৭৬। যদি কোন ব্যাপার মিশ্রিত হয়ে পড়ে তবে পূর্ববর্তগুলো অনুসারে শেষটির প্রশংসা করতে হবে।
৭৭। জীরার ইবনে হামজাহ আদ-দিবাবী’ মুয়াবিয়ার কাছে বলেছিলেন, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আলী ইবনে আবি তালিবকে আমি বহুবার দেখেছি গভীর রাতে তিনি মসজিদের মধ্যে নিজের দাড়ি ধরে দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে এমনভাবে আর্তনাদ করতেন যেন সাপে কামড়ানো মানুষ এবং তিনি শোকাহত লোকের মতো রোদন করে বলতেনঃ হে দুনিয়া, ওহে দুনিয়া! আমার কাছ থেকে দূর হও। কেন তুমি নিজকে আমার কাছে ব্যাদান করছো? তুমি কি আমাকে পাবার জন্য লালায়িত? আমাকে অভিভূত করার মতো সুযোগ তুমি পাবে না। অন্য কাউকে প্রতারিত করার চেষ্টা করো। তোমার সাথে আমার কোন কাজ নেই। আমি তোমাকে তিন তালাক দিয়েছি; কাজেই আর কোন সম্পর্ক হবার জো নেই। তোমার স্থায়ীত্ব অতি অল্প, তোমার গুরুত্ব নগণ্য এবং তোমার পছন্দ অতি হীন। আহা! রসদ অতি অল্প, পথ খুবই দীর্ঘ— ভ্রমন দীর্ঘ সময়ের— লক্ষ্যস্থলে পৌছা কষ্টসাধ্য।
(১) জীরার ইবনে হামজাহ আমিরুল মোমেনিনের একজন অনুচর ছিলেন। আমিরুল মোমেনিনের ইনতিকালের পর তিনি সিরিয়া গিয়েছিলেন এবং সেখানে তিনি মুয়াবিয়ার সাথে দেখা করেছিলেন। মুয়াবিয়া তাকে বললো “আমার কাছে আলীর বর্ণনা দাও।” জীরার বললো, “আপনি অভয় দিলে আমি জবাব দিতে পারবো।” মুয়াবিয়া বললে, “তুমি নির্ভয় বলো” তারপর জীরার বলতে লাগলেনঃ যদি আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেন। তবে জেনে রাখুন, আলীর ব্যক্তিত্ব ছিল সীমাহীন, তিনি তাঁর জ্ঞান ছিল, তাঁর প্রতিটি আচরণে প্রজ্ঞা প্ৰকাশিত হতো । তিনি মোটা খাদ্য পছন্দ করতেন এবং অল্প দামের পোষাক পছন্দ করতেন । আল্লাহর কসম, তিনি আমাদের একজন হিসাবে আমাদের মাঝে ছিলেন । তিনি আমাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দিতেন এবং আমাদের সকল অনুরোধ রক্ষা করতেন । আল্লাহর কসম, যদিও তিনি আমাদেরকে তাঁর কাছে যেতে দিতেন প্রকৃতপক্ষে তিনি আমাদের কাছেই ছিলেন । তাঁর প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ অনুভূতি থাকা সত্ত্বেও তাকে সম্বোধন করে। কিছু বলতে আমরা ভয় পেতাম না । আমাদের হৃদয়ে তার মহত্ত্ব অনুভূত থাকা সত্ত্বেও আমরা প্রথম কথা বলতে ভয় পেতাম না । তাঁর হাসিতে মুক্ত ছড়িয়ে পড়তো । তিনি ধার্মিকদের খুব সম্মান করতেন । অভাবগ্রস্তের প্রতি খুবই দয়ালু ছিলেন । তিনি এতিম, নিকট আত্নীয় ও অন্নহীনকে খাওয়াতেন । তিনি বস্ত্রহীনে বস্ত্র দিতেন ও অক্ষম ব্যক্তিকে সাহায্য করতেন । তিনি দুনিয়া ও এর চাকচিক্যকে ঘৃণা করতেন। (তারপর ওপরের ৭৭ নং এ বর্ণিত কথাগুলো বললেন) জীরারের মুখ থেকে এসব কথা শুনে মুয়াবিয়ার চোখে পানি এসেছিল এবং সে বললো, “আবুল