বসরায় সংঘটিত গুরত্বপূর্ণ ঘটনাবলী সম্পর্কে হে আহনাফ, আমি যেন দেখতে পাচ্ছি, সে একদল সৈন্যসহ এগিয়ে আসছে এবং তাতে কোন ধুলি উড়ছে না, কোন শব্দ হচ্ছে না, লাগামের মর্মর ধ্বনি হচ্ছে না বা ঘোড়ার হেষারব হচ্ছে না। তারা মাটিকে পদদলিত করছে, পাগুলো যেন উট পাখীর পা। (আমিরুল মোমেনিন সাহিবুজ জানাজ’ অর্থাৎ নিগ্রো নেতার প্রতি ইঙ্গিত দিলেন—শরীফ রাজী)। তারপর তিনি বললেনঃ বসরার বসতিপূর্ণ রাস্তার লোকসকল এবং শকুনের পাখার মতো পক্ষযুক্ত ও হাতির শুড়যুক্ত সুসজ্জিত বাড়ীর লোক সকল, তোমাদের ওপর ল্যানত। তারা এমন লোক যাদের মধ্য থেকে কেউ নিহত হলে তার জন্য শোক করার কেউ নেই অথবা কেউ হারিয়ে গেলে তাকে খোজার কেউ নেই। আমি দুনিয়াকে তার মুখের ওপর উল্টিয়ে দিয়েছি (উপুড় করে ফেলা), সর্বনিম্ন মূল্যে তাকে মূল্যায়ন করি এবং এমন চোখে তার দিকে তাকাই যা তার উপযুক্ত।
আমি এমন লোককেই দেখি যাদের মুখমন্ডল বর্মের অমসৃণ চামড়ার মতে। তারা সিল্ক ও পশমি পোষাক পরিধান করে এবং সুন্দর সুন্দর ঘোড়ায় চড়ে। তারা এমন হত্যাযজ্ঞ ও রক্তপাত ঘটাবে যে, আহতরা লাশের ওপর দিয়ে হেঁটে যাবে এবং বন্দী অপেক্ষা পলাতকের সসংখ্যা কম হবে। বনি কালবের একজন লোক (আমিরুল মোমেনিনের সাথি) বললো, “হে আমিরুল মোমেনিন, আপনি আমাদেরকে গুপ্ত বিষয়ের জ্ঞান দান করেছেন।” এ কথা শুনে আমিরুল মোমেনিন হেসে উঠে বললেনঃ হে কালবের ভ্রাতা, এটা ইলমুল গায়েব (গুপ্ত জ্ঞান) নয়; এসব বিষয় তার কাছ থেকে অর্জন করেছি যিনি (রাসুল) এ বিষয় জানতেন। ইলমুল গায়েব অর্থ হলো বিচার দিনের জ্ঞান এবং নিম্নের আয়াতের আওতায় যেসব বিষয় আল্লাহ গুপ্ত রেখেছেনঃ কিয়ামতের জ্ঞান কেবল আল্লাহর কাছে রয়েছে, তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তিনি জানেন যা জরায়ুতে আছে । কেউ জানে না। আগামীকাল সে কী অর্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন স্থানে তার মৃত্যু ঘটবে । আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, সর্ব বিষয়ে অবহিত (ֆs/GIF-օծ5\98) | সুতরাং গর্ভাশয়ে যা আছে—পুরুষ কী নারী, সুন্দর কী কুৎসিত, দয়ালু কী কৃপণ, দুৰ্বত্ত কী ধাৰ্মিক, দোযখের জ্বালানি কী বেহেশতে রাসুলের অনুচর। এসব কিছু শুধু আল্লাহই জ্ঞাত আছেন। এটাই ইলমুল গায়েব যা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। এসব ছাড়া যে জ্ঞান আল্লাহ তাঁর রাসুলকে দান করেছিলেন তা তিনি আমাকে দান করেছেন এবং আমার জন্য দোয়া করে বলেছেন যে, আমার বক্ষে যেন তা থাকে ও আমার পাজরা যেন তা ধারণ করতে পারে।
১। সাহিবুজ জানুজ (নিগ্রো নেতা) বলতে যে লোকটির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে সে হলো আলী ইবনে মুহাম্মদ। সে রায়ের উপকণ্ঠে ওয়ার জানিন নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলো এবং সে খারিজিদের আজারিকাহ সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। সে নিজেকে রাসুলের বংশধর বলে দাবি করেছিলো এবং তার বংশ পরিচয় এভাবে প্রকাশ করেছিলো যে, আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আহমদ মুখতাফি ইবনে ইসা ইবনে জায়েদ ইবনে আলী ইবনে হুসায়েন ইবনে আলী ইবনে আবি তালিব। কিন্তু সাজােরাহ বিশেষজ্ঞগণ ও জীবনীলেখকগণ তার এ দাবি নাকচ করে দিয়েছে। তারা তার পিতার নাম মুহাম্মদ ইবনে আবদার রহমান বলে উল্লেখ করেছে। তার পিতা ছিল আবদাল কায়েস গোত্রের এবং সে (আলী ইবনে মুহাম্মদ) একজন সিন্ধি ক্রীতদাসীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিল।
