাকবে না।
তারপর মুয়াবিয়া বললেন তুমি কি জানতে না যে, উমর কঠিন সমস্যার সমাধানের জন্য আলীর কাছে যেতেন। (শাফী, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ৪৬; শাফী, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৯৫;)। উমর অনেক সময় বলতেনঃ আলী ইবেন আবি তালিবের মতো আরেক জনকে গর্ভে ধারণ ও প্রসব করার ক্ষমতা নারীকুলের কারো নেই । আলী না থাকলে উমর ধ্বংস হয়ে যেতো (কুতীয়বা”, ১ম বার’, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ১১০৩; শাফী’২৪ হানাকী’, পৃঃ ৩৯. কুন্দুজী“” পৃঃ ৭৫, ৩৭৩ শাকী’, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ৩৫৬) অনেক বিশ্বস্ত সূত্র থেকে বর্ণিত আছে যে, উমর বলতেনঃ যে সব সমস্যা সমাধানে আবুল হাসান (আলী) উপস্থিত থাকতেন না তার সমাধানে আমি আল্লাহর আশ্রয় ও সাহায্য প্রার্থনা করতাম । (বার’, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ১১০২, ১১০৩; সাদ’, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১০২; হাম্বলী, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১২১: আহীর’, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ২২-২৩৫ হাজর, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৫০৯; কাহীর’, ৭ম খণ্ড, পৃঃ ৩৬০) আহবান করতেনঃ হে আবুল হাসান, আমি সেই সমাজ ব্যবস্থা থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করি, যে সমাজে আপনি নেই (নায়সাবুরী, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৪৫৭-৪৫৮ রাজী’, ৩২ তম খন্ড, পৃঃ ১৯৭; হায়তামী, পৃঃ ১০৭, শাকী’, ৩য় খণ্ড পৃঃ ৪৬) । এসব উক্তি ছাড়াও উমর ইবনে খাত্তাব, আবু সায়েদ খুদরী ও মুআজ ইবনে জাবাল থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুল (সঃ) বলেছেনঃ হে আলী আমি সকল গুণে তোমাকে অতিক্রম করেছি; এবং তুমি মহৎগুণে সকলকে অতিক্রম করেছে। তুমি হলে— (১) প্রথম ব্যক্তি যে আল্লাহতে ইমান এনেছে, (২) আল্লাহর কাছে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির সর্বোত্তম পালনকারী (৩) আল্লাহর আদেশ-নিষেধ সর্বোত্তম পালনকারী (৪) জনগণের মধ্যে সর্বোত্তম সুষম বন্টনকারী: (৫) সর্বোত্তম ন্যায়বিচারকারী এবং মুসলিমদের মধ্যে সব চাইতে বিনম্র ও বিনয়ী; (৬) মতবিরোধ সম্বলিত বিষয়ে গভীর অন্তদৃষ্টি সম্পন্ন সর্বোত্তম ব্যক্তি; (৭) ধর্ম বিষয়ে সর্বোত্তম চিত্তাকর্ষক ব্যক্তি এবং আল্লাহর দরবারে সর্বোত্তম সন্মানিত ব্যক্তি:(ইসফাহানী”, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৬৫-৬৬, শাকী’, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৯৮; হানাফী, পৃঃ ৬১: হিন্দি’, ১২শ খণ্ড, পৃঃ ২১৪: হাদীদ’, ১৩শ খণ্ড) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুল (সঃ) খাতুনে জান্নাত ফাতিমাকে বলেছেনঃ তুমি কি সন্তুষ্ট নও? নিশ্চয়ই, আমার উন্মাহর মধ্যে যে সব চাইতে অগ্রণী তার সাথে তোমার বিয়ে দিয়েছি। সে ইমানে, জ্ঞানে আর বিনম্রতায় অগ্রণী ও সর্বোত্তম (হাম্বল’, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ২৬ সানানী”, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ৪৯০; বার’, ৩য় খণ্ড , পৃঃ ১০৯৯; আন্থীর’, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ৫২০: হিন্দি’, ১২শ খণ্ড, পৃঃ ২০৫, ১৫শ খণ্ড, পৃঃ ৯৯; শাকী’, ৯ম খণ্ড, পৃঃ ১০১, ১১৪. শাফী, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২৮৫)
