জামালের যুদ্ধে আমিরুল মোমেনিন তার পুত্র মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়ার
হাতে পতাকা অর্পণকালে এ খোৎবা প্রদান করেন। পর্বতমালা তার স্থান থেকে সরে পড়তে পারে। কিন্তু তুমি তোমার অবস্থান থেকে নড়তে পারবে না। দাঁতে দাঁত কামড়ে ধরো। তোমার মাথা আল্লাহকে ধার দাও (আল্লাহর পথে যুদ্ধ করতে নিজকে উৎসর্গ করো)। তোমার পদদ্বয় শক্তভাবে জমিনে স্থাপন করো। বহুদূরবতী শত্রুর প্রতিও দৃষ্টি রেখো। শত্রুর সংখ্যাধিক্যের প্রতি ভুক্ষেপ করো না। নিশ্চিত মনে রেখো, সাহায্য ও বিজয় মহিমান্বিত আল্লাহ থেকেই আসে ।
১। মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া আমিরুল মোমেনিনের পুত্র, কিন্তু মায়ের নামানুসারে তাকে ইবনে হানাফিয়া বলা হতো। তার মায়ের নাম খাওলা বিনতে জাফর। বনি হানিফা গোত্রভূত বলে তাকে হানাফিয়া বলা হতো। যখন ইয়ামামার জনগণ ধর্মত্যাগ করে জাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানালো এবং মুসলিম বাহিনীর হাতে পর্যুদস্ত ও নিহত হলো তখন তাদের নারীগণকে কৃতদাসী হিসেবে মন্দিনায় আনা হয়েছিল। খাওলা বিনতে জাফরও তাদের সাথে মন্দিনায় নীত হয়েছিল। বনি হানিফার লোকেরা একথা জানতে পেরে আমিরুল মোমিনের নিকট আবেদন করলো যেন খাওলার পারিবারিক ইজ্জতের খাতিরে তাকে কৃতদাসী হওয়ার কলঙ্ক থেকে রক্ষা করা হয়। ফলে আমিরুল মোমেনিন তাকে ক্রয় করে মুক্ত করে দিলেন এবং তাকে বিয়ে করলেন। এরপর তার গর্ভে মুহাম্মদ জন্মগ্রহণ করলেন।
অধিকাংশ ঐতিহাসিক লেখেছেন তাঁর লকব ছিল আবুল কাসিম । বার” (৩য় খন্ড, পৃঃ ১৩৬৬-১৩৭২) লেখেছেন যে, রাসুলের (সঃ) সাহাবাদের মধ্যে চার জনের পুত্রের নাম ছিল মুহাম্মদ এবং তাদের সকলের লকব ছিল আবুল কাসিম । তারা হলো- (১) মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া (২) মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর, (৩) মুহাম্মদ ইবনে তালহা ও (৪) মুহাম্মদ ইবনে সা’দ। এরপর তিনি লেখেছেন যে, মুহাম্মদ ইবনে তালহার নাম ও লকব রাসুল (সঃ) রেখেছিলেন। ওয়াকিদী’ লেখেছেন যে, মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরের নাম ও লকব আয়শা রেখেছিলেন। মূলত রাসুল (সঃ) কর্তৃক মুহাম্মদ ইবনে তালহার নাম রাখার বিষয়টি সঠিক হতে পারে না। কয়েকটি হাদিস থেকে জানা যায় যে, আমিরুল মোমেনিনের একটা পুত্রের জন্য রাসুল (সঃ) এ নামটি নির্ধারণ করে গিয়েছিলেন। এবং তিনিই হলেন মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া। রাসুল (সঃ) বলেছিলেন – “আলী, আমার পরে তোমার ঔরসে এক পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে। তাকে আমার নাম ও লকব প্রদান করলাম এবং এখন থেকে কারো জন্য একত্রে আমার নাম ও লািকব ব্যবহারের অনুমতি রইলো না ।” রাসুলের (সঃ) উপরোক্ত বাণী সামনে রেখে তালহার পুত্রের নাম রাসুল (সঃ) রেখেছিলেন এ কথা সঠিক হতে পারে না। এ ছাড়া কোন কোন ঐতিহাসিক ইবনে তালহার লকব আবু সুলায়মান (আবুল কাসেম নয়) লেখেছেন। একইভাবে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরের লকব আবুল কাসিম যদি এজন্য হয়ে থাকে যে, তার পুত্রের নাম ছিল কাসিম (যিনি মদিনার আল্লাহতত্ত্ববিদদের অন্যতম ছিলেন) তা হলে আয়শা কিভাবে তার লকব দিয়েছিলেন? মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর আমিরুল মোমেনিনের যত্নে লালিত পালিত হয়েছেন। তার কাছে রাসুলের (সঃ) বাণী আমিরুল মোমেনিনের গোপন রাখার কথা নয়। সে ক্ষেত্রে আয়শা কর্তৃক প্রদত্ত নাম ও লকব একত্রে তিনি নিজেই সহ্য করতেন না। তাছাড়া অনেক ঐতিহাসিক তার লকব লেখেছেন আবু আবদার রহমান। খাল্লিকান’** (৪র্থ খন্ড, পৃঃ ১৭০) লেখেছেন যে, আমিরুল মামোমেনিনের পুত্র মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়ার জন্য রাসুল (সঃ) “আবুল কাসিমা” লকব নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আশরাফ’ (৩য় খন্ড, পৃঃ ১১২) লিখেছেনঃ মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়ার প্রতি এ লকত্ব প্রয়োগ করতে গিয়ে খাল্লিকান বিভ্রাক্তির সৃষ্টি করেছেন । কারণ আমিরুল মোমেনিনের যে পুত্রকে রাসুল (সঃ) তাঁর নাম ও লকব একত্রে দান করেছেন এবং যা অন্য আর কারো জন্য অনুমোদিত নয়, তিনি হলেন প্রতিক্ষীত শেষ ইমাম— মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া নয়। হানাফিয়ার “আবুল কাসেম” লকব প্রতিষ্ঠিত হয় না । কতেক লোক অজ্ঞতা বশত রাসুলের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে ইবনে হানাফিয়াকে বুঝেছে । যা হোক, মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া ন্যায়পরায়ণতা, দয়া, আত্মত্যাগ, ইবাদতে শ্রেষ্ঠত্ব, জ্ঞান ও কীর্তিতে অতি উচ্চ মর্যাদা অর্জন করেছিলেন এবং তিনি তার পিতার বীরত্রে উত্তরাধিকারী ছিলেন। জামাল ও সিফফিনের যুদ্ধে তার কৃতিত্ব এমন প্রভাব ফেলেছিল যে, বড় বড় যোদ্ধাগণও তার নাম শুনলে কেঁপে উঠতো। আমিরুল মোমেনিন তার সাহস ও শৌর্যে গর্বিত ছিলেন এবং সর্বদা যুদ্ধক্ষেত্রে তাকে সন্মুখভাগে দিতেন। আমিলী** লেখেছেন যে, আলী ইবনে আবি তালিব যুদ্ধক্ষেত্রে মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়াকে সন্মুখভাগে রাখতেন। কিন্তু হাসান ও হুসাইনকে সন্মুখে এগিয়ে যেতে দিতেন না এবং প্রায়শই বলতেন, “এ হচ্ছে আমার পুত্র আর ওরা দুজন আল্লাহর রাসুলের পুত্র।” একজন খারিজি ইবনে হানাফিয়াকে বলেছিল যে, আলী তাকে যুদ্ধের দাবানলে ঠেলে দেয়। অথচ হাসান ও হুসাইনকে দূরে সরিয়ে রেখে রক্ষা করতে চায়। তখন হানাফিয়া জবাবে বললেন, “আমি তাঁর দক্ষিণ হস্ত এবং তারা তার চক্ষু। সুতরাং তিনি তাঁর চক্ষুকে দক্ষিণ হস্ত দ্বারা রক্ষা করেন।” আশরাফ** লেখেছেন যে, একজন খ্যারিজির প্ররোচনায় ইবনে হানাফিয়া