হাসানের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। তিনি প্রকৃতপক্ষে এরূপ ছিলেন।” তারপর জীর্যারের দিকে ফিরে বললো, তার অনুপস্থিতি তুমি কেমন অনুভব কর, হে জীরার।” জীরার বললো, “আমি সেই মহিলার মতো শোকাহত যার সন্তানকে তার কোলে রেখে কেটে ফেলা হয়েছে” (বার”, ৩য় খন্ড, পৃঃ ১১০৭-১১০৮; ইসফাহানী’, ২য় খন্ড, পৃঃ ৮৪; হাম্বলী***, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১২১; কালী**, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৪৭, হুসরী***’, ১ম খন্ড, পৃঃ ৪০-৪১; মাসুদী”, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৪২১; শাফী***, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২১২; হাদীদ”**, ১৮শ খণ্ড, পৃঃ ২২৫-২২৬)।
৭৮। এক ব্যক্তি আমিরুল মোমেনিনকে জিজ্ঞেস করেছিল, “সিরিয়ানদের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ কি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ছিল? তিনি বললেনঃ তোমার ওপর ল্যানত। তুমি এটাকে চূড়ান্ত ও অপরিহার্য ভাগ্য বলে মনে কর (যা আমল করতে আমরা বাধ্য)। যদি বিষয়টা সে রকম হয় তবে পুরস্কার অথবা শাস্তির প্রশ্ন উঠে না। এবং আল্লাহর প্রতিশ্রুতি ও সতকাদেশ অর্থবহ হয় না । অপরপক্ষে, মহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে স্বাধীন ইচ্ছায় আমল করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং পাপ সম্পর্কে সতর্ক করে। বিরত থাকতে বলেছেন । তিনি তাদের ওপর সহজ। সাধ্য দায়িত্ব অপর্ণ করেছেন এবং কোন ভারী দায়িত্ব
অপর্ণ করেন নি । তিনি তাদেরকে ক্ষুদ্র আমলের জন্য অধিক পুরস্কার দিয়ে থাকেন । তাকে পরাভূত করার কারণে কেউ অমান্য করে না । তাকে মান্য করতে কাউকে বল প্রয়োগ করা হয় না । শুধুমাত্র কৌতুক করার জন্য তিনি নবি প্রেরণ করেন নি । কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই তিনি মানুষের জন্য। কুরআন নাজেল করেন নি । তিনি আকাশমন্ডলী, পৃথিবী ও এ দুয়ের মধ্যবর্তী সব কিছু বৃথা সৃষ্টি করেন নি । “যারা অবিশ্বাস করে তারা এরূপই কল্পনা করে, তারপর যারা অবিশ্বাস করে তাদের ওপর ল্যানত—আগুনের কারণে (কুরআন ৩৮;২৭)
৭৯। তারা যা বলে তা থেকে প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় গ্রহণ করো, কারণ জ্ঞানগর্ভ কোন কিছু যদি মোনাফেকদের বক্ষে থাকে। তবে তা বেরিয়ে এসে মোমেনের বক্ষে আশ্রয় নেয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে।
৮০। জ্ঞানগর্ভ বাণী মোমেনের কাছে হারানো বস্তুর মতো। কাজেই মোনাফেকের কাছ থেকেও জ্ঞানগর্ভ বাণী পেলে গ্রহণ করো।
৮১। মানুষকে তার সাফল্য ও সিদ্ধি অনুযায়ী মুল্যায়ন করা হয়।
৮২। আমি তোমাদেরকে পাচটি বিষয় বলে দিচ্ছি। যদি তোমরা উটে চড়ে দ্রুত তা খুজে নাও (অর্থাৎ মানতে চেষ্টা করো) তবে এর সুফল পাবে।
