সালিসির’ পর আমিরুল মোমেনিন এ ভাষণ দিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠিত প্রশংসা আল্লাহর, যদিও সময় আমাদের জন্য চরম দুর্যোগ ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা বয়ে
এনেছে। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি। আল্লাহ ব্যতীত আর কোন মারুদ নেই, তার কোন অঅংশীদার নেই, তার সাথে আর কারো তুলনা হয় না এবং মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর বান্দা ও রাসুল। সমবেদী উপদেষ্টার জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও তার অবাধ্যতা আমাদের জন্য নৈরাশ্য ও
দুঃখজনক ফলাফল ডেকে আনলো। এ সালিসি সম্পর্কে আমি পূর্বাহ্নেই তোমাদের নির্দেশ দিয়েছিলাম
এবং আমার গোপন মনোভাব তোমাদের কাছে ব্যক্ত করেছিলাম। কিন্তু তোমরা রূঢ় প্রতিপক্ষ ও জঘন্য
অবাধ্যের মতো আমার আদেশ প্রত্যাখ্যান করেছো । আহা! যদি কাসিরের আদেশ প্রতিপালিত হতো!!
উপদেষ্টা নিজেই তার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সন্দেহে পতিত হয়েছিল এবং তার বুদ্ধিমত্তা নিস্তেজ হয়ে
গিয়েছিল। ফলে আমার ও তোমাদের অবস্থা যা কবি হাওয়াজিন বলেনঃ
মুনারাজিল লিওয়াদে আমি তোমাদেরকে আমার আদেশ দিয়েছিলাম, কিন্তু তোমরা
পরদিন দুপুরের পূর্ব পর্যন্ত আমার উপদেশের কল্যাণ দেখতে পাও নি ।
১। সিফফিনের যুদ্ধে ইরাকদের রক্ত-পিপাসু। তরবারি যখন সিরিয়দের উদ্দীপনা ও মনোবল ভেঙ্গে দিয়েছিল
এবং আল-হারিরের রাতের অবিরাম আক্রমণে তাদের উচ্চাকাঙ্খা গুড়িয়ে দিল, তখন আমর ইবনে আস
মুয়াবিয়াকে একটা কুটাচালের পরামর্শ দিয়ে বললো, “বর্শার আগায় পবিত্র কুরআন তুলে ধরে ইরাকিদের কাছে দাবি করতে হবে-এ কুরআনকেই সালিস মেনে নাও-কুরআনই তোমাদের ও আমাদের মধ্যে ফয়সালা। এতে কিছু লোক যুদ্ধ বন্ধ করতে চেষ্টা করবে এবং কিছু লোক যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চাইবে। ফলে তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়ে যুদ্ধ স্থগিত হয়ে যাবে।”
আমরের পরামর্শ অনুযায়ী বর্শার অগ্রভাগে কুরআন বেঁধে উর্ধের্ব তুলে ধরা হলো। ফলে কিছু সংখ্যক জ্ঞানহীন
লোক হৈ চৈ শুরু করে বিভেদ সৃষ্টি করে ফেললো এবং প্রায় জয়ের মুখে আমিরুল মোমেনিনের সৈন্যদের ক্ষিপ্রতা
শুথ হয়ে গেল। তারা কিছুই না বুঝে চিৎকার করে বলতে লাগলো, “যুদ্ধাপেক্ষা আমর কুরআনের ফয়সালা
অধিক ভালো বলে মনে করি।” আমিরুল মোমেনিন যখন দেখলেন। কুরআনকে চালা ব্যবহার করা হয়েছে তখন তিনি বললেনঃ করা হাতয়ার হিসাবে