আলী ইবনে মুহাম্মদ ২৫৫ হিজরি সনে মুহতাদি বিল্লাহর রাজত্বকালে বসরা আক্রমণ করেছিলো। সে বসরার উপকণ্ঠের জনগণকে অর্থ, সম্পদ ও মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজের দলে ভিড়িয়ে বসরা আক্রমণ করেছিলো। ২৫৫ হিজরি সনের ১৭ শাওয়াল সে বসরায় প্রবেশ করেছিলো। বসরায় যে হত্যাযজ্ঞ সে ঘটিয়েছিলো তাতে দুদিনে ত্ৰিশ হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হয়েছিল। সে ঘরবাড়ি ভেঙ্গে দিয়েছিলো, মসজিদ জ্বলিয়ে দিয়েছিলো এবং চৌদ্দ বছর হত্যা, লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ২৭০ হিজরি সনের সফর মাসে নিহত হলে জনগণ ধ্বংসযজ্ঞ থেকে মুক্তি পায়। সে সময় মুয়াফফাক বিল্লাহর রাজত্বকাল ছিল। আমিরুল মোমেনিনের এ ভবিষ্যদ্বাণী অন্যান্য ভবিষ্যদ্বাণীর ন্যায় অজানা বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করেছিল। আলী ইবনে মুহাম্মদের সৈন্য বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী একটা ঐতিহাসিক সত্য। ইতিহাসবেত্তা তাবারী লিখেছেন যে, এ লোকটি যখন বিদ্রোহ করার উদ্দেশ্যে কারখ নামক স্থানে পৌছে তখন এ স্থানের লোকেরা তাকে অভ্যর্থনা জানায়। এক লোক তাকে একটা ঘোড়া উপহার দেয়। ঘোড়াটির লাগাম পর্যন্ত ছিল না। সেই ঘোড়ায় চড়ার জন্য সে দড়ি ব্যবহার করেছিল। একইভাবে তার দলে মাত্র তিনখানা তরবারি ছিল। একখানা আলী ইবনে আবান আল-মুহাল্লাবির, একখানা মুহাম্মদ ইবনে সালমের এবং একখানা তার নিজের। পরবতীতে সে লুণ্ঠন করে অনেক অস্ত্ৰ সংগ্রহ করে । ২। আমিরুল মোমেনিনের এ ভবিষ্যদ্বাণী ছিল তারতারদের (মঙ্গোল) আক্রমণ সংক্রান্ত বিষয়ে। এরা তুর্কীস্থানের উত্তর-পশ্চিমে মঙ্গোলিয়ান মরুভূমির অধিবাসী। এই বর্বর জাতি লুণ্ঠন, হত্যা ইত্যাদি দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতো। এরা নিজেদের মধ্যেও যুদ্ধ-বিগ্রহ করতো এবং প্রতিবেশী এলাকাসমূহ আক্রমণ করতো। প্রত্যেক গোত্রের আলাদা আলাদা গোত্রপতি ছিল, যে নিজের গোত্রের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব বহন করতো। এরকম একটা গোত্রের গোত্রপতি ছিল চেঙ্গিস খান (টেমুজিন)। সে অত্যন্ত দুঃসাহসী ও দুর্ধর্ষ প্রকৃতির লোক ছিল। সে তাদের বিভক্ত গোত্রসমূহকে একত্রিত করার চেষ্টা চালাতে লাগলো। বিভিন্ন গোত্রের বিরোধিতা সত্ত্বেও সে তার বুদ্ধিমত্তা ও শক্তি সামর্থ্যের ফলে কৃতকার্য হয়। তার ঝান্ডা তুলে এক বিশাল বাহিনী জড়ো করে সে ৬০৬ হিজরি সনে ঝড়ের বেগে নগরীর পর নগরী দখল করে নিয়েছিল এবং জনগণকে ধ্বংস করে ছাড়লো। এভাবে সে উত্তর চীন পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখন্ড জয় করে নিল। এসব ভূখন্ডে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার পর সে প্রতিবেশী দেশ তুর্কীস্থানের শাসক আলাউদ্দিন খাওয়ারাজম শাহ-এর সাথে এক চুক্তি করলো যাতে উল্লেখ ছিল যে, তারতার ব্যবসায়ীগণকে তুকীস্থানে ব্যবসায়ের অনুমতি দিতে হবে এবং তাদের জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। কিছুদিন তারা মুক্তভাবে ব্যবসা করার পর আলাউদ্দিন তাদের বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগ এনে তাদের মালামাল বাজেয়াপ্ত করলো এবং আত্রার এলাকার প্রধান দ্বারা তাদেরকে হত্যা করায়েছিল। এতে চেঙ্গিস খান ক্রোধান্ধ হয়ে আলাউদিনের কাছে বার্তা প্রেরণ করলো যেন সে তারতারদের মালামাল ফেরত পাঠিয়ে দেয় এবং আন্তরারের শাসককে যেন তার হাতে তুলে দেয়। আলাউদ্দিন নিজের শক্তি ও ক্ষমতার দম্ভে চেঙ্গিস খানের কথায় কৰ্ণপাত করে