২৮১। বর্ণিত আছে যে, দুব্যক্তিকে আমিরুল মোমেনিনের কাছে আনা হয়েছিল। তারা উভয়েই সরকারি সম্পদ চুরি করেছিল। তাদের একজন সরকারি অর্থে ক্রীতদাস এবং অপরজন কোন এক ব্যক্তির ব্যক্তিগত অর্থে ক্রীতদাস। আমিরুল মোমেনিন বললেন, “সরকারি অর্থে যে ক্রীতদাস তার জন্য কোন শাস্তি নেই; কারণ, আল্লাহর এক সম্পদ আরেক সম্পদ নিয়েছে। কিন্তু অপরজনকে বিধি অনুযায়ী শাস্তি দিতে হবে।” ফলে ব্যক্তিগত ক্রীতদাসটির হাত কেটে ফেলা হয়েছিল।
২৮২। এ পিচ্ছিল পথে (খেলাফত)। যদি আমি দৃঢ় পদে দাঁড়াতে পারি। তবে আমাকে অনেক কিছু পরিবর্তন করতে হবে।”
১। একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, রাসুলের (সঃ) পরে কিছু সংখ্যক লোক নিজেদের অনুমান ও খামখেয়ালিপনার ভিত্তিতে আমল করতে গিয়ে শরিয়তের আদেশ-নিষেধ অমান্য করে দ্বিনে অনেক বিদাত ও বিকৃতির উদ্ভব ঘটায়। অথচ কুরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট আদেশ অমান্য করে নিজের কল্পনা প্রসূত আমল দ্বারা শরিয়তের পরিবর্তন ও বিকৃতি ঘটানোর কোন অধিকার কারো নেই। কুরআনে বিধৃত আছে যে, দুবার তালাক দেয়ার পরও অন্য কোন লোকের কাছে বিয়ে না। দিয়ে স্ত্রীর সাথে পুনরায় দাম্পত্য জীবন যাপন করা যায় (কুরআন-২ঃ ২২৯)। কিন্তু খলিফা উমর আদেশ করলেন তিনবার তালাক একই সময়ে বলতে হবে। একইভাবে তিনি উত্তরাধিকারে ‘আউল’ এর সূত্রপাত করেন এবং জানাজায় চার তকবিরের সূচনা করেন। খলিফা উসমান জুমার সালাতে আজান যোগ করলেন, কসর সালাতের পরিবর্তে পূর্ণ সালাতের আদেশ প্রদান করেন এবং ঈদ সালাতের পূর্বে খুৎবা যোগ করে দেন। বস্তৃত এহেন শত শত বিদা’ত, পরিবর্তন ও বিকৃতি এমনভাবে প্রকৃত বিধানের সাথে মিশে গেছে যে, আসল আদেশ-নিষেধ এর মাঝে হারিয়ে গেছে। এ বিষয়ে অধিক জানার জন্য শায়েখ আবুল হুসাইন আমিনি’ বিরচিত আল গাদির গ্রন্থের ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃঃ ৮৩-৩২৫ (উমার কর্তৃক পরিবর্তন); ৭ম খণ্ড, পৃঃ ৭৪-২৩৬ (আবু বকর কর্তৃক পরিবর্তন), ৮ম খণ্ড, পৃঃ ৯৮-২৩৬ (উসমান কর্তৃক পরিবর্তন) এবং সায়েদ আবুল হুসাইন শরাফুদিন’ বিরচিত আন-নাস ওয়াল ইজতিহাদ গ্রন্থের পৃঃ ৭৬-১৫৪ (আবু বকরের পরিবর্তন); পূঃ ১৫৫-২৭৬ (উমরের পরিবর্তন); পৃঃ ২৭৭-২৮৯ (উসমানের পরিবর্তন) এবং সৈয়দ মুরতাজা আসকারী’ বিরচিত মুকাদ্দামা মির আতুল উকুল ১ম ও ২য় খণ্ড দ্রষ্টব্য। ”
আমিরুল মোমেনিন সঠিক শরিয়তের ধারক ও বাহক হিসাবে সাহাবাদের বিদাতের প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু সরকারি ক্ষমতার ছত্রছায়ায় এসব বিদা’ত প্রচলিত হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে ইবনে আবিল হাদীদ লেখেছেন, আমাদের অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, আমিরুল মোমেনিন শরিয়াতের ওপর সুদৃঢ় ছিলেন এবং অন্যান্য সাহাবাদের বিকৃতির ওপর অনেক ভিন্ন মত পোষণ করতেন (হাদীদ’, ১৯তম খণ্ড, পৃঃ ১৬১)