আল্লাহ ছাড়া আর কিছুতে আশা স্থাপন না করা নিজের পাপ ছাড়া আর কোন কিছু ভয় না। করা যা নিজে জানো না সে বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হলে, “আমি জানি না” বলতে লজাবোধ না করা যা নিজে জানো না তা অন্যের কাছ থেকে শিক্ষা করতে লজ্জা না করা; এবং ধৈর্য ধারণ করার অভ্যাস করা, কারণ দেহের জন্য মাথা যেরূপ ইমানের জন্য ধৈর্য তদ্রপ।
৮৩। এক ব্যক্তি আমিরুল মোমেনিনকে খুশি করার জন্য তার প্রশংসা করলে তিনি বললেন, যতটুকু তুমি প্রকাশ করেছে। আমি ততটুকু নই, কিন্তু যা তোমার অন্তরে রয়েছে তা থেকে আমি অনেক উর্ধে।
৮৪। তরবারি থেকে বেঁচে যাওয়া লোকের সংখ্যা ও তাদের বংশধরের সংখ্যা বিরাট ।
৮৫। ‘আমি জানি না” বলা যে পরিত্যাগ করে সে ধ্বংসের মুখোমুখি হয়।
৮৬। বয়ঃজ্যেষ্ঠ লোকের মতামত যুবকদের সংকল্পের (ভিন্নমতে শাহাদাত) চেয়েও আমি অনেক বেশি ভালোবাসি ।
৮৭। ক্ষমা প্রার্থনার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি নিরাশায় ভোগে তার সম্বন্ধে আমার আশ্চর্য লাগে।
৮৮। ইমাম বাকির থেকে বর্ণিত আছে যে, আমিরুল মোমেনিন বলেছেনঃ আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পাবার দুটি উপায় ছিল- একটি তুলে নেয়া হয়েছে অপরটি তোমাদের সম্মুখে রয়েছে । সুতরাং এটাকে (যেটা সামনে আছে) তোমাদের মানতে হবে রক্ষা পাবার যে উপায়টি তুলে নেয়া হয়েছে তা হলো আল্লাহর রাসুল এবং যেটি এখনো আছে তা হলো ক্ষমা প্রার্থনা করা। মহিমানিত আল্লাহ বলেন, “এবং আল্লাহ তোমাদের শাস্তি দেবেন না। যদি তোমরা তাদের মধ্যকারী হও এবং আল্লাহ তাদেরও শাস্তি দেবে না। যারা ক্ষমা প্রার্থনা করে” (কুরআন-৮; ৩৩) ৷
৮৯। যদি কোন মানুষ আল্লাহ ও তার নিজের মধ্যকার ব্যাপারে যথাযথ আচরণ করে তবে আল্লাহ তার ও অন্যের মধ্যকার বিষয়াবলী যথাযথ রাখেন। যদি কেউ পরকালের জন্য যথাযথ কর্মকান্ড করে। তবে আল্লাহ তার ইহকালের কর্মকান্ড যথাযথ রাখেন। যদি কেউ নিজেই নিজের ধর্মোপদেষ্টা হয় তবে আল্লাহ তাকে রক্ষা করেন।
৯০। ইসলামের যথার্থ ফেকাহাবিদ সে যে আল্লাহর রহমত থেকে মানুষকে নিরাশ করে না, আল্লাহর দয়ার প্রতি হতাশ করে না এবং আল্লাহর শাস্তি থেকে নিরাপদ বলে মনে করিয়ে দেয় না।
৯১। দেহের বিরক্তিকর অবস্থা হলে হৃদয়ও বিরক্ত হয়ে পড়ে; সুতরাং সৌন্দর্যপূর্ণ জিনিস দেখা বুদ্ধিমানের কাজ।
৯২। হীনতম জ্ঞান জিহবায় থাকে এবং উচ্চমানের জ্ঞান কর্মের মাঝে প্রকাশ পায় ।