“হে সৈন্যগণ, এ প্রতারণা ও চাতুরির ফাঁদে পড়ো না । পরাজয়ের গ্রানি থেকে রক্ষা পাবার জন্য তারা এ কৌশল অবলম্বন করেছে । তাদের প্রত্যেকের চরিত্র আমার জানা আছে । তারা প্রকৃতপক্ষে কুরআনের অনুগামী নয়; দ্বিনি বা ইমানের সাথে তাদের কোন সংশ্ৰব নেই । আমাদের জিহাদের মূল কারণই হলো—তাদেরকে কুরআন মেনে চলতে এবং কুরআনের আদেশ-নিষেধ অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য করা । আল্লাহর দোহাই, তোমরা তাদের প্রতারণামূলক কৌশলের শিকার হয়ো না । তোমরা এগিয়ে চলো—তোমাদের উদম, সংকল্প ও সাহস নিয়ে । তোমাদের শত্রুর অবস্থা মুমূর্ষ প্রায়-তাদের নিশ্চিহ্ন করা পর্যন্ত থেমে যেয়ো না ।” তাসত্ত্বেও প্রতারণামূলক ও বিভ্রাক্তিকর এ হাতিয়ার কার্যকর হলো । কিছু লোক অবাধ্য হয়ে বিদ্রোহের পথ বেছে নিল । এদের মধ্যে মিসার ইবনে ফাদকী। আত-তামিমী ও জায়েদ ইবনে হুসাইন আত-তাঈ বিশ হাজার সৈন্য নিয়ে এগিয়ে এসে আমিরুল মোমেনিনকে । বললো, “হে আলী, আপনি যদি কুরআনের ডাকে সাড়া না দেন। তবে আমরা উসমানের সাথে যেমন ব্যবহার করেছি আপনার সাথেও তেমন ব্যবহার করবো আপনি এখনি যুদ্ধ বন্ধ করুন এবং কুরআনের ফ্যাসালা মেনে নিন।” আমিরুল মোমেনিন তাদেরকে বুঝাতে আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। কিন্তু শয়তান তাদেরকে বুঝতে দেয় নি। মালিক ইবনে হারিছ। আশাতীর বিপুল বিক্রমে তখন শত্রু নিধন করে এগিয়ে যাচ্ছিলো। মালিককে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফেরত আনার জন্য কাউকে পাঠাতে তারা আমিরুল মোমেনিনকে বাধ্য করলো ফলে ইয়াজিদ ইবনে হানিকে দিয়ে মালিককে ডেকে পাঠানো হলো মালিক এ আদেশ শোনা মাত্র হতভম্ব
হয়ে বললেন, “তাঁকে (আমিরুল মোমেনিনকে) আমার সালাম জানিয়ে বলো এখন অবস্থান ত্যাগ করার সময় নয় । তাঁকে একটু অপেক্ষা করতে বলো । আল্লক্ষণের মধ্যেই বিজয়ের সংবাদ নিয়ে আমি তাঁর কাছে হাজির হবো ।” ইবনে হানি এ বার্তা নিয়ে আমিরুল মোমেনিনের নিকট পৌছলে লোকেরা চিৎকার করতে লাগলো যে, যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য তিনি গোপনে খবর দিয়েছেন । অথচ তিনি যা বলেছিলেন তাদের সামনেই বলেছেন লোকেরা তখন বললো, যদি মালিক ফিরে আসতে বিলম্ব করে তবে আমিরুল মোমেনিন তাঁর জীবনের আশা ত্যাগ করতে পারেন । এরপর ইবনে হানিকে আবার পাঠানো হলো । তিনি মালিককে বললেন, “তোমার কাছে কি আমিরুল মোমেনিনের জীবন অপেক্ষা বিজয় বেশি প্রিয়? যদি তাঁর জীবন বেশি প্রিয় হয়ে থাকে। তবে যুদ্ধ ছেড়ে তাঁর কাছে চলে যাও।” বিজয়ের সুযোগ ছেড়ে দিয়ে হতাশা আর দুঃখ ভারাক্রাক্ত মন নিয়ে মালিক আমিরুল মোমেনিনের সম্মুখে উপস্থিত হলেন । তিনি দেখলেন সেখানে গোলযোগ চলছে । তিনি সেখানে উপস্থিত। লোকদেরকে অনেক তিরস্কার করলেন। কিন্তু ব্যাপারটা এমনভাবে মোড় নিয়েছিল যা আর ঠিক করা সম্ভব হয় নি ।
অবশেষে স্থির হলো যে, উভয়ে একজন করে সালিস মনোনীত করবে। যারা কুরআন অনুযায়ী খেলাফতের বিষয় নিষ্পত্তি করবে। মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে আমর ইবনে আসকে মনোনয়ন দেয়া হলো। আমিরুল মোমেনিনের পক্ষ থেকে আবু মুসা আশআরীর নাম প্রস্তাব করা হলো। এ ভুল মনোনয়ন দেখে আমিরুল মোমেনিন বললেন, “সালিসির ব্যাপারে তোমরা আমার আদেশ অমান্য করেছে। এখন অন্তত আমার এ কথাটি মান্য কর, আবু মুসাকে সালিস মনোনীত করো না। সে বিশ্বস্ত লোক নয়। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস অথবা মালিক আশতার—এ দুজনের এক জনকে সালিস মনোনীত কর।” কিন্তু তারা তাঁর কথা মানলো না এবং তার দেয়া নাম বাদ দিয়ে দিলো। আমিরুল মোমেনিন বললেন, “ঠিক আছে, তোমরা যা খুশি করো। তবে সেদিন বেশি দূরে নয় যখন তোমরা বুঝতে পারবে যে, নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মেরেছে”।