যখন আমিরুল মোমেনিন খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন তখন সবদিক থেকে বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তিনি এসব বিদ্রোহীদের জ্বালাতন থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। ফলে উদ্ভূত বিদা”তগুলোর তিনি মুলোৎপাটন করতে পারেন নি। এতে কেন্দ্র থেকে দূর দূরান্তরের অঞ্চলগুলোতে বিদা’ত ক্রমেই বেড়ে গেল। বিশেষ করে মুয়াবিয়ার শরিয়তের অজ্ঞতা এবং তার সুবিধার জন্য সে অসংখ্য বিদা’তের সূচনা ও প্রচলন করেছিল। তাসত্ত্বেও আমিরুল মোমেনিনের কতিপয় অনুচর শরিয়তের আদেশ-নিষেধ আমিরুল মোমেনিনের কাছ থেকে জেনে নিয়ে লেখে রেখেছিলেন বলে প্রকৃত বিষয়গুলি একেবারে হারিয়ে যায় নি এবং বাতিল বিষয়াবলী সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় নি।
২৮৩। দৃঢ় প্রত্যয় সহকারে জেনে রাখো, অদৃষ্টলিপিতে যা লেখা আছে তার অধিক জীবিকা আল্লাহ নির্ধারণ করেন না। যতই উপায় অবলম্বন করা হোক, যতই কঠোর প্রচেষ্টা করা হোক। আর যতই কসরত করা হোক না কেন নির্ধারিত জীবিকার বেশি পাবে না। কোন লোকের দুর্বল অবস্থা বা উপায়-উপকরণের অভাব নির্ধারিত জীবিকার পথে অন্তরায় হতে পারে না। যারা এটা অনুধাবন করে এবং সে মতে আমল করে তারাই সব চাইতে আরাম-আয়োশে থাকে; আর যারা এতে সন্দেহ পোষণ করে এবং এর প্রতি অবহেলা করে তারা সকলের চেয়ে বেশি অসুবিধা ভোগ করে। আনুকূল্য প্রাপ্ত ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে আনুকূল্যের মাধ্যমে শান্তির দিকে তাড়িত করা হচ্ছে এবং শাস্তি প্রাপ্ত ব্যক্তিকে শাস্তির মাধ্যমে কল্যাণ করা হচ্ছে। সুতরাং হে শ্রোতৃমণ্ডলী, তোমাদের কৃতজ্ঞতা বর্ধিত কর, লোভ-লালসা কমিয়ে ফেল এবং তোমাদের জীবিকার সীমার মধ্যে তৃপ্ত থাক ।
২৮৪ । তোমাদের জ্ঞানকে অজ্ঞতায় এবং দৃঢ় প্রত্যয়কে সংশয়ে পরিণত করো না। জ্ঞান, লাভ করলে তদনুযায়ী আমল কর এবং দৃঢ় প্রত্যয় অর্জিত হলে তার ওপর ভিত্তি করে অগ্রসর হও।
২৮৫। লোভ মানুষকে জলাশয়ের কাছে টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু পানি পান করানো ছাড়াই আবার টেনে ফেরত নিয়ে আসে। লোভ দায়িত্ব গ্রহণ করে কিন্তু তা পরিপূর্ণ করে না। লোভাতুর ব্যক্তি তৃষ্ণা মেটার আগেই অনেক সময় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ে। কোন কিছু পাবার আকুল আকাঙ্খা যত বেশি হবে তা না পেলে দুঃখও তত বেশি হবে। লোভ-লালসা বোধগম্যতার চক্ষু অন্ধ করে দেয়। যা ভাগ্যে নির্ধারিত আছে তা না চাইলেও পৌছে যাবে।
২৮৬। হে আমার আল্লাহ, আমি তোমার কাছে সেই অবস্থা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি, যে অবস্থায় মানুষ বাহ্যিকভাবে আমাকে ভালো বলে দেখবে অথচ আমার বাতেন তোমার দরবারে পাপপূর্ণ থাকবে। আমি সেই অবস্থা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি, যে অবস্থায় একজন রিয়াকার হিসাবে লোক দেখানোর জন্য পাপ থেকে নিজকে মুক্ত রাখার কাজ করি। অথচ আমার বাতেন সম্পর্কে তুমিই ভালো জান। সেই অবস্থা থেকে আশ্রয় চাই যাতে মানুষের কাছে ভালো সেজে থাকি আর তোমার কাছে সব পাপ প্রকাশ পায় এবং এতে করে তোমার বান্দাদের নৈকট্য লাভ করি। অথচ তোমার সন্তুষ্টি থেকে দূরে সরে থাকি।
২৮৭। আমি তার শপথ করে বলছি, যিনি আমাদেরকে রাতের অন্ধকারের পর দিনের আলোতে অতিক্রম করতে দেন, যে অমুক অমুক” বিষয় ঘটেনি।
