আজ ১০ই মহরম , আশুরা —
৬১ হিজরীর আজকের এই দিনের সকাল বেলা থেকে –
এতক্ষনে কারবালার মরুপ্রান্তরে কলেমা পড়নেওয়ালা একদল নরপিশাচ হায়নার দল একে একে ৭২ জনকে প্রকাশ্য দিবালোকে প্রচন্ড উল্লাস সহকারে জবাই করে হত্যা শুরু করে দিয়েছে ।
যাদেরকে জবাই করে হত্যা করা হচ্ছে তাদেরকে তিনদিন পূর্ব থেকে অর্থাৎ ৭ই মহরম থেকে এক ফোঁটা পানি দেয়া হয় নি । নিষ্ঠুর , নির্মম হত্যার স্বীকার হওয়া কাফেলার মধ্যে নারী শিশু বৃদ্ব যুবক সহ সর্বসাকুল্যে ১৪০ জনের মত সদস্য ছিলেন ।
আর যাইহোক , এ কাফেলাটি কিন্ত কোন প্রকার যুদ্ব করার জন্য মক্কা থেকে রওয়ানা হয় নি । কেননা যুদ্বক্ষেত্রে কেউ নিজের পরিবার পরিজন , ভাই , বোন , স্ত্রী এমনকি ছয় মাসের দুধের শিশুকে নিয়ে আসে না ।
কাফেলাটির সর্বশেষ গন্তব্যস্থল ছিল ইরাকের কুফা নগরী । কিন্ত পথিমধ্যে রাস্তা অবরোধ করে তাদেরকে কারবালা নামক স্থানে এনে চর্তুদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলা হয় ।
তাদেরকে না পেছনে না সামনে অগ্রসর হতে দেওয়া হয় নি । ১লা মহরম থেকে ঘরাও করে রাখা হয় । ৯ই মহরম পর্যন্ত তাদেরকে চুড়ান্ত ভাবে দুটি শর্ত দেয়া হয় ।
হয় ঈয়াযীদের বাইআত গ্রহন কর নতুবা মৃত্যু । এর মাঝামাঝি কোন পথ নেই ।
এহেন পরিস্থিতিতে কাফেলাটির দলনেতা সাহসী কন্ঠে ঘোষন দিলেন যে , ঈয়াযীদের মত নিকৃষ্ট লোকের হাতে আমার মত ব্যক্তির বাইআত করার কোন প্রশ্নই নেই ।
অতএব , শাহাদাত গ্রহন করাই সর্বউত্তম ।
ফলশ্রুতিতে হায়নার দল ৭ মহরম থেকে পানি সরবরাহ সম্পূর্ন বন্ধ করে দেয় ।
কাফেলার তাবুগুলোতে বাচ্চাদের “হায় পিপাসা হায় পানি ” বলে আর্ত চীৎকার শুরু হল । এমনকি পানি ছাড়া খাবার জন্য রান্নাও বন্ধ হয়ে গেল । পানিবিহীন মরুভূমির প্রচন্ড গরমে মায়েদের বকের দুধও শুকিয়ে গেল । দুধের শিশুদের কান্না হায়নাদের মনে কোন রেখাপাত করল না ।
এই রকম কঠিন অবস্থার মধ্যে ১০ই মহরম সকাল বেলা থেকে শুরু হল প্রকাশ্য জবাই করা । পৈচাশিক এই হত্যাযজ্ঞ থেকে ছয় মাসের শিশুটিও রক্ষা পেল না । শিশুটির অপরাধ ছিল একটিই যে , শিশুটির পিতা শুধুমাত্র শিশুটির জীবন রক্ষার্থে দুফোঁটা জল চেয়েছিলেন । পানির বদলে শিশুটির গলায় ত্রিধারা তীর মেরে হত্যা কর হয় । এভাবে পর্যায়ক্রমে এক একজনকে জবাই করা হয় । শুধু হত্যা করেই ক্ষ্যান্ত হয় নি । লাশগুলোর উপর দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে দেওয়া হয় ।
এক সময় আছরের ওয়াক্ত চলে আসে ।
কারবালার মরু প্রান্তরে সকাল থেকে মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে একে একে ৭১ জনের লাশ বহন করে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে যাওয়া ৫৭ বছরের বৃদ্ব দলনেতা বড়ই একা হয়ে পড়লেন । কিছুক্ষন পূর্বেই দলনেতার কোমর ভেংগে গেছে মাওলা আব্বাস (আঃ) করুন মৃত্যুতে ।