৯৩। কারো একথা বলা উচিত নয়। “হে আল্লাহ বিপদাপদ থেকে আমি তোমার ফানা চাই”, কারণ বিপদাপদ ছাড়া কাউকে পাওয়া যাবে না। যদি কেউ আল্লাহর নিরাপত্তা চায়। তবে বিপথগামিতা থেকে নিরাপত্তা চাওয়া উচিত। কারণ মহিমান্বিত আল্লাহ বলেন, “এবং জেনে রাখো যে, তোমাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পরীক্ষা মাত্র” (কুরআন-৮ঃ ১২)। এ আয়াতের অর্থ হলো আল্লাহ সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা এজন্য মানুষকে পরীক্ষা করেন যাতে যে ব্যক্তি তার জীবিকা নিয়ে অসন্তুষ্ট তার থেকে ওই ব্যক্তিকে আলাদা করা যায় যে প্রাপ্ত জীবিকায় খুশি । মহিমান্বিত আল্লাহ তাদের সম্বন্ধে জানেন যা তারা নিজেরাও তাদের সম্বন্ধে জানে না। তবুও তিনি এমনভাবে কর্মসাধন করতে দেন যার মাধ্যমে পুরস্কার অথবা শাস্তি অর্জন করতে পারে। কারণ তাদের কেউ পুরুষ সন্তান পছন্দ করে ও নারী সন্তান অপছন্দ করে এবং কেউ সম্পদ স্তুপীকৃত করতে চায় আবার কেউ দারিদ্র অপছন্দ করে।
৯৪। এক ব্যক্তি আমিরুল মোমেনিনকে জিজ্ঞেস করেছিল ভালো কী। উত্তরে তিনি বললেনঃ
ভালো মানে এ নয় যে তোমার অনেক সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি থাকবেঃ ভালো মানে তোমার অনেক জ্ঞান থাকবে; তোমার ধৈর্য থাকবে অসীম এবং তুমি আল্লাহর ইবাদতে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে। যদি তুমি ভালো কাজ কর। তবে আল্লাহর কাছে শুকারিয়া আদায় করো, যদি তুমি পাপ কর। তবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। এ পৃথিবীতে ভালো শুধু দুব্যক্তির জন্য যে পাপ করার পর তওবা করে এবং যে ব্যক্তি দ্রুত ভালো কাজের
দিকে এগিয়ে যায়।
৯৫। যে কাজে আল্লাহর ভীতি থাকে তা ব্যর্থ হয় না; যা মকবুল তা কী করে ব্যর্থ হতে পারে।
৯৬। রাসুল (সঃ) কী এনেছেন তা যে যত বেশি জানে সে রাসুলের তত নিকটের। “নিশ্চয়ই, ইব্রাহীমের তারাই বেশি নিকটতম যারা তাকে ও এ নবিকে অনুসরণ করে এবং যারা বিশ্বাস করে” (কুরআন-৩৪৬৮)। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও সে-ই মুহাম্মদের বন্ধু যে আল্লাহর আনুগত। আর আল্লাহকে যে অমান্য করে সে মুহাম্মদের শত্রু, থাকুক না কেন তার নিকট জ্ঞাতিত্ব।
৯৭। দৃঢ় ইমানে ঘুমানো সংশয় পূর্ণ ইবাদত থেকে অধিকতর ভালো।
৯৮। যখন তুমি কোন হাদিস শোন তখন বুদ্ধিমত্তার সাথে তা পরীক্ষা করো, কারণ হাদিস বর্ণনাকারী জ্ঞানী লোকের সংখ্যা অনেক কিন্তু হাদিসের সঠিকতা রক্ষাকারীর সংখ্যা খুবই কম।
৯৯। এক ব্যক্তিকে “ইন্নানিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” (কুরআন-২ ঃ ১৫৬) পড়তে শুনে আমিরুল মোমেনিন বললেন, আমরা “ইন্নানিল্লাহি” বলে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে এবং ‘ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” বলে আমাদের মরণশীলতাকে স্বীকার করছি।
১০০। কতিপয় ব্যক্তি আমিরুল মোমেনিনের সামনে তার প্রশংসা করলে তিনি বললেন, হে আমার আল্লাহ, তুমি আমাকে আমার চেয়ে অনেক বেশি জান এবং আমি আমার নিজকে তাদের চেয়ে বেশি জানি। হে আমার আল্লাহ, তারা যতটুকু চিন্তা করে তার চেয়ে অধিক ভালো তুমি আমাদের করে দাও এবং তারা যা জানে না সে বিষয়ে আমাদের ক্ষমা করে দাও ।