১। আশ-শরীফ আর-রাজী বিষয়গুলো কী তা উল্লেখ না করে চিরতরে গোপন রেখে গেছেন যা আজ আর জানা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
২৮৮ । নিয়মিত পালিত ক্ষুদ্র আমল বিরাগপূর্ণ দীর্ঘ আমল থেকে অনেক ভালো ও উপকারী।
২৮৯ । যখন ঐচ্ছিক বিষয়াদি অবশ্যকরণীয় বিষয়ের বাধা হয়ে দাড়ায় তখন তা পরিত্যাগ করো।
২৯০ । যে কেউ ভ্রমণের দূরত্ব সম্পর্কে সজাগ হয় সে প্রস্তুত থাকে।
২৯১ ৷ চোখের প্রত্যক্ষণ প্রকৃত পর্যবেক্ষণ নয় কারণ চোখ অনেক সময় ধোকা দেয়; কিন্তু জ্ঞান যাকে পরামর্শ দেয় তাকে প্রতারণা করে না।
২৯২। সদোপদেশ আর তোমাদের মাঝখানে একটা প্রবঞ্চনার পর্দা রয়েছে।
২৯৩ । তোমাদের মধ্যকার অজ্ঞগণ অনেক বেশি পায় আবার শিক্ষিতগণও বঞ্চিত হয় ।
২৯৪ । যারা ওজর দেখায় জ্ঞান তাদের ওজরকে দূরীভূত করে।
২৯৫। কারো মৃত্যুবৎ অবস্থা হলে সে কেবল সময় চায়, কিন্তু মৃত্যু সরে গেলে ভালো কাজ স্থগিত রাখার নানা ওজর দেখায় ।
২৯৬ । মানুষ যত কিছুতে বলে, “কতই না ভালো।’ তার সব কিছুতেই মন্দ নিহিত আছে।
২৯৭। কেউ একজন অদৃষ্ট সম্পর্কে আমিরুল মোমেনিনকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, “এটা অন্ধকারাচ্ছন্ন পথ, এদিকে পা বাড়িয়ে না; এটা গভীর সমুদ্র— এতে ডুব দিয়ে না; এটা আল্লাহর বিষয়—এটা জানতে অযথা চেষ্টা করো না।”
২৯৮ । আল্লাহ যখন কাউকে অবমানিত করতে চান তখন তার কাছ থেকে জ্ঞান তুলে নিয়ে যান।
২৯৯। আমার একজন ইমানি ভাই’ ছিলেন। আমার দৃষ্টিতে তিনি সম্মানী ব্যক্তি ছিলেন, কারণ তার কাছে দুনিয়া ছিল খুব হীন, তার পেটের তাড়না তাকে নিয়ন্ত্রণ করে নি, সে যা পায় নি তার জন্য কোন লালসা করে নি, সে যা পেত তার অধিক যাচনা করে নি; বেশির ভাগ সময় সে নিচুপ থাকতো, যদি সে কথা বলতো তবে অন্যদের নিচুপ করে দিত, সে প্রশ্নকারীদের তৃষ্ণা মিটিয়ে দিত, সে দুর্বল ও কৃশকা য়ছিল। কিন্তু জেহাদে সে সিংহের মত ছিল, সিদ্ধান্তমূলক ছাড়া সে কোন যুক্তি দেখাতো না। ক্ষমাযোগ্য কোন বিষয়ে ওজর না শুনে সে কখনো কাউকে গালি দিত না, বিপদ চলে যাবার পূর্ব পর্যন্ত কাউকে কোন বিপদের কথা বলতো না, সে যা করতে পারতো তাই বলতো, যা করতে পারতো না তা বলতো না, এমনকি কথার চেয়ে বেশি সে নিচুপ থাকতো, কথার চেয়ে নীরবতা রক্ষা করাতে তার বেশি আগ্রহ ছিল, দুটি জিনিস তার কাছে এলে সে পরখ করে দেখতো কোনটির প্রতি তার হৃদয়ে লালসা বেশি।— তখনই সে তা পরিত্যাগ করতো। এসব গুণাবলী অর্জন করা তোমাদের দরকার। সুতরাং তোমরা এগুলোতে একে অপরকে অতিক্রম করার চেষ্টা করবে। এমনকি এগুলোর সব ক’টি অর্জন করতে না পারলেও আংশিক অর্জন সম্পূর্ণটুকু পরিত্যাগ অপেক্ষা অনেক ভালো।
১ । এ বাণীতে ত আমিরুল মোমেনিন যে ব্যক্তির গুণাবলীর কথা উল্লেখ করেছেন তার নাম সম্পর্কে টীকাকার গণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে । কেউ কেউ মনে করেন। তিনি হলেন আবুমিকদাল ইবনে আসওয়াদ আল-কিন্দি । এমনও হতে পারে যে, আমিরুল মোমেনিন ইমানি ভ্রাতা বলতে কাউকেই বুঝান নি, কারণ আরবি বাচন ভঙ্গীতে আরবগণ ভাই অথবা সাখী বলে। কথা বলতো যদিও তাতে কোন ব্যক্তি বিশেষকে বুঝানো হতো না ।
৩০০। আল্লাহ যদি শাস্তির জন্য সতর্ক নাও করতেন তবুও তার নেয়ামতের জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও তাঁর অনুগত হওয়া অবশ্যকর্তব্য হতো।