সালিস মনোনয়নের পর যখন এতদসংক্রান্ত চুক্তিপত্র লেখা হলো তখন আলী ইবনে আবি তালিবের পর “আমিরুল মোমেনিন” শব্দগুলো লেখা হয়েছিল। এতে আমর ইবনে আস বললো, “আমিরুল মোমেনিন মুছে ফেলো। যদি আমরা তাকে আমিরুল মোমেনিন বলেই স্বীকার করি তবে কেন এ যুদ্ধ লড়ছি?” প্রথমত আমিরুল মোমেনিন আমরের প্রস্তাবে অস্বীকৃতি জানালেন। কিন্তু তারা কোনভাবেই এ শব্দগুলো চুক্তিতে রাখতে রাজি হয় না। দেখে আমিরুল মোমেনিন তা মুছে ফেলে বললেন, “এ ঘটনা হুদায়বিয়ার সন্ধির মতোই যখন কাফেরগণ আল্লাহর রাসুল লেখা মানলো না এবং রাসুল (সঃ) তা কেটে দিলেন।” এ কথায় আমর ইবনে আস রাগান্বিত হয়ে বললো, সাথে কিছু করেছিলে? তুমি কি কোনদিন মোমেনদের সমর্থক ছিলে?” যা হোক এ চুক্তির পর জনতা চলে গোল এবং সালিসীদ্বয় পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সাব্যস্ত করলো যে, আলী ও মুয়াবিয়া উভয়কে খেলাফত থেকে সরিয়ে দিয়ে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করার ক্ষমতা জনগণকে দেয়া হবে। এ সিদ্ধান্ত ঘোষণার জন্য ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যবতী দুমাতুল জান্দাল নামক স্থানে একটা সভা আহবান করা হলো। সালিসদ্বয়ও তাদের রায় ঘোষণার জন্য সেখানে উপস্থিত হলেন। আমর ইবনে আস চাতুর্যের পথ অবলম্বন করে আবু মুসাকে বললো, “আপনি বয়ঃজ্যেষ্ঠ, আপনার আগে কথা বলা আমি বেয়াদবি মনে করি। কাজেই আপনি আগে ঘোষণা করুন।” আবু মুসা আমরের তোষামোদে অভিভূত হয়ে জনতার সামনে গর্বভরে দাঁড়িয়ে বললেন, “হে মুসলিমগণ, আমরা উভয়ে যুগভাবে সাব্যস্থ করেছি যে, আলী ও মুয়াবিয়া খেলাফত থেকে সরে দাঁড়াবে এবং আপনারা আপনাদের পছন্দমত একজন খলিফা নিয়োগ করবেন।” একথা বলে আবু মুসা বসে পড়লেন এবং আমর ইবনে আস দাঁড়িয়ে বললো, “হে মুসলিমগণ, আপনারা শুনলেন যে, আবু মুসা আলী ইবনে আবি তালিবকে অপসারণ করেছেন। আমি তার সাথে একমত পোষণ করি। মুয়াবিয়াকে অপসারণ করার প্রশ্ন উঠে না (কারণ সে খলিফা নয়)। সুতরাং আলীর স্থলে আমি মুয়াবিয়াকে নিয়োগ করলাম।” আমর ইবনে আস একথা বলা মাত্র চতুর্দিকে হৈ হুল্লোড় শুরু হয়ে গেল। আবু মুসা চিৎকার করে বলতে লাগলেন যে, এটা চাতুরি, এটা প্রতারণা। কিন্তু কে শোনে কার কথা! তিনি ইবনে আসকে বললেন, “তুমি চাতুরি করেছে। তোমার উপমা সেই কুকুরের মতো যার কাছে কোন কিছু রাখলে সে আত্মসাৎ করে।” আমর ইবনে আস বললো, “তোমার উপমা সেই গাধার মতো যার পিঠে পুস্তক বোঝাই করা হয়।” আমরের এ চাতুর্যের ফলে মুয়াবিয়ার কম্পিত পা আবার কিছুটা শক্ত হলো ।