নরপিশাচগুলোর চোখে মাওলা আব্বাস (আঃ) এর অপরাধ ছিল একটিই যে , তাবুতে থাকা শিশুদের জন্য কিছু পানি আনতে গিয়েছিলেন ফুরাতের নদীতে । এরজন্য তাঁর দুহাত কেটে শরীর থেকে বিছিন্ন করে দেয়া হয় । এক পর্যায় কপালের মাঝ বরাবর বিষাক্ত তীর ছুড়ে হত্যা করা হয় । এছাড়া চর্তুদিক থেকে অজস্র্র বর্শার আঘাত তো ছিলই ।
এবারে ওদের চোখ পড়ল ৫৭ বছরের বৃদ্ব দলনেতাটির প্রতি ।
মাত্র একজন বৃদ্ব লোকটির জন্য চর্তুদিক ঘিরে ছিল ৩০০০০ হাজারের মত বিশাল জল্লাদের বাহিনী । ওদের সাথে এই বৃদ্ব লোকটির সহায় সম্পত্তি , টাকা পয়সার লেনদেনগত কোন প্রকার ঝামেলা বা শত্রুতা ছিল না ।
জল্লাদ বাহিনীকে উদ্দেশ্য করে বৃদ্ব লোকটির একটি প্রশ্নেরও সঠিক জবাব তারা দিতে পারল না ।
তাহলে কেন তারা বৃদ্ব লোকটিকে হত্যা করার জন্য এতটা উদগ্রীব ছিল ! ওদের চোখে বৃদ্ব লোকটির অপরাধ ছিল একটিই যে , বৃদ্ব লোকটি তাঁর আপন নানা হযরত মুহাম্মাাদ (সাঃ) এর রেখে যাওয়া দ্বীন ইসলামকে বাঁচাতে এসেছিলেন ।
সর্বশক্তিমান আল্লাহ কতৃক মনোনীত ও নির্বাচিত ধর্ম ইসলামকে রক্ষা করার জন্য বৃদ্ব ব্যক্তিটি ১০ই মহরম সকাল বেলা থেকে একে একে নিজের অতি প্রিয় সাহাবী , ভাতিজা , ভাগ্নে , নিজের যুবক পুত্র , নিজের ছয়মাসের দুধের শিশুকে পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় কুরবানী করে দিলেন ।
এরপরে অবশিষ্ট রইল শুধু নিজের জীবনটা ।
আছরের নামাজে সেজদা করা অবস্থায় নরপিশাচের দল বৃদ্বের গলাটি জবাই করে শরীর থেকে সম্পূর্ন বিছিন্ন করে ফেলে । এরপরে বৃদ্ব দলনেতার মাথাবিহীন শরীরটির উপর কমপক্ষে দশটি ঘোড়া দিয়ে এমনভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয় যে , পাঁজরের হাড়গুলি একটিও অক্ষত অবস্থায় থাকে নি । ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে , মাথাটা যখন শরীর থেকে বিছিন্ন করা হয় তখন কমপক্ষে তিনশর উপরে তীর তাঁর পুরো শরীরে বিদ্ব অবস্থায় ছিল ।
অবস্থা এমন পর্যায় ছিল যে , ঘোড়ার উপর থেকে যখন তিনি মাটির উপর পড়ে গেলেন তখন শরীরটা মাটির স্পর্শ পায়নি শরীরে বিঁধে থাকা অজস্র্র তীরের জন্য । শরীর আর মাটির সাথে পার্থক্য করে রেখেছিল শরীরে বিঁধে থাকা অজস্র্র তীরগুলো । ঐ অবস্থায় জালেমের দল বুকের উপর বসে গলায় বিষাক্ত ছুরি চালিয়ে মাথাটি বিছিন্ন করে ফেলেছিল ।
এরপরে সন্ধা নামার সাথে সাথে শুরু হল আরেক পৈশচিক কান্ড ।
বেঁচে থাকা অসহায় দূর্বল অবশিষ্ট নারী শিশুদের তাবুগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে লুটপাট শুরু হল । ইমাম হোসেন (আঃ) এর ছোট্ট মেয়ে সকিনা (সাঃআঃ) এর গালে চড় মেরে কানে থাকা ছোট্ট দুলটি কান থেকে ছিড়ে নেওয়া হয় ।
