রাসুলের (সঃ) ইনতিকালের অব্যবহিত পরে বনি সাঈদাহর সকিফাহ”-এ সংঘটিত ঘটনা প্রবাহের সংবাদ আমিরুল মোমেনিনকে অবহিত করা হলে তিনি জানতে চেয়েছিলেন যে, আনসারগণ কী বলেছিল। লোকেরা বললো যে, তারা দাবি করেছিল। একজন প্রধান তাদের মধ্য থেকে এবং আরেকজন প্রধান অন্যদের মধ্য থেকে নিয়োগ করতে । তখন আমিরুল মোমেনিন বলেনঃ তোমরা কেন রাসুলের অছিয়াত সম্পর্কে বললে না যে, আনসারদের মধ্যে যারা ভালো লোক তাদের প্রতি উত্তম ব্যবহার করবে; আর যারা মন্দলোক তাদেরকে সব সময় ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে। লোকেরা বললোঃ রাসুলের এ অছিয়তের মধ্যে তাদের দাবির বিরুদ্ধে কী আছে ? থাকার প্রয়োজন ছিল না।” তারপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কুরাইশগণ কী জবাব দিল”? লোকেরা বললোঃ তারা যুক্তি দেখালো যে, তারা রাসুলের সাজারার (বংশধর) অন্তর্ভুক্ত। আমিরুল মোমেনিন বললেনঃ তারা সাজোরার যুক্তি দেখিয়েছে অথচ এর ফল বিনষ্ট করে ফেলেছে।
১। বনি সাইদার সকিফাতে যা ঘটেছিল তাতে মনে হয় আনসারদের বিরুদ্ধে মুহাজিরদের বলিষ্ঠ যুক্তি ছিল যে, তারা রাসুলের (সঃ) আত্মীয়স্বজন। সুতরাং তারা ছাড়া আর কেউ খেলাফত পেতে পারে না। তাদের এ যুক্তিই ছিল তাদের কৃতকার্য হবার মূল ভিত্তি। এ যুক্তির ভিত্তিতে আনসারদের বিরাট জনতা তাদের অস্ত্র তিনজন মুহাজিরের সামনে সমর্পণ করেছিল এবং মুহাজিরগণ রাসুলের বংশধর হবার বৈশিষ্ট্য দেখিয়েই খেলাফত লাভ করেছিল। সকিফার ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে তাবারী* লেখেছেন যে, যখন আনসারগণ সা’দ ইবনে উবাদার হাতে বায়াত গ্রহণের জন্য বনি সাঈদীর সকিফায় একত্রিত হলো তখন আবু বকর, উমর ও আবু উবায়দাহ ইবনে আলজাররাহ যেকোন ভাবে টের পেয়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছিল। উমর দাঁড়িয়ে কিছু বলতে গেলে আবু বকর তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই বলতে লাগলোঃ মুহাজিরগণ হলো তারা যারা সর্বাগ্রে। আল্লাহর ইবাদত করেছিল এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ইমান এনেছিল এবং তারাই রাসুলের বন্ধু-বান্ধব ও আত্নীয়-স্বজন । এ কারণে শুধু তারাই খেলাফতেরা যোগ্য । যারা তাদের সাথে দ্বন্দু করবে। তারাই সীমা লঙ্ঘনকারী আবু বকরের বক্তব্য শেষ হলে হুবাব ইবনে মুনযির দাঁড়িয়ে আনসারদের লক্ষ্য করে বললো, “হে আনসারগণ! তোমাদের হাতের লাগাম অন্যের হাতে তুলে দিয়ে না। জনসাধারণ তোমাদের তত্ত্বাবধানে। তোমরা সম্মানে, সম্পদে, গোত্রে ও সংখ্যায় কম নও। যদি কোন বিষয়ে তোমাদের ওপর মুহাজিরদের প্রাধান্য থেকে থাকে তবে অন্য অনেক বিষয়ে তাদের ওপরও তোমাদের প্রধান্য আছে। তোমরা তাদেরকে নিজের ঘরে আশ্রয় দিয়েছে। যুদ্ধে তোমরাই ইসলামের বাহুবল এবং তোমাদের সহায়তায় ইসলাম নিজ পায়ে দাঁড়িয়েছে। মুক্তভাবে আল্লাহর ইবাদত তোমাদের শহরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। নিজেদের মধ্যে বিভেদ করো না এবং নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে চেষ্টা করো। যদি মুহাজিরগণ তোমাদের অধিকার স্বীকার না করে তবে তাদের বলে দাও আমাদের মধ্য থেকে একজন ও তাদের মধ্য থেকে একজন প্রধান নিয়োগ করতে হবে” । হুবাব কথা শেষ করে বসে পড়তেই উমর দাঁড়িয়ে বললোঃ এটা যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না যে, একই সময়ে দুজন শাসক থাকবে । আল্লাহর কসম, তোমাদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপ্রধান মনোনয়ন আরবগণ কখনো মেনে নেবে না, কারণ রাসুলের আবির্ভাব তোমাদের মধ্য থেকে হয় নি । নিশ্চয়ই, আরবগণ এ যুক্তির খোড়াই পরোয়া করবে: যে, খেলাফত সে ঘরেই যাবে যে ঘরে রাসুল চির নিদ্রায় শায়িত | তোমাদের মধ্যে যদি কেউ ভিন্নমত পোষণ করে তবে সে সুস্পষ্ট ও স্বচ্ছ যুক্তি উত্থাপন করতে পারে । মুহাম্মদের (সঃ) কর্তৃত্ব ও শাসনকার্য সম্পর্কে যে কেউ আমাদের সাথে বিরোধ করবে। সে ভ্রাক্তিতে নিপতিত হবে এবং পাপী বলে গণ্য হবে; ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। উমরের কথা শেষ হতেই হুবাব আবার দাঁড়িয়ে বললোঃ হে আনসারগণ, তোমাদের দাবিতে তোমরা স্থির থোক । এ লোকটি এবং তার সমর্থকদের কথায় কর্ণপাত করো না। তারা তোমাদের আধিকারকে পদদলিত করতে চায় । যদি তারা তোমাদের আধিকার মেনে না নেয়। তবে তোমাদের শহর থেকে তাদেরকে বের করে দাও এবং তোমরা খেলাফত প্রতিষ্ঠা করো। খেলাফতের হকদার তোমাদের চেয়ে আর বেশি কে আছে? হুবাবের কথা শেষ হলে উমর তাকে গালাগালি শুরু করে দিল। হুবাবের পক্ষ থেকেও মন্দ শব্দ প্রয়োগ করতে লাগলো। এতে অবস্থার অবনতি লক্ষ্য করে আবু উবায়দাহ ইবনে জাররাহ অবস্থা ঠান্ডা করার জন্য বললোঃ হে আনসার ভ্রাতাগণ, তোমরাই তো তারা যারা সর্বোপায়ে আমাদের সাহায্য করেছিলে সমর্থন দিয়েছিলো এখন কেন তোমরা তোমাদের সে মনোভাব ও আচরণ পরিবর্তন করছো | আবু উবায়দার বক্তব্যের পরও আনসারগণ তাদের মত পরিবর্তন করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলো। তারা সা’দের হাতে বায়াত গ্রহণ করতে যাচ্ছিলো, এমন সময় সা’দের গোত্রের বশির ইবনে আমার আল-খাযরাজী দাঁড়িয়ে বললোঃ এতে
কোন সন্দেহ নেই যে, আমরা দ্বিনকে সমর্থনা করেছিলাম এবং জিহাদে এগিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু এতে আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা এবং তাঁর রাসুলকে মান্য করা । এতে আমাদের শ্ৰেষ্ঠত্ব দাবি করে খেলাফতের ব্যাপারে গোলযোগ সৃষ্টি করা উচিত হবে না । মুহাম্মদ ছিলেন। কুরাইশ বংশের সেহেতু খেলাফতে তাদের অধিকার সমধিক এবং খেলাফতের জন্য তারাই অধিক যোগ্য। বশিরের বক্তব্য শেষ হতে না হতেই আনসারদের মধ্যে বিভেদ দেখা দিল এবং এটাই ছিল বশিরের উদ্দেশ্য, কারণ সে তার গোত্রের একজনকে এত উচ্চ মর্যাদায় দেখা সহ্য করতে পারে নি। মুহাজেরগণ এ সুযোগে আবু বকরের হাতে বায়াত গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথমেই বশির, তারপর উমর ও তৎপর আবু উবায়দাহ আবু
বকরের হাতে হাত রেখে বায়াত গ্রহণ করেছিল। এরপর বশিরের গোত্রের সকলেই বায়াত গ্ৰহণ করলো । এ সময় আমিরুল মোমেনিন রাসুলের (সঃ) কাফন ও দাফনে ব্যস্ত ছিলেন। পরে যখন তিনি সকিফার ঘটনা
শুনলেন তখন বললেন যে, তারা রাসুলের বংশধারার (সাজোরা) যুক্তি দেখিয়ে আনসারদের দাবির মুখে জয়লাভ করেছে। অথচ তারা সে গাছের ফল নষ্ট করেছে। অর্থাৎ রাসুলের আহলুল বাইতকে (পরিবারের সদস্য) বঞ্চিত করেছে। মুহাজিরগণ সাজোরার দাবিতে প্রবল, কিন্তু কী করে তারা সে সাজারার ফলকে উপেক্ষা করলো? এটা এক অদ্ভুত ব্যাপার যে, আবু বকর সাত স্তর এবং উমর নয় স্তর উপরে গিয়ে রাসুলের সাজারায় (লিনিয়্যাল ট্রী) যুক্ত হয়ে তাঁর পরিবারভুক্ত হবার কথা ব্যক্ত করেছে অথচ তারা রাসুলের আপনি চাচাতো ভাইকে অস্বীকার করেছে।