নি, বরং অদূরদর্শীর মতে কাজ করে চেঙ্গিসের দূড়কে হত্যা করেছিলো। এতে চেঙ্গিস খানের চোখে রক্ত উঠে গেল। তার নেতৃত্বে তারতার বাহিনী তাদের দ্রুতগামী ও খোজা না করা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে বুখারার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। আলাউদ্দিন চার লক্ষ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মোকাবেলা করেও তারতারদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হলো। মাত্র কয়েকটি আক্রমণের পরই সে পরাজিত হয়ে সিহ্ন নদীর ধারে নিশাবুর এলাকায় পালিয়ে গেল। তারতারগণ বুখারাকে ধুলিসাৎ করে দিল। তারা মানুষের ঘর-বাড়ি, স্কুল ও মসজিদ জ্বলিয়ে ভষ্ম করে ফেললো এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে হত্যা করলো। পরবর্তী বছর তারা সমরকন্দ আক্রমণ করে তা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছিলো। আলাউদ্দিন পালিয়ে যাবার পর তার পুত্র জালালুদ্দিন খাওয়ারাজম সরকারের দায়িত্ব গ্ৰহণ করেছিলো। তারতারগণ তাকেও তাড়না করেছিলো এবং সে দশ বছর এখানে সেখানে পালিয়ে বেড়িয়েছিলো। এ সময় তারতারগণ জনবসতিপূর্ণ স্থানসমূহ ধ্বংস করে মানবতাকে চরমভাবে লাঞ্ছিত করেছিলো। তাদের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে কোন নগরী নিস্কৃতি পায় নি এবং কোন জনপদ তাদের পদদলিন থেকে রেহাই পায় নি। এভাবে সমগ্ৰ উত্তর এশিয়ায় তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ৬২২ হিজরি সনে চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর পর তার পুত্র ওগেদি খান ক্ষমতা দখল করেছিলো। সে ৬২৮ হিজরি সনে জালালুদ্দিনকে খুঁজে বের করে হত্যা করেছিলো। ওগেদি খানের পর তার ভ্রাতুষ্পপুত্ৰ মাংকা খান সিংহাসনে বসে। মাংকা খানের পর কুবলাই খান দেশের একটা অংশের কর্তৃত্ব পায় এবং এশিয়া অংশ তার ভ্রাতা হালাগু। খানের কর্তৃত্বে চলে যায়। সমগ্র রাজ্য চেঙ্গিস খানের পৌত্রদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যাওয়ায় হালাগু খান মুসলিম অধুষিত অঞ্চল জয় করার চিন্তা করতেছিলো। এ সময় খুরাশানের হানাফি মুসলিমগণ শাফেয়ি মুসলিমদের সাথে শক্রিতাবশত খুরাশান আক্রমণের জন্য হালাগু খানকে আমন্ত্রণ জানায়। এতে হালাগু খান খুরাশান আক্রমণ করে। হানফিগণ নিজেদেরকে নিরাপদ মনে করে নগরীর তোরণ খুলে দিয়েছিলো। কিন্তু তারতার বাহিনী হানাফি ও শাফেয়ি নির্বিচারে হাতের কাছে যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে। এভাবে নগরী বিরান করে তারা তা দখল করে নিয়েছে। হানাফি ও শাফেয়িদের এই বিভেদ তার ইরাক জয়ের পথ খুলে দিল। ফলে খুরাশান জয় করার পর তার সাহস বৃদ্ধি পেল এবং ৬৫৬ হিজরি সনে সে দুলক্ষ তারতার বাহিনী নিয়ে বাগদাদ আক্রমণ করলো। তখন খলিফা ছিল মুসতাসিম বিল্লাহ। খলিফার বাহিনী ও বাগদাদের জনগণ সম্মিলিতভাবে হালাগুর আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারে নি। আশুরার দিন তারতার বাহিনী বাগদাদে প্রবেশ করেছিলো এবং চল্লিশ দিন ধরে হত্যাযজ্ঞ ও রক্তপাত চালিয়েছিলো। রাস্তায় রাস্তায় রক্তের স্রোত বয়ে গিয়েছিল এবং অলি-গলি মৃতলাশে পরিপূর্ণ ছিল। মুসতাসিম বিল্লাহকে পদদলিত করে হত্যা করা হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ লোক তাদের তরবারিতে প্রাণ হারিয়েছিল। শুধুমাত্র যারা আত্মগোপন করে তাদের দৃষ্টি এড়াতে পেরেছিল তারা প্ৰাণে রক্ষা পেয়েছে। এতেই আব্বাসিয় রাজত্বের পরিসমাপ্তি ঘটলো এবং তাদের পতাকা আর কোনদিন উড়ে নাই।