পরের দিন ভোরবেলা চরম অসুস্থ ইমাম জয়নুল আবেদীন (আঃ) সহ নবীপরিবারের অন্যান্য নারী ও শিশুদের হাতে পায়ে কোমরে শিকল দিয়ে বেঁধে হেটে নিয়ে যাওয় হয় ঈয়াযীদের শামের দরবারে ।
কারবালা থেকে শাম বহু দূরের পথ । দীর্ঘ এই পথে নবীপরিবারকে একটি মুহূর্তর জন্য শিকলমুক্তো করা হয় নি । উটের পিঠেও উঠতে দেয়া হয় নি । এতটা পথ সম্পূর্ন খালি পায়ে শিকল পড়িয়ে চাবুক মারতে মারতে টেনে হিঁচড়ে নেওয়া হয় । এমনকি শিশুরা কিছু পানি চাইলে চাবুকের নির্মম আঘাত দেয়া হয় ।
পাঠক ,
এতক্ষন যে পরিবারটির নিদারুন কষ্টের ইতিহাস বললাম – এই ঘটনার প্রায় ৬০ বছর পূর্বেই এই পরিবারটির জন্য স্বয়ং আল্লাহ নীচের আয়াতটি নাজিল করেছিলেন ।
“ – বল , আমি এর জন্য তোমাদের কাছে কোন পুরস্কার চাই না , শুধু আমার রক্তজ বংশধরদের প্রতি গভীর ভালবাসা ছাড়া – “ ।
সুরা – শুরা / ২৩ ।
এই পরিবারটি সম্পর্কে –
পবিত্র কোরআন এটাও সাক্ষ্য দেয় যে , নবীজী (সাঃ) এর পবিত্র আহলে বাইত (আঃ) গনকে সম্পূর্নরুপে পুতঃপবিত্র বলে ঘোষনা করা হয়েছে ।
পবিত্র কোরআন এটাও সাক্ষ্য দেয় যে , নবীজী (সাঃ) এর পবিত্র আহলে বাইত (আঃ) গনকে ভালবাসতে ও সম্মাান করার জন্য বিশেষভাবে আদেশ দেওয়া হয়েছে ।
পবিত্র কোরআন এটাও সাক্ষ্য দেয় যে , নবীজী (সাঃ) এর পবিত্র আহলে বাইত (আঃ) গনকে উলিল আমর বলে ঘোষনা দেওয়া হয়েছে ।
পবিত্র কোরআন এটাও সাক্ষ্য দেয় যে , নবীজী (সাঃ) এর পবিত্র আহলে বাইত (আঃ) গনকে অনুসরন এবং আনুগত্য করার জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছে ।
পবিত্র কোরআন এটাও সাক্ষ্য দেয় যে , নবীজী (সাঃ) এর পবিত্র আহলে বাইত (আঃ) গনকে “কিতাবে মুবিন” বলে ঘোষনা দেওয়া হয়েছে ।
পবিত্র কোরআন এটাও সাক্ষ্য দেয় যে , নবীজী (সাঃ) এর পবিত্র আহলে বাইত (আঃ) গনকে “আহলাল যিকর” বলে ঘোষনা দেওয়া হয়েছে ।
পবিত্র কোরআন এটাও সাক্ষ্য দেয় যে , নবীজী (সাঃ) এর পবিত্র আহলে বাইত (আঃ) গনকে আল্লাহর “নাফস” বলে ঘোষনা দেওয়া হয়েছে ।
সেই সাথে এটাও সর্বজন স্বীকৃত যে , প্রতি নামাজে নবীজী (সাঃ) এর পবিত্র আহলে বাইত (আঃ) গনের উপর দরুদ ও সালাম না পাঠালে ঐ নামাজ সম্পূর্ন বাতিল বলে গন্য হয় ।
আল্লাহ স্বয়ং নিজে রাসুল (সাঃ) এর পবিত্র আহলে বাইত (আঃ) গনকে সমগ্র সৃষ্টিজগতে সর্বাপেক্ষা মর্যাদা ও গুরুত্ব দিয়েছেন ।
সেই নবীজী (সাঃ) এর প্রিয় নাতি ইমাম হোসেন (আঃ) কে তাঁর ছয় মাসের শিশু সহ ৭২ জনকে তিন দিনের পিপাসিত অবস্থায় কারবালার মরু প্রান্তরে প্রকাশ্য দিবালোকে মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে জবাই করে হত্যা করা হল ।
পাঠক ,
আপনি শুনে অবাক হবেন যে , এই পরিবারটির দুঃখ কষ্টের কথা স্মরন করে দুফোঁটা চোখের জল ফেলাকেও অনেক মুসলমান বেদআত বলে ফতোয়া দেয় !
সত্যিই মন ভাল নেই আজ —
SKL