সংক্ষিপ্তাকারে সালিসির ফলাফল এটাই যা কুরআনের নামে করা হয়েছে। এহেন প্রতারণা কি কুরআনের শিক্ষা? ইতিহাসের এ পাতাগুলো ভবিষ্যতের পথ-নির্দেশক হিসেবে গ্রহণ করা যায় কি? আমিরুল মোমেনিন সালিসির এ দুঃখদায়ক সংবাদ পেয়ে মিম্বারে উঠে। এ খোৎবা প্রদান করেছিলেন।
২। এটা একটা আরবি প্ৰবাদ। কোন পরামর্শদাতার উপদেশ অমান্য করে পরে অনুশোচনা করলে এ প্রবাদ প্রয়োগ করা হয়। এ প্রবাদের ঘটনা হলো—হীরা অঞ্চলের শাসনকর্তা যাযিমাহ আল আব্রাশ জামিরাহ অঞ্চলের শাসনকর্তা আমর ইবনে যারিবকে হত্যা করে তার কন্যা যাব্বাহকে জামিরাহর শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। সিংহাসনে আরোহণ করেই যাব্বাহ তার পিতার রক্তের বদলা নেয়ার পরিকল্পনা করে। ফলে সে যাযিমাহর নিকট এ বলে বার্তা প্রেরণ করলো যে, একাকিনী অবস্থায় শাসনকার্য পরিচালনা করা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। সুতরাং যাযিমাহ যদি তাকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করে শাসনকার্যে তার পৃষ্ঠপোষকতা করে তবে সে কৃতজ্ঞ থাকবে। যাযিমাহ এ প্রস্তাবে উৎফুল্ল হয়ে এক হাজার অশ্বারোহী নিয়ে জাযিরাহ অঞ্চলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো। যাযিমাহর ক্রীতদাস কাসির তাকে উপদেশ দিয়েছিল যে, এ প্রস্তাব প্রতারণা ও চাতুরি ছাড়া আর কিছুই নয়। কাজেই যাযিমাহ এ বিপদে নিজেকে ঠেলে না দেয়াই মঙ্গল। কিন্তু যাযিমাহর বুদ্ধিমত্তা এমনভাবে লোপ পেয়েছিল যে, সে চিন্তাই করতে পারে নি কেন যাব্বাহ তার পিতার হত্যাকারীকে স্বামী হিসাবে বরণ করবে? সে জাযিরাহ রাজ্যের সীমান্তে পৌছে দেখলো যাব্বোহর সৈন্য তাকে সম্বর্ধনা দেয়ার অপেক্ষা করছে কিন্তু কোন বিশেষ সম্বর্ধনা বা অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করা হয় নি। এতে কাসিরের সন্দেহ আরো ঘনীভূত হলো। সে যাযিমাহকে ফিরে যেতে বললো। যাযিমাহ তার উপদেশ কর্ণপাত করলো না। ফলে শহরে পৌছা মাত্রই যাযিমাহকে হত্যা করা হলো । এতে কাসির বললো, “আহা, যদি কাসিরের উপদেশ মান্য করা হতো।” এ থেকেই আরবি ভাষায় এ প্রবাদ প্রচলিত হয়েছে।
৩। হাওয়াজিনের কবি বলতে দুরায়েদ ইবনে সিন্মাহকে বুঝানো হয়েছে। তাঁর ভ্রাতা আবদুল্লাহ ইবনে সিম্মাহর মৃত্যুতে এ কবিতা লেখেছিল। ঘটনাটি হলো—আব্দুল্লাহ্ ও তার ভাই হাওয়াজিনের বনি জুশাম ও বনি নসর এর নেতৃত্ব দিয়ে একটা আক্রমণ পরিচালনা করে অনেক উট ত ড়িয়ে নিয়ে এসেছিল। ফেরার পথে মুন আরাজিল লিওয়া নামক স্থানে বিশ্রাম গ্রহণের জন্য আবদুল্লাহ মনস্থির করলো। দুরায়েদ তাকে নিষেধ করলো কারণ পিছন থেকে শত্রু আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু আবদুল্লাহ কৰ্ণপাত না করে সেখানে রয়ে গেল। ফলে ভোরবেলা আক্রমণ করে শত্রু আবদুল্লাহকে হত্যা করলো। দুরায়েদ আহত হয়ে প্ৰাণে বাঁচালো। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুরায়েদ বেশ কয়েকটি কবিতা লেখেছিল। তন্মধ্যে খোৎবায় উল্লেখিত কবিতাটি জনপ্রিয়।