নালিশের স্বরে এ বিষয়টি আমিরুল মোমেনিনকে বললে, প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছিলেন, “তুমি আমার দক্ষিণ হস্ত। অপরপক্ষে হাসান ও হুসাইন আমার চক্ষু এবং চক্ষুকে রক্ষা করা হাতের কর্তব্য।” এ দুটি মতের মধ্যে কোন অমিল নেই। তবে বাগীতার বিবেচনায় এটা আমিরুল মোমেনিনের উক্তি বলেই অধিক যুক্তিযুক্ত। হয়ত আমিরুল মোমেনিনের কথাই ইবনে হানাফিয়া অন্যের কথার জবাবে বলেছিলেন । মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া দ্বিতীয় খলিফার রাজত্বকালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের রাজত্বকালে ৬৫ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। কোন কোন ঐতিহাসিক ৮০ হিজরিতে তার মৃত্যু হয়েছে বলে লেখেছেন, আবার কেউ কেউ লেখেছেন ৮১ হিজরিতে। তার মৃত্যুর স্থান সম্পর্কে মতভেদ আছে। কেউ বলেন মদিনায়, কেউ বলেন আয়লাতে এবং কেউ বলেন তায়েফে ।
২। জামাল-যুদ্ধে আমিরুল মোমেনিন মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়াকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণকালে বলেছিলেন যে, তিনি যেন শত্রুর সন্মুখে পর্বত প্রমাণ স্থির-সংকল্প ও দৃঢ়তা সহকারে অবস্থান করেন যাতে করে শত্রুর প্রচন্ড আক্রমণও যেন তাকে স্থানচ্যুত করতে না পারে এবং তিনি যেন দাঁতে দাঁত কামড়ে ধরে শক্রকে আঘাত করতে থাকেন। তারপর তিনি বললেন, “বৎস আমার, তোমার মাথা আল্লাহকে ধার দাও। এতে তুমি শাশ্বত জীবন লাভ করবে, কারণ কোন কিছু ধার দিলে তা ফেরত পাবার অধিকার থাকে। তাই তুমি জীবনের দিকে না তাকিয়ে যুদ্ধ করো। যদি তোমার মনে জীবনের মায়া এসে যায়। তবে মৃত্যুর মুখোমুখি হবার জন্য অগ্রবতী হতে তুমি দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়বে। এতে তোমার বীরত্রে সুনাম ক্ষুন্ন হবে। দেখ, কখনো পশ্চাৎপদ হয়ে না, কারণ পশ্চাৎপদ হলে শক্রির সাহস বেড়ে যায় এবং তাদের পদক্ষেপ দ্রুত হয়। শত্রুর সর্বশেষ সারিকে তোমার লক্ষ্য হিসেবে গ্ৰহণ করো। এতে শত্রু তোমার উচ্চাকাঙ্খা অনুধাবন করে ভীত হয়ে পড়বে। তাতে শত্রু বুঢ়োহ ভেদ করা সহজ হবে এবং তাদের গতিবিধিও তোমার কাছে গোপন থাকবে না। দেখো, শত্রুর সংখ্যাধিক্যের প্রতি নজর দিয়ো না-এতে তোমার সাহস ও শৌর্য অক্ষুন্ন থাকবে।” তিনি আরো বলেছিলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে চোখ এত বেশি খোলা উচিত নয় যাতে শত্রুর অস্ত্রের চাকচিক্যে চোখ ধেধে যায় এবং সে সুযোগে শত্রু আক্রমণ করে বসে। সর্বদা মনে রেখো বিজয় আল্লাহর হাতে। যদি আল্লাহ্ তোমাকে সাহায্য করেন তবে কেউ পরাভূত করতে পারবে না। সুতরাং বস্তু উপকরণাদির ওপর নির্ভর না করে আল্লাহর সাহায্য ও সমর্থন অনুসন্ধান করো। আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করলে তোমাদের ওপর জয়ী হবার কেউ থাকবে না।
/ (o بند ہو یا –///تا ایک ممک)